ধর্মই তো। মানুষের তৈরি বিশ্বাস, আচার, সংস্কৃতি। মানুষ মানুষের জন্যই ধর্ম তৈরি করবে, বিশ্বাস করবে, পালন করবে। এই তো ধর্ম। মানুষের জন্য মানুষই যে ধর্ম তৈরি করে, সেটাতে ভুল-ত্রুটি থাকলে পরবর্তী সংস্করণে সেটা শোধরানোর সুযোগও থাকে। ধর্ম নিয়ে কারো বাড়তি সুবিধা আদায়ের অভিসন্ধি থাকলে অভিযোগে বলা হয়,
"ওমুক (শত্রু পক্ষ) ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করছে।
অর্থাৎ বক্তার কাছে ধর্মের একটা সঠিক ব্যাখ্যা আছে। সে অনুসারেই তিনি ধর্মের কথা নিজের মত করে মানতে চান, বুঝতে চান। মানুষের কাছে ধর্মের এই পরিবর্তনশীল রূপের চাহিদা, পরিবর্তন করে যুগের সাথে মানিয়ে আপোস করে চলার শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ১৫০০ বছরের পুরনো সনাতন সংস্কার আকড়ে রাখা বা পালনে মাঝে শিথিলতা খোজার প্রয়োজন পড়ে। মানুষের জন্য ধর্ম মানুষেরই আবিষ্কার । তাই মানুষের প্রস্তাবিত নীতিকথা, ঈশ্বর সংক্রান্ত বিশ্বাসগুলো বিজ্ঞানের মতই শনৈ শনৈ বদলাবে, মানুষের চাহিদামত আধুনিক হবে --এটাই একালের গ্রহণযোগ্য ধর্মের মর্মকথা।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি পোপের কথা। নাস্তিকেরাও তবে স্বর্গে যাবেন। অদ্ভুত শান্তি শান্তি ভাব হয়। অন্তত মানুষের তৈরি বিশ্বাসের যৌক্তকতা নিয়ে বিজ্ঞানের অস্ত্র হাতে বোকা সোকা ধার্মিকদের উপর নাস্তিকেরা কলম নিয়ে চড়াও হবেন না--সে আশ্বাসটা পেলে পোপের বাণীর কার্যকারীতা বুঝা যেত।
ধরুন শফি হুজুরের কথাই । রাজনীতির মত অপবিত্র বিষয়াদি নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় লোকেরাই তার বহু আগের তেতুল সমাচার নতুন করে প্রচার করলো। তেতুল নিজেই হয়ে গেল রাজনৈতিক হাতিয়ার। কখনও বা সরকারের পক্ষ হয়ে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার যৌক্তিক শব্দ। অথচ হুজুরকূলের 'তেতুল' জাতীয় শব্দের ব্যবহার বহু পুরনো ও বহুল চর্চিত। দেশের সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষ ধর্ম সংক্রান্ত জলসায় বসেননা, বা আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে স্যুটেড-বুটেড জাকির নায়েকের ইসলামের বিজ্ঞানীকরণ গোছের 'জ্ঞানদীপ্ত' কথাবার্তা শুনেই তৃপ্ত থাকেন। কাজেই আর্দশের যুদ্ধে আলাদাভাবে শফির তেতুলের বয়ান শিক্ষিত পরিমন্ডলে প্রচার ও প্রসার করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
ঘটনাচক্রে শাহরিয়ার কবীর আমাদের জানান শফি ৭১ এ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে হিন্দুদের ঘর বাড়ি জালিয়েছেন। অর্থাৎ শাপলা চত্ত্বরের মত বির্তকিত জায়গায় অবস্থান নেবার আগে তেতুল শফির পরিচয় জানা বা চরিত্র প্রকাশ করার কোন প্রয়োজনীয়তা ছিলনা।আজাদ রাজাকার যদি টিভিতে ধর্ম ব্যবসা করতে না আসতো--তবে বেইমানদের জনস্রোতে ৭১ এর সেই কুখ্যাত বাচ্চু রাজাকারকে খুঁজে পেত বাংলার মানুষ? ৭১ এর অজ্ঞাত-অরাজনৈতিক দিল্ল্যা রাজাকার যদি আজ ওয়াজের নামে ধর্ম ব্যবসা বা রাজনীতির নামে জামাত না করতো--কেউ কি তার বিচার/ফাঁসি/মেশিন ম্যান হবার মচ্ছবে নামতো?
অন্তত জুম্মার নামাযের কল্যাণে যেসব মডারেট পন্থী ধার্মিক সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও চার্চে যান --তারা কাদের পিছনে নামায পড়ে ধর্ম করার তৃপ্তি নেন? খোঁজ নিলে অবাক হবেন শোলাকিয়ার মাওলানা মাসউদের মত
'আসল'. 'সঠিক' আলেম দেশে অতি নগন্যই। আপনি যার পিছে নামায পড়েন হয়তো তিনি আমিনীপন্থী অথবা হাটহাজারি শফি পন্থী। হয়ত চক্ষু লজ্জার ভয়ে আমরা মসজিদে প্রতিবাদ না করে, নামায পড়েই চলে আসি। তারপর ব্লগে বসে তুবড়ি ছুটাই,
'তেতুল শফি একটা মোনাফেক, ইসলামের ভীষণ ক্ষতি করছে ! পরকালে মোনাফেকের শাস্তি কাফেরের চেয়েও বেশি।'
কথিত শান্তির ধর্ম ইসলামে শুনতাম যাকে, তাকে কাফের, মুনাফেক বলা মানা। খোদ প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও আহমেদীয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানিত্ব বিষয়ে বলেন, কে মুসলিম, কে অমুসলিম আল্লাহ নির্ধারণ করবেন, বিচার করবেন। অথচ আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি শফি ইসলামের ক্ষতি করছেন। ইসলামকে অপরাপর ধর্মের মত যুগ উপযোগী করার যে ধারা, মানব কল্যাণে সেকেলে ধ্যান ধারণা বর্জনের যে সুমহান প্রয়োজন--- সেটাকে অবজ্ঞা করলে ধর্মেরই ক্ষতি হয়। অন্তত আপনার ধর্ম অন্য ধর্মের চেয়ে ভাল, উদার, আধুনিক, প্রগতিশীল এটা প্রমাণ করাটা খুব বেশি জরুরি হয়ে দাড়ায়।
বোমা, সন্ত্রাসের কারণে নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে প্রচন্ড আত্মগ্লানিতে ভুগে মুসলমানরা। তাদের ভীষণ ব্যর্থ ও হাস্যকরভাবে দিনরাত জপ করে যেতে হয়,
'ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম।ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম।.......ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম।'
অথবা
"ওমুক ইসলাম আসল ইসলাম না।" অথবা "ধর্মের নামে জবাই করা ইসলাম সমর্থন করেনা।"
এক একজন ইসলামের সেবাদাস --ইসলামের ক্ষতি, ইসলামের ভাবমূর্তি নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত। কিন্তু কার/কাদের কাছে? কার কাছে জবাবদিহিতা? অবশ্যই অমুসলিমদের কাছে দায়বদ্ধ! যাদের কাছে শান্তির ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বিকানো যায়, ততই মঙ্গল। ক্ষতিটা ইসলামের হয না মানুষের--সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। ধর্মের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ধর্মের স্রষ্টাই যথেষ্ট। ধর্ম নিয়ে মানুষ বাড়াবাড়ি, ব্যবসা করলে বা মৌলবাদী হয়ে গেলে, নবীকে নিয়ে কার্টুন আঁকলে ---তাতে আল্লাহ বা তার ইসলামের কোন লাভ-ক্ষতি হয় বলে মনে হয়না।
আমার মনে হয় ধর্ম প্রসঙ্গে সবা্রই সরল স্বরূপে আসাটা জরুরি। আপনি যদি দেখেন শফি পন্থী, জামাত পন্থী, আমিনী পন্থী হুজুর মসজিদে নামায পড়াচ্ছেন--না যাওয়াই উত্তম । আপনার ব্যক্তিধর্ম আপনি শান্তির আগরবাতি জালিয়ে বাসায় করুন--কেউ বাধা দিবেনা।
শফিদের ব্যর্থতার কারণ, তারা পোপের মত উদার হতে পারেননি। অথবা ইসলামের কথিত ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য যে আধুনিকতা, আপোস, পরিবর্তনশীল মানসিকতার দরকার ছিল --তার কোনটাই নেই। সে অর্থে মুসলিমদের নবী বেশ আধুনিক ছিলেন। কোনঠাসা আর আত্মগ্লানিতে থাকা মডারেট ধার্মিকেরা বেশ সতর্কভাবে শফিকে মোনাফেক প্রমাণের জন্য নবীর সমকালীন ইতিহাসের দারস্থ হবে। তারা নিজেরাও জানেন কোরআন-হাদীসে তেতুলের চাইতেও গুরুতর কথা আছে, যেগুলো এড়িয়ে যেতে চান, অথবা সেগুলোকে মৌনভাবে প্রত্যাখ্যান করে শাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি-আগরবাতি-জিলাপি-আতর-মিলাদ গোছের উপাসনা সর্বস্ব ধর্মাচার নিয়ে শান্তিতে থাকতে চান।
ধর্ম থাকবে মানুষের মনে ও মন্দিরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বাড়াবাড়ি আর সবকিছু নিয়ে করা যায় --ধর্ম নিয়ে নয়। ধর্ম খুব পবিত্র স্পর্শকাতর জিনিস, সফেদ কাপড়ে মুড়িয়ে চন্দন, গোলাপজল মাখিয়ে উচু স্থানে যত্ন করে তুলে রাখার জিনিস। এতে করে রক্তপাত, বোমাবাজি, সাম্প্রদায়িকতা কম হয়---মানুষ শান্তিতে থাকে।
ইসলামকে প্রকৃত শান্তির ধর্ম হতে হলে বাকিসব ধর্মের মতই আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব-সামাজিকতা-উপাসনার মতই কিছু একটা হতে হবে।সঙ্গীত, শিল্প, ভাষ্কর্যকে ভালবাসতে হবে। ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞার মাঝে ঢুকে গেলে নবীকে নিয়ে কেউ কুৎসা রটাবেনা, মডারেট মুসলিমরা তাদের ধর্ম নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগবেনা, 'প্রকৃত ইসলাম', ভুল ব্যাখ্যা, জবাই/বোমা সমর্থন করেনা করেনা বলে ভাবমূর্তি উদ্ধারের প্রয়োজনও পড়বেনা।
সেটার জন্য ধর্মকে মানুষের সৃষ্টি জেনে মানুষকেই অধিকার নিয়ে ধর্ম বাণী গুলো বদলাতে হবে, যেমনটা প্রস্তাব করেছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী,
"আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয় ইসলাম ধর্মের একটা যুগোপযোগী পরিবর্তন দরকার।"
ইহুদি-নাসারারা তাদের ধর্মকে পছন্দমত ম্যানিপুলেট করে সামনে এগিয়ে গেছে, মুসলমানরা কেন বেহেশতের লোভে-দোজখের ভয়ে পশ্চাদপদ হয়ে থাকবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৭:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




