somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিশন সিক্সটি ফোর: কুড়িগ্রাম, ২০১৪

২৭ শে মে, ২০১৫ রাত ১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চাকরি, সংসার, অন্যান্য ব্যস্ততা সব মিলিয়ে আমাদের মিশন সিক্সটি ফোর আজ মৃতপ্রায়। দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে বেড়ানোর যেই লক্ষ্য নিয়ে বছর তিনেক আগে আমরা মিশন শুরু করেছিলাম আজ তা মাঝপথেই পথ হারাচ্ছে। শুধু ২০১৪ তেই আমাদের কমপক্ষে পাঁচটা পরিকল্পনা শেষ মুহুর্তে ভেস্তে গেছে নানান কারনে। তাই গত ২৫, ২৬, ২৭ তিনদিনের ছুটিতে এক ধণুক ভাঙা পণ করেছিলাম। কেউ না যায় তো একাই যাবো—ধনুক ভাঙুক আর অটুট থাকুক। শেষ পর্যন্ত একা যেতে হয়নি। ঢাকা থেকে আমি, সোহাগ আর দিপু যাত্রা করেছিলাম আর বগুড়া থেকে যোগ দিয়েছে জিয়া। তাই হোক, তাও এ জীবনেএকদিন পা রাখি ৬৪ তম জেলায়।

ছুটি ৩ দিনের, কিন্তু সূচী বেশ দীর্ঘ। এক ঢিলে এক পাখি তো নয়ই, এক ঢিলে দুই পাখিতেও আর কাজ হচ্ছেনা আজকাল। আমাদের ঢিলে-ঢিলিই আজকাল এত আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে যে এ জীবনেকখনো ৬৪ পাখি শিকার করা হবে কিনা কে জানে। তাই এবার আমাদের এক ঢিলে যত পাখি পারা যায় শিকারের একটা চেষ্টা। ঢাকা থেকে লালমনিরহাট। মাঝে কুড়িগ্রাম-নীলফামারি কিছু ঘুরে শনিবার রংপুর থেকে ঢাকার বাস ধরবো।

বছর দুয়েকআগেও আমি আর সোহাগ একবার লালমনিরহাটের টিকেট কেটেছিলাম। রাত দশটার ট্রেন রাত দেড়টাতেও এসে না পৌছানোয় শেষ পর্যন্ত এক ’দরিদ্র ও মেধবী ছাত্র’কে আমাদের টিকেট দুটি উপহার দিয়ে আমরা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। দরিদ্র এবং মেধাবী ছাত্রটি টিকেট না কেটেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে যাবার এক দু:সাধ্য পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। শেষ পর্যন্ত সে হয়তো চাইলে শুয়ে বসেই গিয়েছে। সেবার আমরা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম কারণ ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছাড়ার পর লালমনির হাট নামেিয় দিতে নাকি ১২ ঘন্টার বেশীও সময় নিতে পারে। শুক্রবার পরন্ত দুপুরে লালমনিরহার পৌছেই আবার পর দিনই ঢাকা রওনা হতে হতো। তাই ওই রনভঙ্গ। জিয়া ওদিকে বগুড়ার সান্তাহার স্টেশনে আমাদের অপেক্ষায় সারারাত মশার কামড় খেয়ে সকাল বেলা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়েছিল।

এবারও দশটার ট্রেন রাত দুইটায় ছাড়বে এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই কমলাপুর গিয়েছিলাম। তবে এবার ভালো দিক যা ছিল তা হলো আমাদের হাতে ৩ দিন সময়। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি। ট্রেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাদের লালমনিরহাট পৌছে দিলেও আমাদের হাতে ২ দিন সময় থাকবে।

এবার আমাদের হাতে সময় আছে বলেই হয়তো ট্রেনও ঠিকসময়েই আমাদের নিয়ে কমলাপুর ত্যাগ করলো।

আমাদের টিকেট কাটা ছিল লালমনিরহাট পর্যন্ত। শীতকালে লালমনিরহাটে শুনেছি হিমালয়ের হিম পাওয়া যায়। শ্রীকান্তের নতুনদা’র মতন উত্তরের শীতের বিপক্ষে সতর্কতার কোন কমতি ছিলনা আমাদেরও। গায়ের সোয়েটার, পায়ের মোজা তো আছেই এমনকি হাতের মোজা আর মাথার সোয়েটার, মাফলারের ব্যাবস্থাও করলাম।

সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য না থাকায় যেখানে রাত সেখানেই কাত হবার একটা সুযোগ আমাদের সবসমই থাকে। কুয়াশার চাদরের ভেতর থেকে ভোরের আলো যখন উকিঝুকি মারা শুরু করেছে ঠিক তখন মনে হলো আর ট্রেনে বসে থাকা নয়। কুড়িগ্রামেই আগে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগ কাধে ফেলে ট্রেন থেকে নেমে গেলাম তিসতা স্টেশনেই। ট্রেনেই উত্তরের শীত টের পাওয়া যাচ্ছিল। তবে ট্রেন থেকে নেমে টের পেলাম উত্তরের শীত কী জিনিস। এতক্ষণ যা টের পেয়েছি তা আসল শীতের কাছে নস্যি, ট্রেনের ভিতর ঢাকার শীত মিশে তা হালকা হয়েছিল।


হাড় কাপানো শীতে তিসতায় কোন মতে নাস্তা সেরে আমরা রওনা দিলাম কুড়িগ্রামের দিকে। অটোরিক্সায় বাস স্টপেজ, স্টপেজ থেকে বাসে এক ঘন্টার মত পথ। সেখান থেকে আবার অটোতে চেপে চিলমারির বন্দর পর্যন্ত যেয়ে থামলাম। চিলমারির বন্দর নিয়ে আমার ধারনা ছিল ধূলো ওড়া কোন মেঠো পথের মতো ব্যাপার যার শেষে বড় কোন হাট-বাজার কিছু থাকবে। যেই পথ বেয়ে গাড়িয়াল ভাই উজান যায়, আসে। কিন্তু চিলমারির বন্দরে যেয়ে দেখলাম এক নৌ-বন্দর--ঘাটে বাধা সারি সারি নৌকা। গাড়িয়াল ভাই আর গাড়ির বদলে মাঝি আর নৌকা। আর একটা অভূতপূর্ব জিনিস দেখলাম--আওয়ামী লীগ আর বিএনপি’র এক অপূর্ব সহবস্থান। সারি সারি মালবাহি নৌকা আর তাতে বোঝাই বস্তা বস্তা ধান! মালামাল পরিবহনের জন্য ইঞ্জিনের বড় বড় নৌকা, সারি সারি মাছ ধরার নৌকা, এনজিও আর পুলিশের কিছ স্পিড বোট। এই চিলমারিই গাড়িয়াল ভাই এর সেই চিলমারি কিনা কে জানে।

বন্দরের ঘাটের নদীতে পানি কম। শীতের দুপুরেও তাতেই বাচ্চা-কাচ্চার দাপাদাপি। ঘাটের অদূরেই মাঝে মাঝেই চর পড়েছে। হঠাৎ ইচ্ছে হলো কোমড় বা গলাপানি পেড়িয়ে সেই চরে গিয়ে উঠি। নৌকার খোঁজ খবর করতে করতে জানলাম মালবাহী নৌকার গন্তব্য রৌমারী পর্যন্ত। রৌমারী যেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই ওই পথ বাদ দিলাম। আশ-পাশের গ্রামে যাওয়া আসা করে কিছু নাও। ছাড়ি ছাড়ি করছিল দেখে তারই একটাতে আমরা চড়ে বসলাম। কোথায় যায়, কেন যায় নাইবা জানলাম। একেবারে যাতে হারিয়ে না যাই সে ব্যবস্থাও অবশ্য করলাম--আমাদের হাতে একটা পানির বোতল ছিল; পানি টুকু শেষ করে তাতে তিন জনের তিনটি ভিজিটিং কার্ড ভরে বোতলের মুখ বন্ধ করে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিলাম। কোন দিন যদি কেউ সেই বোতল কুড়িয়ে পেয়ে এই অভিযাত্রীদের কথা জানতে পারে!


শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র ধরে ইঞ্জিনের নৌকাটি মিনিট বিশেকে ওপারের বজরাদিয়ারখাতা নামের একটা গ্রামে গিয়ে পৌছাল। যাত্রীরা ঘাট পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে যার যার গন্তব্যে চলে গেল। আমাদের কোন গন্তব্য নেই। আমরা ঘাটের পাশে, মাঠের পাশে চড়ে বেড়ানো ছাগল আর ভেড়ার সাথে ছবি তুলে সময় কাটিয়ে দিলাম।

ঘন্টা খানেক পরে পাটকাঠি বোঝাই আরেকটা নৌকা চিরমারী ফিরছিল দেখে তাতে চেপে আমরা আবার ফিরলাম চিলমারি। পড়ন্ত বিকেলে ঘাটে নেমেই সেরে নিলাম দুপুরের খাবার--নদীর বাঘারমাছ, চিংড়িমাছ, নাম না আরও কী কী মাছ যেন। আহা।

খাবার পর্ব সেরেই আবার দৌড়। অটোতে কুড়িগ্রাম শহর। সেখান থেকে বাসে লালমনিরহাট শহর। জিয়া বগুড়া থেকে লালমনিরহাটেই এসে বসেছিল। ওকে সাথে নিয়ে চারজন কালীগঞ্জ রওনা দিলাম। কালিগঞ্জে রাজু ভাই থাকেন। একমাত্র খালাত ভাই চাকরিসূত্রে বগুড়া থেকে বছর দশেক আগে এই বিদেশ বিভূইএ এসেছিলেন। পরবর্তীতে বিয়ে থা করে একরকম স্থায়ী নিবাসীই হয়ে গেছেন। তার ওখানেই আমাদের প্রথম রাতের যাত্রাবিরতী।

খালাত ভাইএর বাসায় পৌছাতে পৌছাতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। এমনিতেই শহর থেকে দূরে তার উপর প্রচন্ড শীতের রাত। রাত দশটা মানে অনেক রাত। আমাগীকালও আামদের আছে বিশাল ভ্রমণ পরিকল্পনা। রাতে খেয়ে দেয়ে একটু পাশের ঐতিহাসিক তুষভান্ডার রেলস্টেশনে হাটাহাটির শখ ছিল, কিন্তু ক্লান্ত শরীরের কাছে মনের চাওয়া হার মানল। খেয়ে দেয়েই বিছানায় চলে গেলাম। প্রায় চল্লিশ ঘন্টা পর বিছানায় গা এলিয়ে দেবার সুযোগ, তাও আবার এমন শীতের রাতে লেপে ঢাকা তৈরী বিছানা--কে হায় লেপ-বিছানা ফেলে রেল স্টেশনে ঘুড়ে বেড়াতে ভালোবাসে? ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনলাম গাছের পাতায় জমা শিশির ফোটায় ফোটায় টিপ টিপ পড়ছে টিনের চালে।

***

২৪.১২.১৪ - ২৫.১২.১৪
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:১৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×