আমার চোখে একটা জন্মগত সমস্যা আছে, ডাক্তাররা যেটাকে বলেন "কনজেনিটাল ক্যাটারার্ক্ট" বা জন্মগত ছানি। এটা ঠিক বুড়ো বয়সের ছানির মতো না। মায়ের পেটে থাকার সময় হয়তো কোন কারণে চোখের ফর্মেশনটা ঠিকমতো হয় নাই। আর তাই এই অবস্থা। খূব ছোট বেলাতেই এটা ধরা পড়েছিল, ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি সেই তখন থেকেই। প্রায় সব ডাক্তারই পরামর্শ দিয়েছিলেন অপারেশন করার জন্য একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ড. আলিম চৌধূরী।
১৯৭০ সালের শেষ অথবা ১৯৭১ সালে শুরু। আব্বা তখন ঢাকা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট এ কর্মরত। বাসার কারো অসূখ হলে যান ফার্মগেটে ড. ওমর এর কাছে। সদালাপী ড. ওমর একদিন আমার চোখের অবস্থা শুনে আব্বাকে বললেন ড. আলিম চৌধূরীর কথা। তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ড. চৌধূরী। ড. ওমর নিজেই ফোন করে ড. চৌধূরীকে আমার কথা বলেন এবং এপয়েন্টমেন্ট করে দেন। কিন্তু সেদিন তিনি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে মনে করে ঠিকই তিনি চেম্বারে বলে রেখেছিলেন আব্বার কথা। আব্বা যেতেই চেম্বারের কর্মচারীটি ফোন করে ডাক্তার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ডাক্তার সাহেব আব্বাকে অনূরোধ করেন তার বাসায় যাওয়ার জন্য। আব্বা সাথে করে অন্যান্য ডাক্তারদের যে সব রিপোট নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো দেখার পর ড. চৌধূরী নাকি বলেছিলেন - আপনার ছেলের যে সমস্যা তার একমাত্র ট্রিটমেন্ট অপারেশন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সমস্যা হলো অপারেশন করলে দেখা যায় ৫০% ভাল হয় আর ৫০% ভাল হয় না। কোন ডাক্তারই কিন্তু বলতে পারবে না অপারেশন হলে আপনার ছেলে কোন ৫০% এর দলে পড়বে। আব্বা তাকে তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন তার তাহলে করণীয় কি। ডাক্তার সাহেব তখন বলেছিলেন - আপনার ছেলে তো চলতে-ফিরতে পারছে, খেলাধূলা করছে। তাহলে আপারেশন করার চিন্তা মাথাতেই নিয়েন না। বয়সের সাথে সমস্যা বাড়তে পারে। যখন দেখবেন এই চোখ নিয়ে ওর চলতে ফিরতে খুব সমস্যা হচ্ছে, তখন অপারেশন করেন না হয়। ভাল হলে ভাল, না হলে হারানোর কিছু থাকবে না।
এরপর .... । ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। বিজয় যখন একেবারে দোরগোড়ায় ঠিক সে সময়েই তারই বাসার ভাড়াটিয়া মওলানা মান্নানের ষড়যন্ত্রে রাজাকাররা অপহরণ করে নিয়ে যায় তাকে। হয়ে যান শহীদ।
আমার কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। যেমন হয়নি আমার চোখের চিকিৎসাও। বলা যেতে পারে চিকিৎসা করিনি। আব্বা আর বড় চাচা এরপর আমাকে আরো বহু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছেন, সবারই এক কথা আসেন অপারেশন করে দেখি। ভাল হবে কিনা এটা নিয়ে কারও তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। অপারেশন হলে বেশ কিছু টাকা তারা পাবেন, আমার ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটা কি। এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার তো চ্যালেন্জ করে বলেছিলেন তার ঔষধ ঠিকমতো খেলে নাকি ছানি আপনা আপনি গলে যাবে। ভাগ্যিস তার ঔষধ ঠিকমতো খাইনি, খেলে হয়তো পূরো চোখটাই গলে যেতো। চাকরির সুবাদে পরিচিত এক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কাম প্রথিতযষা চক্ষু বিশেষজ্ঞকে বড় চাচা আমার কথা বলে পরামর্শ চেয়েছিলেন। ভদ্রলোক খূব আন্তরিকতার সাথেই বলেছিলেন দরকার হলে তিনি নিজের হাতেই অপারেশন করবেন। অথচ তার নিজের মেয়েরও নাকি একই সমস্যা। তার মেয়ে বাংলাদেশের কোন ডাক্তারকেই নাকি ঠিক উপযুক্ত মনে করে না, তাই অপারেশন হচ্ছিলো না।
এইসব ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটির মধ্যে আব্বা কেবল স্মরণ করতেন প্রয়াত ড. আলিম চৌধূরীর কথা। সবকিছু জেনেও আশায় আশায় ছেলেকে নিয়ে দৌড়াতেন যদি কিছু হয়। চোখে কম দেখা ছাড়া আমার তেমন কোন সমস্যা ছিল না। ভূল বললাম, একটা বিকট সমস্যা ছিল - সামাজিক সমস্যা। যাদের চোখে বা অন্য শারীরিক সমস্যা আছে তারা প্রতিনিয়তই অনূভব করেন সেটা।
১৯৯০ সালের জানুয়ারী মাস। আমি তখন সুইডেনের রাজধানী ষ্টকহোমে। ক'দিন পরেই হয়তো ফিরবো দেশে। যখন আসি আব্বা-আম্মা সহ সবারই পরামর্শ ছিল চোখটা যেন দেখাই। এপয়েন্টমেন্ট করে দিল এক সুইডিশ ভদ্রলোক। সে ডাক্তারের কাছে কি বলেছিল জানি না, আমি যখন চেম্বারে ঢুকছি ড. সোনিয়া উঠে এসে প্রথমেই বলে বসলো - আচ্ছা তুমি কি বলতে চাও বাংলাদেশে ভাল কোন চোখের ডাক্তার নাই ? স্বভাবতই বিব্রতকর অবস্থা। আমি হেসে বললাম - আছে। সমস্যা হলো আমাদের জনসংখ্যা এতো বেশী যে ডাক্তাররা রোগীকে খূব বেশী সময় দিতে পারেন না। তাতে হয়তো সাজেশনটা ঠিকমতো আসে না। আমি তাকে আরো বললাম যে আসলে আমি আমার চোখের বর্তমান অবস্থা জানতে চাই। ড. সোনিয়া খূবই আন্তরিকতার সাথে আমার চোখের কিছু টুকিটাকি পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষার সময়ও চললো নানা রকম কথা। আমি কি করি, কতদূর পড়ালেখা করেছি, সুইডেনে আসলাম কি করে, ভবিস্যৎ পরিকল্পনা কি ইত্যাদি। একসময় কথা এসে থামলো চোখের বিষয়ে। আমার সাথে যেহেতু চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র ছিল না, উনি প্রশ্ন করে করে জেনে নিচ্ছিলেন সবকিছু। আমি ড. আলিম চৌধূরীর কথা বলেছিলাম সবার শেষে। এরমধ্যে ড. সোনিয়ার পরীক্ষাও শেষ। বললেন - চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখায় মানুষ উন্নতি করেছে অসাধারণ। যেমন হার্ট বা কিডনী। আবার কতগুলোতে হার্ট বা কিডনীর তুলনায় তেমন কোন উন্নতি হয়নি, যেমন চোখ। পূরো চোখ কেটে অপারেশন করা স্বপ্ন মাত্র। একমাত্র যেটা করা সম্ভব হয়েছে বাইরে থেকে লেজার দিয়ে রেটিনার কিছু কারেকশন করা। কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন চোখের চিকিৎসায় একটা বিরাট মাইলষ্টোন।
এবার আসলেন আমার চোখের ব্যাপারে। বললেন ১৯৭০-৭১ সালে যে ডাক্তার তোমাকে তখনই অপারেশন না করে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটা এখন পর্যন্ত তোমার জন্য সেরা পরামর্শ। আমি তোমাকে এই পরামর্শটাই আবারো দিতে চাই। তুমি এখনও চলতে-ফিরতে পার, গ্রাজুয়েশন করেছ, দেশ থেকে কত দূরে এসে কাজ করছো। একটু হয়তো সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু তাতে তো তুমি অভ্যস্ত হয়ে গেছ। সুতরাং দরকার কি অপারেশন করার। যখন একেবারেই পারবে না, তখন না হয় করো। আর এরমধ্যে নতুন কোন টেকনোলজি তো চলেও আসতে পারে। হু নোজ।
এরপর তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করলেন আমার চোখের পূরো পরিস্থিতিটা। বললেন ২০ বছর আগে সেই ডাক্তার সাহেব হয়তো জানতেন না কেন ৫০% ভাল হয় আর বাকিরা হয় না। আজ ২০ বছর পর আমি জানি কেন এমনটা হয়, যদিও আমার করার কিছু নাই। তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে ছিলে চোখের ফর্মেশনে কিছু সমস্যা হয়েছে। দু'টো জায়গায় এ সমস্যা হতে পারে। এক তোমার চোখের লেন্সে। অস্বচ্ছ বা অপরিণত লেন্সের কারণে আলো ঠিকমতো তোমার চোখের রেটিনাতে পৌছায় না। এরকমটা হলে অপারেশন করে তোমার লেন্সটা ফেলে দিয়ে একটা কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেয়া হবে। ব্যস! তুমি চলে গেলে ভালো হওয়াদের দলে। সমস্যা এটা না হলে দ্বিতীয় যে কারণ সেটা হলো আইবলের ভিতর কোন মাংসপিন্ড বা এ জাতীয় কোন কিছুর উপস্থিতি। আইবলের ভিতরটা শুধূমাত্র ভিট্রিওল নামের এক তরলে পরিপূর্ণ থাকার কথা। জন্মের সময় যদি কোন মাংসপিন্ড বা এ জাতীয় কিছু ভিতরে তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে সেটাও আলোকে বাধা দিচ্ছে। সমস্যা হলো এটা বাইরে থেকে বোঝার কোন ব্যবস্থা নেই এবং তার থেকে বড় কথা এটার কোন প্রতিকার নেই। সো .... ।
ষ্টকহোমের সেই রাতটা আমার জীবনের একটা কষ্টের রাত। আমার চোখের জন্য না, আমার কষ্ট হচ্ছিলো ড. আলিম চৌধূরীর জন্য আর আমাদের দেশের অবস্থার জন্য। পরাজয় নিশ্চিত জেনে হানাদার পাকিস্থানী আর এদেশীয় হারামজাদা রাজাকাররা এইসব বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে কত বড় ক্ষতি করেছে এই দেশের !!! আপনাকে এক আধ বার তো ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে। বুকে হাত দিয়ে বলেন তো আপনি কোন ডাক্তারের কাছ থেকে এরকম পরামর্শ পেয়েছেন ? প্রয়োজন না থাকলেও এই টেষ্ট সেই টেষ্ট আর ঔষধ গেলানো, নিজে না পারলে যে রেফার করতে হয় সেই ন্যুনতম জ্ঞান টুকুও তো নেই এখনকার ডাক্তারদের। হানাদার পাকিস্থানীরা চেয়েছিল চিন্তায়-চেতনায় আমরা যেন ক্রমশই পিছিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা সফল। নাহলে ড. আলিম চৌধূরীর হত্যার বিচার হয় না এদেশে অথচ হত্যার ষড়যন্ত্রকারী মওলানা মান্নান মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিল এদেশের।
আজ এই শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে ড. আলিম চৌধূরী সহ জানা অজানা সব শহীদকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে।
ড. আলিম চৌধূরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধূরী'র মূখে শুনুন ......
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:৪২