এক।
'স্যার ভিতরে আসব ?' দরজায় মৃধ ধাক্কা দিয়ে বেশ দুর্বল গলায় বলল লোকটি।
আর্কিওলোজিষ্ট নী বেশ মনোযোগ সহকারে পত্রিকা পরছিলেন।গত কয়েক মাস ধরে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে এই শহরে, বেশ কিছু মানুষ লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে, পুলিশ কোন হদিস পাচ্ছে না, শহরে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। অপ্রয়োজনে কাউকে বাহিরে বের হতে নিষেধ করেছেন নগর নিরাপত্তা পরিষদ। শালারা সব আকামের ঢেঁকি, অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি থাকার পরও একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসেও অপরাধী ধরিতে পারেনা বলেই মনে মনে একটি গালি দিলেন নী।
আগন্তুক এবার গলা পরিষ্কার করে আবারো বলল 'স্যার ভিতরে আসতে পারি?'
নী দুপুরের এই সময়টাতে কাউকেই সাক্ষাৎ দেন না। তিনি বিরক্তি নিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পরখ করে নিলেন, আগন্তুক দেখতে বেটে খেটে, বড়বড় চোখ,গায়ের রং দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা, বয়স বড়জোর পঁচিশ হতে পারে। তার কাছে কি কাজ থাকতে পারে ভাবতে লাগলেন তিনি। হারামজাদার খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই এই অসময়ে এসেছে ডিস্টার্ব করতে, মনে হয় চড় মেড়ে চেহারার ভুগল পাল্টে দেই মনে মনে ভাবলেন নী, কিন্তু নিতান্তই ভদ্রলোক বিদায় ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে পারলেন না।
'আমি কি তোমাকে চিনি ?'
আগন্তুক এবার ঠোট জোরা প্রশস্ত করে বলল 'স্যার ভিতরে এসে বলি ?' বলেই অনুমতির অপেক্ষা না করেই সোফায় গিয়ে বসল।
'স্যার আমার নাম আমি মার্টিন, এই শহরের একটি ব্লাড ব্যাংকে চাকরি করি তবে থাকি শহরের বাহিরের একটি দ্বিপে। দ্বীপে যেই বাসাটাতে থাকি সেটা কিনেছিলেন আমার বাবা, আমি কাজ শেষে প্রতিদিনই সেখানে চলে যাই, শহরের কোলাহল আমার ভাল লাগে নাহ।' আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল আগন্তুক মার্টিন।
নী থামিয়ে দিয়ে বলল 'তাতে আমি কি করতে পারি! আমার কাছে কেন এসেছ ?'
'স্যার বলছি সম্প্রতি আমি আমার বাসায় অদ্ভুত এক জিনিষ আবিষ্কার করেছি, বাড়িটিতে একটি গোপন দরজা পেয়েছি যেটি গিয়ে ঠেকেছে মাটির নীচের এক ল্যাবরেটরিতে। এই গোপন ল্যাবরেটরিটি এত দিন পর্যন্ত কারো চোখেই পড়েনি।'
একটু থেমে আবার বলল 'সেই ল্যাবরেটরিতে আমি আমি একটি পুরনো ডায়েরি পেয়েছি।' এতটুকুন বলেই আগন্তুক নী এর দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করলেন।
নী লক্ষ করলেন শীতের এই সময়টাতেও আগন্তুক মার্টিনের কপাল ঘামছে, অনেকটা অন্যমনস্ক লাগছে তাকে।
আর্কিওলোজিষ্ট নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন 'তাতে আমি কি করতে পারি ?'
জিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল 'আপনি আর্কিওলোজিষ্ট, পুরনো জিনিষের ব্যাপারে আপনার আগ্রহ থাকার কথা তাই আপনার কাছে এসেছি!'
নী মনে মনে গালি দিয়ে বললেন হারামজাদা, কাম কাজ নেই আমার কাছে এসেছে।
'আমি রিটায়ার্ড করেছি, এসবে আর আমার কোন আগ্রহ নেই।তাছাড়া শহরে আমি ছাড়াও আরো অনেক আর্কিওলোজিষ্ট আছে, আমার বাসার ঠিকানা কিভাবে পেলে?' ভ্রু নাচিয়ে বললেন নী।
মার্টিন নিজের ব্যাগের থেকে একটি পুরনো ডায়েরি বের করল। বলল 'ডায়রিটি অনেক পুরনো, কোন এক বিজ্ঞানীর ডায়েরি মনে হল, সেই বিজ্ঞানী নিজের দৈনন্দিন কার্যকলাপ লিখে রাখতেন এই ডায়রিতে। মৃত মানুষকে কিভাবে জীবিত করা যায় এই সব হাবিজাবি নিয়ে লেখা, আমি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ, এই বিষয়ে অজ্ঞই বলা যায়।' আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল মার্টিন
নী তাকে থামিয়ে দিল। মনে মনে বেশ আগ্রহ বোধ করলেও সেটা গোপন করে ঝাঁঝ মেশানো গলায় বললেন 'ডায়রি ফাইরির কাহিনী শুনার সময় আমার নেই। আমি কোন সিলেব্রেটি নই, তুমি আমার বাসার ঠিকানা কিভাবে পেলে আগে বল সেটা?'
মার্টিন সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল 'ডায়েরিতে অদ্ভুত একটি লেখা দেখলাম স্যার। সেখানে আপনার নাম এবং ঠিকানা দেয়া আছে, সেই বিজ্ঞানী চাচ্ছিল ভবিষ্যতে আপনার হাতে যেন এই ডায়েরিটি এসে পৌছায়!' বলেই আগন্তুক নী এর দিকে ডায়েরিটা মেলে ধরল।
নী এবার বেশ নড়েচড়ে বসলেন, তিনি মার্টিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে ডায়েরিটির পাতায় চোখ রাখলেন, ডায়েরী বেশ অনেক পুরনো সেটা দেখেই বুঝে ফেললেন, আশ্চর্যের ব্যাপার হল যেই সময়টাতে ডায়েরিটি লেখা হয়েছে সেই সময়ে তার জন্মই হয়নি। নী কে দেখে বুঝার উপায় নেই কত বড় একটি বিস্ময় তিনি মনের মাঝে চেপে রেখেছেন।
দুই।
শহরের কোলাহল ছেড়ে ট্রেন চলছে দ্বিপের উদ্দেশে। বিকালের নাস্তা বলতে দুজনে দুটি বার্গার মুখে গুজে নীল। মার্টিন যাবার সময় বক বক করেই চলছে কিন্তু আর্কিলোজিষ্ট নীর সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি মনে মনে বিরক্ত হচ্ছেন, পাত্তা নাদিয়ে ডায়েরিটি পড়তে শুরু করলেন।
ডায়েরীর লেখা
৩,১২,১৯২৯
দশ মাস হয়ে গেল, অবস্থার ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। কেমোথেরাপি দেবার পর চুলগুলো আসতে আসতে পড়ে গিয়েছে। আমি একজন বিজ্ঞানী হয়েও ক্যানসারে আক্রান্ত মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারছি না। মেয়েটার চেহারায় আগের সেই উচ্ছ্বাস নেই, কতইবা বয়স বড়জোর মাত্র নয়, হয়ত এতদিনে এই ছোট্র মানুষটা বুঝে গেছে হাতে আর সময় নেই। আজ সকালে আমাকে বলল বাবা আমার চুল গুলো পড়ে গেছে, চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে, আমাকে বিশ্রী লাগছে, সবাই আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকে, হাসপাতালে অনেক বাচ্চারা আমাকে দেখে ভয় পায়!বলেই থেমে যায় মেয়েটা। বাবা তুমি কি আমাকে ভয় পাও? মেয়ের এই কথার জবাব দেবার শক্তি আমার নেই। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে না এই কথা শুনলে! আমি নিজেকে সংযত করে তার ছোট গালে হাত বুলিয়ে দেই, চুল-হীন মাথায় হাত দিয়ে আদর করে কপালে চুমু খাই। মা পৃথিবীতে পৃথিবীর সবচেয়ে তুমি, তোমাকে ভয় পাব কেন।তোমার কিছুই হবে না , তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। কেমন কৃত্রিম একটি হাসি দেয়, যেন ছোট মানুষটা বুঝতে পারে এটা নিছকই সান্ত্বনা। বুকের ভিতর হু হু করে উঠে। আমি উঠে চলে যাই বাথ রুমে, আমার চোখে এত পানি থাকতে পারি আগে বুঝিনি।
সারা রাস্তা ধরে মার্টিন মাঝে মাঝে একা একাই বক বক করে যাচ্ছে, নী এর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। তিনি নিজের মনে ডায়রি পড়ে চলছে। ডায়রির পরবর্তী পাতাগুলোতে শুধু মেয়ের ক্যানসারের বিষয়ে লেখা আর একজন পিতার হাঁসফাঁসের বর্ণনা করা হয়েছে। চেখতে দেখতে ট্রেন থামল সাগর তীরে, এখন ফেরিতে উঠতে হবে। তারা দুজন ট্রেন থেকে নেমে একটি একটি রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নেয়। ফেরি ছাড়বে কিছুক্ষণ পরই। সামনে বিশাল সমুদ্র, দ্বীপটি হালকা দেখা যাচ্ছে, আশেপাশে বড় বড় গাছ, শিতের এই সময়টাতে গাছের পাতা ঝরে যায়, তুষারে সাধা বর্ণ ধারণ করেছে গাছগুলো। বাচ্চারা ফেরিতে উঠে হইচই করছে। একজন কালো কোর্ট পরিহিত লোক কিছুক্ষণ ধরে তাদের অনুসরণ করছে বুঝতে পারল নী, তবে তিনি কিছু বলছেন না। ফেরিতে উঠে আবার তিনি ডায়েরি পরায় মনোযোগ দিলেন।
ডায়েরীতে লেখা,
১,৩,১৯৩০
বেশ কয়েকটি কেমোথেরাপি দেবার পরো অবস্থার কোন উন্নতি হল না। ডাক্তার আশা ছেরে দিয়েছে। গত মাসে আমাদের রিলিজ করে দিয়েছে, বলেছে আমাদের আর কিছু করার নাই। ভাল মন্দ যা খেতে চায় তা খাওয়ান। শেষ সময়টা যতটা পারেন আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি একজন বিজ্ঞানী হয়ে এত সহজেই হার মানতে পারিনি, আমি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে করেই হোক আমার মেয়েকে আমি সুস্থ করে তুলবই তাই শহরের কোলাহল ছেড়ে এই দ্বীপে এসে বাড়ি বানিয়েছি, মানুষজন থেকে নিজেকে আড়াল করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জীবন এবং মৃত্যুর রহস্য আমি খুঁজে বের করব, আমার মেয়েকে আমি সুস্থ করব, মানুষ হয়ে ঈশ্বরের ক্ষমতা অর্জন করব। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, এটা আমি প্রমাণ করব, মানুষ একসময় আমাকে নিয়ে গর্ভ করবে। একটি কচ্ছপ যদি পাঁচশত বছর বাচতে পারে তাহলে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কেন এত কম বাঁচবে? মানুষকে আমি মৃত্যুঞ্জয়ী করব।
ডায়েরীতে লেখা,
১,৯,১৯৩০
মেয়েটার শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পরেছে, তবে আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই, মেয়েটাকে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রেখেছি, তার ছোট্র শরীরে মাকড়সার মত অসংখ্য যন্ত্রপাতি লাগিয়ে রেখেছি, মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতে পারি না ঠিকমত, গলাটা ধরে আসে, বুকে প্রবল চাপ অনুভব করি। বাহিরে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, প্রকৃতির এই সৌন্দর্য অপেক্ষা করেও আমি দিনরাত গবেষণা করে চলেছি, নিজেকে আত্মীয় বন্ধুবান্ধব থেকে আড়াল করে রেখেছি। এই নির্জন দ্বিপে আশেপাশের কবর থেকে মৃত লাশ নিয়ে আসি, কেটে কুটে পরীক্ষা করি। শিরা উপশিরা, মস্তিষ্ক সব খুলে দেখে বুঝার চেষ্টা করছি। জীবন এবং মৃত্যুর রহস্য আমাকে বেদ করতেই হবে। একটি জীবিত এবং মৃত মানুষের পার্থক্য ধরার চেষ্টা করি। আমি জানি ব্যাপারটি ঠিক হচ্ছে না তবে আমি আমার আবেগের কাছে পরাস্ত। হার্ট কিভাবে কাজ করে, জীবিত এবং মৃত মস্তিষ্ক পার্থক্য ধরার চেষ্টা করি, কম্পিউটারের সিমিউলেশোন করি বুঝার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব পিশাচ মনে হয়, যাদের কেটে দেখি মনে রাতে ওরা ফিরে আসে, আমি ঘুমাতে পারি না। কয়েকদিন ধরে কিছু খেতে পারছি না, নিজের মাঝে কেমন জানি গিনগিন একটি ব্যাপার লাগে মনে মনে, নিজেকে ধিক্কার দেই। নিজেকে কিছুদিন ধরে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, যেখানে কাজ করি সেখানেই ঘুমিয়ে পরি।
ডায়রির বাকি পাতাগুলোতে প্রায় একই রকম বর্ণনা লেখা, বিবর্ষ সেই বর্ণনা, নী পড়ার সময় মাঝে মাঝে কেপে কেপে উঠছে, আবার একজন বাবার আবেগের ছিটেফোঁটা তিনি নিজেও অনুভব করতে পারছেন। ডায়রিতে শেষের দিকে একটি ছোট করে লেখা পেলেন।
ডায়েরীতে লেখা,
৩,৯,১৯৩০
আজ বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। আমি আমার গবেষণার সফল হয়েছি। পৃথিবীর মানুষের জন্য আমার গবেষণা আজ লিখে রাখব।
আর্কিওলোজিষ্ট নী বেশ নড়েচড়ে বসলেন কারণ ডায়েরির পরের পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়া। ফেরি ততক্ষণে দ্বীপে এসে পৌঁছেছে।
'বাকি পৃষ্ঠাগুলো কোথায়?'
'স্যার আমি জানি না, কেউ হয়ত ছিড়ে ফেলেছে। কেউ হয়ত চায়নি এটা কেউ জানুক।'
নী একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, তারপর কি হল সেটা জানার জন্য তিনি কিছুটা ব্যাকুল, সেই বিজ্ঞানী কি তার মেয়েকে জীবিত করতে পেরেছিল? তার পরের পাতাটি কে ছিঁড়ল? ব্যাপারটি তার চিন্তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
'স্যার চলুন আমরা প্রায় চলে এসেছি।'
তিন।
তারা যখন মার্টিনের বাসায় পৌঁছল তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। গহীন অরণ্যে ঘেরা বাড়িটির আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই, যেখানেই চোখ যায় সেখানেই লম্বালম্বি গজারি গাছ। এমনিতেই শীত, শীতের প্রকোপে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, ঘন-কুয়াশায় চোখের দৃষ্টি খুব বেশী দূর যায় না। মাঝে মাঝে শিয়ালের হুককা হুয়ার শব্দে কানে ভেসে আসে। মার্টিন প্রকাণ্ড বাড়িটার দরজা খুললে কেরাক শব্দ হয়।
'স্যার আসুন। গরীবের বাড়িতে কিভাবে আপ্যায়ন করব বুঝতে পারছি না।' হাত কচলাতে থাকে মার্টিন।
ভিতরে ঢুকেই চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয় নী। বিশাল ড্রয়িংরুমের দেয়ালে পুরনো পেইন্টিং ঝুলছিল, চারদিকে পিনপন নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দও যেন কানে এসে জোরে বারি খায়। মার্টিন নী কে দোতলার কোনার রুমটা দেখিয়ে দেয়, দেখতে বড়সড় রুম, দক্ষিণ দিকে বড় জানালা, সেখান দিয়ে বাহিরের পরিবেশ সুন্দর দেখা যায়। বাড়িটা পুরনো হলেও তার মনে হতে থাকে এখানে কিছুদিন আগেও কেউ থাকত। নী রুমের ভিতরে বাথরুম থেকে অনেকটা সময় নিয়ে গোসল সেরে নিলেন, সারাদিনের ক্লান্তি ভাবটা আসতে আসতে মিলিয়ে গেল। বাথরুম থেকে বের হতেই দেখল মার্টিন রমেই খাবার দাবার নিয়ে এসেছে।
'তুমি একাই থাক। ভয় করে না?' মার্টিনের দিকে তাকিয়ে বললেন নী।
'একাই থাকি। প্রথম প্রথম ভয় করত তবে এখন আরে না। বাড়িটার প্রতি এক ধরনের মায়া জমে গেছে।' বেশ বিনয়ী ভাবে বলে মার্টিন।
'এই রুমটাতে কি কেউ থাকত?'
মার্টিন বেস ইতস্তত করে দুর্বল স্বরে বলল 'না স্যার।'
'মার্টিন আমার বয়স হয়েছে, আমার স্বপ্ন ছিল রিটার্ডের পর এরকম একটি নির্জন জায়গায় বাড়ি করব, সেখানে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিব, বাস্তবতা বড় কঠিন জিনিষ' দ্বির্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল নী।
মার্টিন প্রসঙ্গ পাল্টে বলল 'স্যার আমি পাশের রুমটাতেই থাকি কোন কিছুর দরকার হলে আওয়াজ দিলেই আমি চলে আসব।'
আজ দুদিন হয়ে গেল, মার্টিন সকালে চলে যায় আসে সেই রাতে, মার্টিন সকালে একটি চিঠি দিয়ে গেছে, আসতে দেরি হবে আজ। একা আর্কিওলোজিষ্ট নী এর সময়টা খুব একটা খারাপ কাটছে না, তিনি বাড়ির চারদিকটাতে ঘুরে বেড়ান, আজ সকালে তিনি বের হয়ে সমুদ্রর তীরে কিছুক্ষণ হেটে বেড়ালেন, পাখি দেখলেন, সমুদ্রর তীর থেকে দূরে বয়ে চলা মাছ ধরার নৌকার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন প্রকৃতি এর সুন্দর হতে পারে।
আজ অদ্ভুত একটি ব্যাপার লক্ষ করেছেন তিনি, মার্টিন তাকে সেই ল্যাবরেটরিটাতে দেখাচ্ছে না, তার ব্যাবহারে তিনি একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে পারলেন, তাছাড়া এই বাড়িটাতে তৃতীয় কারো অস্তিত্ব অনুভব করেছেন তিনি। তার মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব নীরবে তাকে ফলো করছে, তার কাঁধে কারো একজনের গরম নিঃশ্বাস টের পেয়েছে, পিছনে তাকাতেই মুহুত্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল, অজানা আশঙ্কায় তার বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে পুরো বাড়িটাতে ছড়িয়ে পরল।
মার্টিনের রাতে ফিরতে দেরি হওয়াতে নী লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলেন। মধ্যরাতে হঠাৎ মার্টিনের রুম থেকে এক ধরনের শব্দ পেলেন, নী চশমাটা পড়ে রুম থেকে বেরিয়ে উকি দিতে দেখলেন মার্টিন কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে সিরি বেয়ে নীচে নামছে। কে হতে পারে, নী খুব সাবধানে তাদের অনুসরণ করল। নী তাদের অনুসরণ করে বাড়িটির সেই গোপন ল্যাবরেটরিতে উপস্থিত হলেন। মার্টিনের সাথে কালো চাদরে ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি, চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তারা দুজন ফিসফিস করে কথা বলছে, নীর কি সরাসরি এখন মার্টিনের সাথে কথা বলা উচিৎ ! তার সিক্স সেন্স বলছে যে কোন একটি ঘাপলা আছে।
পরদিন মার্টিন যথারীতি খুব সকালে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। নী চলে যেতে চাইলে আবিষ্কার করল দরজা বাহির থেকে লক।
চার।
'তুমি কি আমাকে বন্ধী করেছ?' গম্বির মুখে মার্টিনের দিকে তাকিয়ে বলল।
'স্যার রাত অনেক হয়েছে , খেয়ে নিন।' এড়িয়ে গিয়ে বলল মার্টিন
'আমার কথার উত্তর দিন?'
'স্যার আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আপনি শান্ত হোন।'
'আমার বিশ্বাস আপনি সেই বিজ্ঞানী! আমার অনুমান কি ভুল?'
'হঠাৎ আপনার এটা মনে হবার কারণ কি?'
'আজ সকালে আপনি একটি চিঠি লেখে গিয়েছিলেন ফিরতে দেরি হবে।ডায়রির লেখা এবং চিঠিটার লেখার ধরন দেখি অনুমান করেছি! তাছাড়া গতকাল রাতে আমি আপনাকে অনুসরণ করেছি। আপনি আমাকে ছলনা করে এই দ্বীপে এনেছেন!'
এবার মার্টিন একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলল 'আমি আমার গবেষণায় মোটামুটি সফল হয়েছি। মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর রহস্য বের করেছি, মানুষের কাছে যেটা অধরা সেই অমরত্বের ফর্মুলা আমি জেনে ফেলেছি, যুগযুগ ধরে পৃথিবীর মানুষ যেই রহস্যের পিছনের ছুটেছে, যেই অসম্ভব কে সম্ভব করেছি, অজয়কে জয় করেছি, নিজের জীবনের সমস্ত চাওয়া পাওয়া, বন্ধুবান্ধব, সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে যেই গবেষণার পিছনে সময় দিয়েছি, আমি সেখানে সফল হয়েছি, সামান্য মানুষ হয়ে ঈশ্বরের ক্ষমতা অর্জন করেছি আর তাই হয়ত ঈশ্বর আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন' এটুকুন বলে মার্টিন থামল। আবেগে তার গলার স্বর ভারি উঠে, বুকে এক ধরনের চাপ অনুভব করেন।
আবার শুরু করলেন 'আমার গবেষণার ফলাফল আমি নিজের উপর প্রয়োগ করলাম, অল্প দিনেই নিজের উপর এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করলাম। চল্লিশার্ধ শরীর আমার আসতে আসতে বয়সের প্রভাব কমতে থাকে, আমার শরীরের বয়সের সাথে সাথে যেই সেলগুলো মারা যায় সেগুলো রোধ হয়, মস্তিষ্কের সেলগুলো ধীরে ধীরে মরে যাবার পরিবর্তে সেগুলো অপরিবর্তিত থাকে।আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। আমি আমার এই গবেষণা আমার মেয়ে উপর প্রয়োগ করি।' বলে থেমে যায় বিজ্ঞানী মার্টিন।
জিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলে 'মেয়েটা বেচে যায় কিন্তু তার ভিতর অদ্ভুত এক ধরনের সাইড ইফেক্ট দেখতে পাই। তার ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, আজ একশত বছর হয়ে গেল কিন্তু সে সেই আগের নয় বছরের শিশুই রয়ে গেল! তাতেও আমার কোন আপত্তি থাকত না, মাস ছয়েক ধরে অদ্ভুত এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম, তার ব্রেইন এবং শরীর বিকশিত হবার পরিবর্তে বয়স কমছে দ্রুত। সে আসতে আসতে ছোট হতে শুরু করেছে। আসতে আসতে শিশু হয়ে হয়ত মারা যাবে।' একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মার্টিন।
নী তাকিয়ে দেখলেন মার্টিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে।
'আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন! আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?'
'আমি আমার গবেষণা শুরু করেছি, আমি এবার জীবিত মানুষের মস্তিষ্ক কেটে, তার নিউরন, রক্তের শিরা, উপশিরা, হৃদপিন্ড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝার চেষ্টা করছি। আপনাকে নিয়ে এসেছে আমার স্যাম্পল বানানোর জন্য।'
নী এর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠে। 'আপনি এটা করতে পারেন না?' নিজের মেয়েকে বাচাতে এভাবে মানুষ হত্যা করতে পারেন না? এ বড় অন্যায়!'
'আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন নী। আমি নিরুপায়! আপনি জীবনটা দেখেছেন, পৃথিবীটা উপভোগ করেছে, আপনার এখন মরে গেলেও কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমার মেয়েটা পৃথিবীর কিছুই বুঝে না, জীবনটা বুঝার আগেই সে চলে যাক এটা আপনি চান?'
'আপনি বদ্ধ উন্মাদ, পাগল। নিজের মেয়ের জন্য একের পর এক অসামাজিক কাজ করে চলেছেন, এখন মানুষ খুন করছেন, সবারই স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার রয়েছে। এটা আপনি কেরে নিতে পারেন না!'
'বিশ্বাস করুণ আমার একাজগুলো করতে ভাল লাগে না। এমনও সময় গেছে ব্রেইনের নিউরনগুলো কেটে কুটে পরীক্ষা করা সময় মাঝে মাঝে ভয়ে কুকরে উঠি, এই বুঝি আমাকে খপ করে ধরে ফেলল, ঠিকমত খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, বাহিরে নতুন ফুল ফোটে, পাখিরা গান গায়, শীত বসন্ত আসে, আমি সেগুলো কিছু উপভোগ করতে পারি না। আমার কেবল চিন্তা হয় মেয়েকে সুস্থ করতে হবে।' বলেই আবেগে বার বার কেপে উঠে মার্টিন।
যোগ করে বলেন 'আমি যতগুলো মানুষ অপহরণ করেছি সবাই বড় নিঃসঙ্গ, একাকী বয়স্ক মানুষ!এই মানুষগুলো হয়ত আর বেশী বাঁচত না, আমারও একটি বিবেক আছে, মনুষ্যত্ব আছে, আমি সবাইকে আমার স্যাম্পল বানাই না। আমি যা কিছু করছি তা একমাত্র আমার মেয়ের জন্য।' মার্টিনের শরীর ঘামতে থাকে, চেহারায় অপরাধীর চিহ্ন ফুটে উঠে, তাকে বড্ড ক্লান্ত দেখায়।
'আপনি আপনার মেয়রের জন্য এত কিছু করছেন না! আপনি নিজের ইগোর জন্য করছেন, আপনি ভাবছেন কেউ আপনার মেয়েকে আপনার থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে, সেটা আপনি মেনে নিতে পারছেন না, এটাকে আপনি নিজের পরাজয় ভাবছেন।'
এবার মার্টিন বিশাল ধাক্কা খেল, শুকনো মুখে নী এর ধিকে তাকাল। 'এটা হতে পারে না, আমার এত পরিশ্রম শুধুই আমার মেয়ের জন্য।'
'আপনি আপনার মেয়ের জন্য করলেন তার দিকটা ভাবতেন! মেয়েকে গিনিপিগ বানিয়ে একের পর এক পরীক্ষা করতেন না, এতে আপনার মেয়ের ভাল লাগার কথা নয়। নিয়তিকে মেনে নিন, এতে সবারই মঙ্গল। গতকাল রাতে আপনার সাথে একজনকে দেখেছিলাম, সে নিশ্চয়ই আপনার মেয়ে।'
মার্টিনের চোখ ছলছল করে উঠল।
নী তার হাত দিয়ে মার্টিনের কাঁধে হাত রেখে বললেন 'দয়া করে আপনি আপনার এই পাগলামি বন্ধ করুণ।'
মার্টিন তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল।
পরিশিষ্ট- তিন বছর পর, একজন এডভোকেট এসে নীকে জানায় শহরের বাহিরে দ্বিপে একটি বাড়ি আছে। কেউ একজন সেই বাড়িটি নীকে উইল করে দিয়েছে। নী কিছু মনে করতে পারছে না, তার যতদুর মনে পড়ছে তিন বছর আগে তার সাথে একটি ঘটনা ঘটেছিল, তাকে সেই দ্বিপে অচেতন অবস্থায় মানুষজন উদ্ধার করে ডাক্তার খানায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরেছিল নীর, জ্ঞান ফিরে তিনি কিছু মনে করতে পারছিলেন না, সে সেই দ্বীপে কেন গিয়েছিল এবং কিভাবে গিয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছিল কেউ একজন তাকে ড্রাগ দিয়ে মস্তিস্কের কিছু স্মৃতি মুছে দিয়েছে। যেই লোকটি নীকে বাড়িটি উইল করে দিয়েছে তার নাকি একটি অসুস্থ মেয়ে ছিল, মেয়েটিকে বাচাতে না পেরে মাস তিনেক আগে তিনি আত্নহত্যা করেছেন। মারা যাবার আগে নীকে সেই বাড়িটি দিয়ে গেছে, সাথে একটি ছোট চিঠি।
চিঠিতে চোখ বুলাতেই দেখলেন 'স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।আমার কথা আপনার স্মৃতিতে নেই জানি, তারপরও বলি আমি আপনার কথা রেখেছি। যাইহোক আপনার স্বপ্ন ছিল একটি বাড়ি বানাবেন নির্জন কোন জায়গায়, জীবনের বাকিটা সময় কাটাবেন সেখানে, আশা করি আপনার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।'
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:২১