somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি দৃশ্য অস্বীকারের প্রাণপণ চেষ্টা

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাটি আর শণে ছাওয়া ঘরটির অবস্থা বেশি ভালো নয়। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, কারণ নুয়ে পড়া এই ঘরটিই সূর্যের প্রখর উত্তাপকে ঠেকিয়ে খানিকটা ছায়ার ব্যবস্থা করেছে উঠানে। দ্বিধাগ্রস্ত সেই ছায়ায় একটা জীর্ণ চাটাই পাতা। সেখানেই শুয়ে আছেন রাজবালা কুর্মী। পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীর তাঁর। পলকহীন চোখের মণিতে জীবনের অনুরণন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। জানতাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চা-শ্রমিক খাইমুলা কুর্মীর স্ত্রী বেঁচে আছেন এখনো। কিন্তু এ কেমন বেঁচে থাকা! দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে বুক চিরে। ভেবেছিলাম রাজবালা কুর্মী নিজ মুখে স্বামীর বীরত্বগাথা শোনাবেন আমাদের। তা আর হলো কই!

হতাশার কাছে আত্মসমর্পণের আগে সনাতন কুর্মীর দিকে তাকাই আমরা, খাইমুলা কুর্মীর বড় ছেলে তিনি। উপায়ন্তর না দেখে তাঁর কাছেই জানতে চাই শহীদ চা-শ্রমিক খাইমুলা কুর্মীর কথা। তিনি সসংকোচে জানান, তাঁর বাবা খাইমুলা কুর্মী জন্মেছিলেন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ফুলছড়া চা-বাগানের এই শ্রমিক নিবাসেই। চা-বাগানের লক্ষাধিক শ্রমিকের মতোই সরলরৈখিক জীবন ছিল তাঁরও। অন্যান্য চা-শ্রমিকদের মতো তিনিও উদয়াস্ত শ্রম দিতেন বাগানে, মালিকপক্ষের হাজারো লাঞ্ছনায় যাপন করতেন বর্ণহীন জীবন। অবসরে স্বপ্ন দেখতেন রংধনু থেকে রং এনে প্রাণে ছোঁয়ানোর। এভাবেই যৌবনে পদার্পণ করলেন তিনি। কিন্তু প্রাণে রং ছোঁয়ানোর মতো কোনো উপলক্ষ কি তৈরি হলো? সন্তানের চিত্তচাঞ্চল্য লক্ষ করলেন বাবা ভক্তু কুর্মী। ছেলের বিয়ে দিলেন তিনি। খাইমুলা কুর্মীর জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো রাজবালা কুর্মীর জীবন।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাজবালা কুর্মীর কোল আলো করল ফুটফুটে একটি ছেলে। খাইমুলা তার নাম রাখলেন সনাতন। এভাবেই আরও এক মেয়ে ও দুই ছেলের আগমন ঘটল সংসারে। খাইমুলা কুর্মীর চিত্ত তো এখন আর চঞ্চল হওয়ার কথা নয়! কিন্তু খাইমুলার অন্তরে কিসের যেন অস্থিরতা গুমরে মরে। ১৯৭১ সাল। স্বাধিকার আন্দোলনের তীব্রতায় দেশ তখন উন্মাতাল। এদিকে রাজবালা কুর্মী পুনরায় সন্তানসম্ভবা। অথচ খাইমুলা কুর্মী সংসার ফেলে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ান। নানান আলোচনায় প্রবেশ করে জানতে চান, কী হবে যুদ্ধ হলে? বয়স্করা উত্তর দেন, আরে বোকা যুদ্ধ হলে দেশ স্বাধীন হবে, দেশ স্বাধীন হলে আমরা, মানে চা-শ্রমিকেরা পাব মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার। খাইমুলা কুর্মীর রক্তে নাচন লাগে। তবে তো যুদ্ধ করতে হবে! স্বাধীন করতে হবে দেশ!

ফুলছড়া বাগানের বুক চিরে যে পথটি চলে গেছে ভারতীয় সীমান্তের দিকে, সে পথে প্রতিদিন বাড়তে থাকে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচল। না, আর দেরি করা সমীচীন নয়। স্ত্রী-সন্তানের মায়া উপেক্ষা করে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলেন খাইমুলা কুর্মী। কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিং নিলেন সেখানে। তারপর ফিরলেন আবার ফুলছড়া চা-বাগানের চিরচেনা অঙ্গনে।

ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কালীঘাট চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয় ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানি সেনারা। ফুলছড়া চা-বাগানের সর্পিল পথটির মাঝামাঝি অংশে ছোট্ট একটি সেতু ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা সঞ্চালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হলে সেতুটি ভেঙে ফেলা জরুরি। কিন্তু কাজটি খুব কঠিন। সেখানে প্রহরা বসিয়েছে পাকিস্তানিরা। তা ছাড়া তাদের ক্যাম্পের অবস্থানও সেতু থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সেতু ভাঙার দায়িত্ব নেবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়লেন মুক্তিযোদ্ধারা। খাইমুলা কুর্মী ও পাদুকা তাঁতীর ছেলে নিরাকার তাঁতী সেতু ভাঙার দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বিস্ফোরণে উড়ে গেল ছোট্ট সেতুটি।

কাজ শেষ করেই নিরাকার তাঁতী এলাকা ছাড়লেন দ্রুত। কথা ছিল খাইমুলা কুর্মীও পালাবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু সন্তানসম্ভবা রাজবালা কুর্মী তখন হাসপাতালে। শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন খাইমুলা কুর্মী। পথেই ওত পেতে ছিল পাকিস্তানি সেনারা। খাইমুলা কুর্মীকে সহজেই বন্দী করল তারা। তারপর তথ্য আদায়ের জন্য শুরু হলো অবর্ণনীয় অত্যাচার। কিন্তু তথ্য দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানালেন খাইমুলা কুর্মী। অবশেষে পাকিস্তানি সেনারা শ্রীমঙ্গল শহরের একেবারে কাছেই ভুড়ভুড়িয়া চা-বাগানের পূর্ব দিকে অবস্থিত বড় একটা বটগাছের তলায় নিয়ে গেল খাইমুলাকে। এখানেই ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রাণনাশ করা হলো খাইমুলা কুর্মীর। বলতে বলতে চোখ মুছলেন সনাতন কুর্মী।

খাইমুলা কুর্মীর যে সন্তানটি একাত্তরে গর্ভে ছিল, রাজবালা কুর্মী তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মঙ্গল’। কারণ, সবার জীবনে মঙ্গল আনার জন্যই তো খাইমুলা কুর্মী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু এ কেমন মঙ্গলের মুখোমুখি আজ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটি!

উঠানের এক কোণে পড়ে থাকা রাজবালা কুর্মীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরের দিকে আবার তাকাই আমরা। একঝাঁক মাছি ভনভন করছে ত্যাগী এই রমণীর মুখের চারদিকে। অসহ্য লাগে আমাদের। চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটি অস্বীকার করার চেষ্টা করি প্রাণপণে!


প্রথম প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০১০ইং


সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৫
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×