
ঘড়ির কাটাগুলো খসে পড়ছে চুনসুরকির আস্তরনের মতো নোনাধরা অতীত নিয়ে!
বিগলন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করছে সপ্তসিন্ধু পাড়ের সুবর্ণ সময়!
তিনি হিসেব করে দেখলেন, বারবার হিসেব করে দেখলেন, যে টাকা হাতে আছে তার, বাষট্টি জন মানুষের তিনদিনের ভাতের সংস্থান হবে!
আচ্ছা ভাতের মাড়টুকু যদি ফেলে না দেই, একদিন কী বেশি চলবে?
তারপর?
বিষ পান করবেন?
‘একটি পাত্রে বিষ তৈরি করে নিয়ে এসেছে লোকটি। লোকটিকে দেখে তিনি বললেন, এসব বিষয় তোমার তো ভালো জানা আছে। বলো বন্ধু কী কী আমাকে করতে হবে।
লোকটি জবাব দিলো, তেমন কিছুই না। এটা খেয়ে একটু পায়চারী করুন। যখন পায়ের দিকটা একটু ভারি-ভারি লাগবে, তখন শুয়ে পড়বেন। এতেই কাজ হবে।’…১
তিনি পাত্র তুলে নিলেন হাতে। চুপচাপ। কোন কথা বললেন না।
কী এতো ভাবছেন বলুন তো?
কতো ভাবনা! ভারাক্রান্ত মনে জবাব দিলেন তিনি।
বেশি ভাববেন না। বেশি ভাবলে নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে। শরীর পড়ে যায়।
কিন্তু কী করবো বলুন, ভাবনারা যে বারণ শোনে না।
স্লিপিং পিল খান না আপনি? স্লিপিং পিল খাবেন রোজ রাতে। দেখবেন সব ভাবনা সরে যাবে মাথা থেকে।
কিন্তু সমস্যা তো থেকেই যাবে, তাই না?
মহা যন্ত্রনা তো আপনাকে নিয়ে! আরে ভাই সমস্যা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। নিন, চুমুক দিন তো আগে!
‘তবে দেবতাদের কাছে এটা প্রার্থনা করা নিশ্চয়ই যথার্থ ও আইনসঙ্গত যে এখান থেকে আমার বিদায় গ্রহণ সুখপ্রদ হোক। তাহলে আমি সেই প্রার্থনাই করছি। এই কথাগুলো বলতে বলতেই তিনি শান্তভাবে সবটুকু বিষ পান করে ফেললেন।
এবার অপেক্ষা। স্থির। নিশ্চিত চিরসত্যি যা সেখানেই নিহিত সম্ভবত সমস্ত সমস্যার সমাধান।’…২
আপনার সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আমি!
সন্দিহান আমিও! কিন্তু কী করবো বলুন তো আমি! আমি তো ঈশ্বরের পুত্র নই যে, সামান্য খাবারে পরিতৃপ্ত করবো ক্ষুধার্ত বিশ্বকে!
তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, ভাবুন। আরো ভাবুন। বেশ ভালো করে ভাবুন।
তিনি ভাবনার বহুস্তর বিশিষ্ট দুর্বোধ্য জগতে প্রবেশ করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। শুরু করলেন পায়চারী।
‘তিনি পায়চারী করতে করতে একসময় বললেন, পা দুটো ভারি বোধ করছেন এবং এই কথা বলে তিনি শুয়ে পড়লেন। লোকটি তাঁকে এরকম করতেই নির্দেশ দিয়েছিলো।’…৩
আমি আপনার মতো অকর্মন্য নই, আপনি জানেন সেটা।
হ্যাঁ, আপনি সুপ্রতিষ্ঠিত। আপনার দুই সন্তান সস্ত্রীক বিদেশে বসবাস করছেন স্থায়ী ভাবে।
কথা সত্যি! কিন্তু এ কথার মধ্যে কোথাও কী লুকিয়ে আছে একটুকরো বিষাদ?
তিনি জানেন না! অথবা জানতে চান না!
বিপত্নীক হবার পর তিনি একজন মুক্ত মানুষ!
প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই কী মুক্ত?
মাত্রাতিরিক্ত মুক্তি কী আসলে চায় না মানুষ?
মানুষ আসলে কী চায়?
একাকীত্ব না মানুষের সাহচর্য?
জীবনের দায় কী মিটিয়ে দেবেন তিনি?
তার সঞ্চয়, তার সামান্য ঐশ্বর্য তিনি কী সপে দেবেন পরম শান্তির করতলে?
‘তিনি ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা ও শক্ত হয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজেকে একবার স্পর্শ করে বললেন, বিষ তাঁর হৃদপিণ্ডে যখন পৌঁছবে তখুনি তিনি বিদায় নেবেন। ততোক্ষণে তাঁর তলপেটের আশেপাশের অংশ প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঠিক এই সময় মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে- কারণ তাঁকে ঢেকে দেয়া হয়েছিলো, তিনি এই কথাগুলো বললেন, ‘ক্রিটো, ইসকিউলাপিয়াসের কাছে আমাদের একটি মোরগ মানত আছে, শোধ করে দিয়ো, অবহেলা করো না।’
ক্রিটো বললেন, ওটা নিশ্চয়ই করা হবে। আর কিছু বলার আছে কিনা দেখুন।
এই প্রশ্নের তিনি কোন জবাব দিলেন না। একটু পরেই তাঁর সারা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠলো।’…৪
তিনি মাথা নিচু করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, একটা জিনিস আপনাকে দেবার আছে আমার।
কী? চিন্তিত মুখে নিরাসক্ত জিজ্ঞাসা। যেনো উত্তরে তার এসে যায় না তেমন! পৃথিবীর বৃত্তাকার চর্তুপাশে যে আকাশ বিরাজমান, সে আকাশ ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় যেনো বিহ্বল তিনি!
এই চেকটা আপনার। আর এই দলিলগুলোও রাখুন।
মানে কী?
মানে কিছুই না। আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পদ আমি তুলে দিলাম আপনাদের অনাথ আশ্রমের শিশুদের ভরণ পোষণের জন্য। এবার বিদায় বন্ধু!
‘লোকটি ঢেকে দিলো সক্রেটিসের দেহ। চোখ দুটো স্থির হয়ে রয়েছে দেখে ক্রিটো তাঁর মুখে এবং চোখের পাতা বন্ধ করে দিলেন। এচিক্রেটিস, এই হচ্ছে আমাদের বন্ধুর অন্তিম যাত্রার কথা। সেই বন্ধু যিনি আমার জানামতে আমাদের কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন এবং তার চেয়ে বড়ো কথা সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে ন্যায়বান।’…৫
বিস্ময়ে বিমূঢ় ব্যর্থ মানুষ পবিত্র কুণ্ডুর চেহারা!
অতি আবেগ আক্রান্ত বাষ্পরূদ্ধ অবিশ্বাস্য স্বরে উচ্চারণ করলেন, আপনি আপনার সর্বস্ব দান করলেন আমাদের অনাথ আশ্রমে?
শফিক সাহেব জীবনে সমস্ত হিসেব মিটিয়ে দিয়ে ভিন্ন জগতের দিকে নিবদ্ধ করলেন দৃষ্টি, বললেন, আমার যে কোথাও যাবার আর জায়গা নেই পবিত্র বাবু। একজন নিঃস্ব নিঃসম্বল অসহায় অনাথের একটু আশ্রয় কী হবে আপনাদের আশ্রমে?
পবিত্র বাবু কাঁদছেন।
শফিক সাহেবের মতো এতো বড়ো মনের একজন মানুষকে ধারণ করার ক্ষমতা কী এই অনাথ আশ্রম রাখে?
ঈশর কোথায় থাকেন জানেন না পবিত্র বাবু! জানলে তিনি শফিক সাহেবের জন্য হাজার বছর পরমায়ু কামনা করে অনুরোধবার্তা পাঠাতেন!
কারণ, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শফিক সাহেবের হাতেই তুলে দেবেন অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব!
তারপর বিষপানেও আপত্তি নেই তার, বিন্দুসমান!
১. সক্রেটিস, হাসান আজিজুল হক
২. প্রাগুক্ত
৩. প্রাগুক্ত
৪. প্রাগুক্ত
৫. প্রাগুক্ত
ছবি: সংগৃহীত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




