এটা হতে পারে বেশ কঠিন প্রশ্ন । যারা যুক্তরাষ্ট্র-ক্যানাডাতে ডিগ্রি নিচ্ছেন তারা ভাল বুঝবেন। দেশে বসে এটা বুঝতে পারা কঠিন।
দেশের মানুষ দেখবে জাপান-কোরিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াতে ৩ বছরে পি এইচ ডি হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ক্যানাডাতে লাগছে ৭ বছর। আত্মীয়-নিকটজনের কাছে প্রশ্নে সম্মুখীনও হতে হয় অনেককে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে কোথাও কোথাও দেখবেন ২ বছর ৭ মাসে পি এইচ ডি করে ফেলার রেকর্ডও আছে।
অনেকগুলো কারণ নির্ভর করে, যেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
১. মোটিভেশন। পি এইচ ডির জন্য আহামরি মাথা লাগেনা। মেধার চাইতে দরকার প্রবল ধৈর্য ও চোখ-কান বন্ধ করে কাজকে ভালোবেসে কাজ করে যাবার যোগ্যতা। মাস্টার্স করে লাখ ডলার কামানো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাপিত্যেশ করাদের জন্য এটা কঠিন কাজ। সোজা অর্থে লাগবে প্রবল মোটিভেশন। মোটিভেশন হারিয়ে চাকুরি খুজতে গেলে, দীর্ঘ হবে।
২. সুপারভাইজার হলো বউ বা গার্ল ফেন্ডের মত। ঝগড়া-তর্ক এটা না হলে বুঝবেন আপনি ঠিক মত এগোচ্ছেন না, অথবা অধ্যাপক আপনাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন, পাত্তা দিচ্ছেননা। অধ্যাপকের অভিরুচির উপর ৫০ ভাগ নির্ভর করে আপনি কবে ডিগ্রি পাবেন। অধ্যাপক বিভিন্ন রকমের হয়
--> তরুণ সহকারী অধ্যাপক, হাতে গণা ছাত্র । প্রবলভাবে চাইবে ছাত্রদের খাটিয়ে রস চিপে যত পারা যায় তুলে নিতে, কারণ নিজের টেনিউরশিপ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বলে ডিগ্রি দেবার ব্যাপারে প্রবল খুতখুতে থাকে, সবকিছু খুটিনাটি নিখুত রাখতে চায়। একটা ছাত্র কতটুকু করলে ডিগ্রি হবে সেটা নিয়ে একটা সংশয় থাকে। এদের ভাল দিক হলো ছাত্রের পাশাপাশি খাটবে, কাজে হাত দিবে। ভাল ছাত্র পেলে আর কথাই নেই, তার এবিডি হওয়া ঠেকিয়ে দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করবে প্রবলভাবে। নতুন ছাত্রকে গড়ে তুলতে যথেষ্ট সময় ও ধৈর্য দিতে হয়।
--> বুড়ো অধ্যাপক: এরা গবেষণার চাইতে ম্যানেজার বা এডমিন জবে সময় দেন বেশি। জীবনে অনেক গবেষণা হলো আর কত? ডিপার্টমেন্টে ভাল প্রভাব প্রতিপত্তি থাকে বলে এবং নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে সহজে ছাত্রের কাজের পরিধি নির্ধারণ ও নিশ্চিত করে দিতে পারে। ডিফেন্স কমিটি সদস্যদের উপর ভাল প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু গবেষণার কাজে ছাত্রদের একদম সময় দিবেনা। কাজের অগ্রগতি বিষয়ে ১০ হাজার ফুট উপরের ভিউ নিয়ে কথা বলবে। আর আপনি যদি বুড়োর একমাত্র ছাত্র হন, তাহলে কথাই নেই। পিতৃস্নেহে দেখবে আপনাকে, চাকুরি পাইয়ে দিবে, তাড়াতাড়ি পাশও করিয়ে দিবে।
আবার অনেক বুড়ো অধ্যাপক স্টেট-অব-দি-আর্টকে বিট করে ৫ টা ভালো পাব্লিকেশন ছাড়া ডিগ্রি দিবেনা এমন দাবি করে থাকে। আবার অনেক অধ্যাপক ছাত্র বের করা নিয়ে ব্যস্ত বিধায়--দুটো কনফারেন্সের উপরেই পি এইচ ডি দিয়ে দিতে পারেন ৩.৫ বছরেই। ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের কাজ গুলো জটিল-দুরহ-সময়সাপেক্ষ বিধায়--এই এলাকাতের এটা দেখা যায়।
৩. আপনার গবেষণার টপিক । যারা তাত্ত্বিক গবেষণা করেন, গণিত, পদার্থ, তাদের পাব্লিকেশ যেমন কম হয়, ডিগ্রি অর্জন প্রক্রিয়া হতে পারে আরো দীর্ঘায়িত। যারা ব্যবহারিক, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেন, তাদের তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করতে যা সময় লাগে, পাবলিকেশন হয় ধুমধাম। বায়োলজিক্যাল গবেষণায় বাংলাদেশের ৬৪ টা জেলার ৬৪ টা স্পেসিমেন নিয়ে ৬৪ টা পেপার করতে পারেন, যদি ফান্ড পান। কম্পিউটার সায়েন্সে দেখবেন যারা সফটওয়ার ভিত্তিক গবেষণা করেন ৩ বছরে কাজ শেষ, কিন্তু ম্যাথ ভিত্তিক এলগোরিদম নিয়ে গবেষণা করতে ৫-৬ বছর লেগে যাওয়া স্বাভাবিক।
৪. টপিকের সাথে আপনার পূর্ব পরিচিতি
যার আন্ডারে মাস্টার্স করলেন তার আন্ডারেই পি এইচ ডি করলে ৩ বছরেই সম্ভব । অর্থাৎ একই গবেষণাগারে হলে মাস্টার্স-পি এইচ ডি বাবদ
৫ বছর, স্বাভাবিক। কিন্তু এক দেশে মাস্টার্স করে যদি আবার নতুন কোন টপিকে, নতুন দেশে, নতুন বসের কাছে পি এইচ ডি করেন, সেটা সর্ব সাকুল্যে মাস্টার্স-পি এইচ ডি বাবদ ৬-৭ বছর নিবেই। মানুষ ঝামেলা এড়াতে তাই মাস্টার্সের জায়গাতেই পি এইচ ডি করতে বসে যায়।
বাংলাদেশে যে ধরনের গবেষণা হয়, পশ্চিমে তা এতটাই ভিন্ন হতে পারে যে আপনি তার নাম শুনেননি কোনদিন। ব্যাকগ্রাউন্ড বিল্ড করতে তখন সময় লাগে ১-২ বছর। ভাগ্য ভাল থাকলে দেখা যাবে আপনি বাংলাদেশে যে বিষয়ে কাজ করছেন, হুবহু সেই বিষয়ে আমেরিকার একজন অধ্যাপক কাজ করছেন, একই জায়গায় পাবলিশ হচ্ছে । সেক্ষেত্রে ৩ বছরেই পি এইচ ডি সম্ভব।
৫. আগের ছাত্রের করে যাওয়া চালু কাজ টেনে নেয়া
আগের ছাত্রের করে যাওয়া কাজ যদি ভাল রপ্ত করতে পারেন (কারণ সব রসদ হাতের কাছেই পাচ্ছেন, সেই ছাত্রের ফোন নম্বরসহ), খুব সহজেই গবেষণার নতুন ইস্যু বের করে (সুপারের অভিজ্ঞতা আপনাকে সাহায্য করবে অনেক), শেষ করা যাবে। কিন্তু যদি এমন ফিল্ডে কাজ করতে বসেন, যেটা আপনার অধ্যাপক কোন দিন করেননি, ল্যাবেও করা হয়নি, শূণ্য থেকে নিজে পড়ে পড়ে দাড় করাতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। আপনার দাড় করিয়ে যাওয়া সেটাপের সুফল পাবে আপনার ল্যাবের পরবর্তী প্রজন্ম। সেটা দিয়ে ফান্ড তুলবে আপনার সুপারভাইজার ।
৬. দেশ।
সম্পূর্ণ সম্মান রেখেই বলি : আমেরিকা-ক্যানাডা বনাম জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মাঝে যথেষ্ঠ তফাৎ আছে।
আমেরিকা-ক্যানাডাতে মাস্টার্স করে আসা একজনের পি এইচ ডি পেতে কম-বেশি এই বাড়তি কাঠ খড় পুড়াতে হয়, যেটা অন্য দেশে হয়না।
--> ৪ ঘন্টার তাত্তীক পরীক্ষায় যাচাই করা হবে আপনার আন্ডার গ্রাডের ভিত্তি কত মজবুত। পাশ মার্ক ৬০%. ২য় বার ফেল করলে বাড়ি ফিরে যান।
--> ১০ টা গবেষণার উপাদান সমৃদ্ধ গ্রাজুয়েট লেভেল এর কোর্স। ৩০ ক্রেডিট। জি পি এ তিনের নিচে গেলে বাড়ি ফিরে যান।
--> হতে পারে দুটো অতি সাম্প্রতিক জার্নালের কাজ কপি করে তার ভাল-মন্দ বিশ্লেষণ করতে হবে আপনার থিসিস কমিটির সামনে। পাশ/ফেল।
--> প্রোপোজাল ডিফেন্স। এটা সবাই দেয়। ২ ঘন্টার মামলা হতে পারে।
--> চূড়ান্ত ডিফেন্স।
তারপরেও কেউ যদি বলে ওমুক তো ৩ বছরে অস্ট্রেলিয়া থেকে পি এইচ ডি করে ফেলেছে, কী বলবেন? ৭ বছরে পি এইচ ডি করা লোকজন হয়তো পার্ট টাইম জব করে টাকা কামিয়েছেন, অথবা এত পাব্লিকেশ করেছেন যে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছেন। ব্যতিক্রম আছে।
মনে রাখবেন পরিশ্রম বৃথা যাবেনা, আপনার অভিজ্ঞতা, শ্রম ও সময় একদিন কাজে লাগবেই। ৩ বছরে ঝটপট পিএইচ ডি করা আর ৬ বছর গাধার খাটুনি করে করার মাঝে অর্জনের ফারাক থাকবেই। কষ্ট করলে, কেষ্ট মিলে --কথাটা মনে হয় ভুল না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




