ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কত টাকা বেতন পান?
‘মাসে ষাট হাজার টাকা পাই’ আমি জবাব দিলাম।
বলেন কি? আপনি একজন ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। আপনার বাসা ভাড়াই ত বিশ হাজার টাকা! সংসার খরচ মাসে তিরিশ হাজার। ছেলেপুলে কি আপনার?
আমার দুই মেয়ে।
ওদের ভাল স্কুলে পড়াইতে গেলেও ত মাসে বিশ হাজার টাকা লাগে। হায় হায়! করছেন কি আপনে! ব... বস আপনে মাইন্ড কইরেন না, দুনিয়া খুব কঠিন!
দুনিয়া কঠিন বুঝলাম। এখন কি করতে হবে?
আপনেরা ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। আপনেরা মনে করেন দেশের সেরা ছাত্র। আপনেরে যদি আমগর বুঝাইয়া কইতে অয়!
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে চোখের একটা খেলা দিয়ে মাথা নিচু করে চিকেন টিক্কার দিকে মনোযোগ দিলেন। আমি ভদ্রলোকের দিকে মনোযোগ দিলাম!
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চান্নর কম না। শক্তপোক্ত শরীর।চেহারায় অতি চালাক ভাব নাই। সাধারণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। মেয়ে থাকলে মরার আগে ‘এস্টাইবলিশ’ ছেলের(এস্টাইবলিশ মানে ক্ষমতাওয়ালা বা পয়সাওয়ালা যেকোন একটা হতে হবে। পয়সা থাকলে ক্ষমতার শেয়ার কেনা যায়। ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতা কো-ভেলেন্ট বন্ড শেয়ার করে অবৈধ পয়সার মালিক হওয়া যায়!) সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মরতে চান। ছেলে থাকলে ভাল ঘুষ টুস খাওয়া যাবে এরকম একটা চাকরিতে ছেলেকে বহাল দেখে চোখ বুঁজতে চান। বলা বাহুল্য, এসব উনি নিজের জন্য চান না।ছেলেমেয়ের জন্য চান। ঐ যে, দুনিয়া খুব কঠিন!
আমি মহান শ্রষ্ঠা কে সবসময় ধন্যবাদ দিই এই কারনে যে উনি আমাকে বোকা মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। আমি যদি বুদ্ধিমান মানুষ হতাম তাহলে ভদ্রলোকের কথা শোনার পর গভীর দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে ভাবা শুরু করতাম- তাইত তাইত! আমার আর আমার বৌ এর কথা না হয় বাদ! আমি আমার সন্তান দের জন্য কি করছি? ওদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত(!) করতে চাইলে আমার ত এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। ওদের কে কষে ইংলিশ শেখানোর পাশাপাশি বাংলাও শেখানো উচিত(আহা, হাজার হলেও আমরা বাঙালি না!)।ওদের জন্য যেকোন উপায়ে ‘হ্যান্ডসাম ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স’ তৈরি করা উচিত। ওদের কে শেখানো উচিত- যেকোন মূল্যে তোমাদের বড়লোক হতে হবে। কারন- ওই যে দুনিয়া খুব কঠিন!
ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ওদের ভবিষ্যৎ?
ভবিষ্যৎ খুব সুন্দর!!
হয় ওরা জান বাঁধা দিয়ে হলেও বিদেশ চলে যাবে। কারন এই দেশে ঘুস, দূর্নিতি, দুই নম্বরি,হরতাল, মৌলবাদ ছাড়া কিছু নাই। বিদেশ গিয়ে সর্বক্ষনের ধান্ধা থাকবে কোন কূ-ক্ষণে যেন এ পোড়ার দেশে আর ফেরত আসতে না হয়। বিদেশের মাটিতে কবর নিশ্চিত করতে পারলে ফেস বুকে আরাম করে ‘স্ট্যাঠাস’ দেবে- আমি দেশ কে কুব বালবাসি। এমুন দেশ টি কোতাও খুঁজে পাবে নাক টুমি, ওমাগো, আই লাবিয়ু!’
অথবা দেশে কতগুলো স্পষ্ট বক্তব্যহীন, মেরুদণ্ড হীন অথচ অহংকারী(!) প্রাণী হিসেবে বাস করবে। ইংরেজি ভক্কর চক্কর কিছু শিখলেও বাংলা শুদ্ধ করে লিখতে বা বলতে পারবে না। ‘আমি যাই’ কে লিখবে ‘আমি যায়!’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এদের সাথে কথা বলতে চাইলে বলবে- হ্যা...এ...এ...মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক, আবার রাজাকার রাও ঠিক!!
এরা মুখে বলবে আমি ধার্মিক। কিন্তু এদের আচরণ দেখে কখনো মনে হবে না ‘মানুষ আল্লাহ র অগোচরে কিছু করতে পারে না’ এই বিশ্বাসের কণামাত্র এদের অন্তরে আছে! এদের আচরণে কখনোই মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ পাবেনা। যেখানে ধান্ধা আছে সেখানে এদের কে আন্তরিকতার সীমা থাকবে না। যেখানে ধান্ধা নাই সেখানে এদের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা থাকবে না। এরই মাঝখানে এদের কিছু তরল ভালমানুষি দেখা যাবে। যাতে মানুষ এদের সম্পর্কে স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পারে।
এরকম কেন হবে? এরকম কেন হয়??
যখুনি ‘দুনিয়া খুব কঠিন’ এই শয়তানী বচনে প্ররোচিত হয়ে আপনি যেকোন উপায়ে বড়লোক হতে চাইবেন তখুনি আপনি মনে মনে একেবারে আপনার ‘মৌলিক সততা’র সাথে সমঝোতা করে ফেলবেন। ধরেন আপনি একজন শিক্ষক। আপনার পড়ানোর বিষয় গণিত। যখুনি আপনি গণিত পড়িয়ে মিলিওনিয়ার হতে চাইবেন তখন প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী ঠিকমত গণিতের মৌলিক বিষয় টুকু বুঝল কিনা সেটা আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে না। আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে- বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবক আপনার পড়ানোয় কনভিন্সড কিনা! কোচিং সেন্টারের রেভিনিউ যেকোন উপায়ে বাড়ছে কিনা!!
আপনার কাছে পড়ে আমার ছেলে বা মেয়ে গনিতে এ প্লাস পাওয়া শিখবে। কিন্তু ‘গণিতের আনন্দ জগত’ এর সাথে পরিচিত হবে না। গণিতের আনন্দ জগতের সাথে যে পরিচিত নয় সে কখনো বুঝবে না পৃথিবীর মূল গণিত টা আসলে খুব সুষম। আমরা বুঝিনা বলেই নিজেকে বঞ্চিত ভেবে কষ্ট পাই।
ধরেন আপনি একজন লেখক। যখুনি আপনার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে যাবে বিখ্যাত হওয়া এবং পয়সাওয়ালা হওয়া তখন পাঠক কে কি মেসেজ দিলেন বা আদৌ কোন মেসেজ দিলেন কিনা সেটা নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামাবেন না। আপনি প্রানপণে চেষ্টা করবেন পাঠকের অনুভূতি যেন খোঁচা না খায়, পাঠকের প্রচলিত বিশ্বাসে যেন আঘাত না লাগে, আপনার লেখা পড়তে পড়তে ভুলেও যেন পাঠকের বুকের ভেতর তীব্র প্রশ্ন গুমরে না উঠে- ‘আমি নিজে আসলে কতটুকু ঠিক?’ দুচার টা বই হিট করার পর আপনি নিজে বই টই পড়াই বন্ধ করে দেবেন। কারন ময়রা মিষ্টি খায় না!
এভাবে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে প্রতিটা ক্ষেত্র। সবাই সবার নষ্ট নির্মান প্রতিদিন পরস্পর কে উপহার দিতে দিতে দিনের শেষে কি ভয়ঙ্কর ভাবে সবাই সবার সাথে একমত হচ্ছি- এই পোড়ার দেশ টাতে কিছু নাই! হায় রে দেশ প্রেম!!
একটু উল্টো ভাবে যদি আমরা ভাবতে পারতাম? যদি ভাবতে পারতাম দুনিয়াটা আসলে অত কঠিন কিছু নয়! মানুষের কোটি কোটি টাকা থাকলেও সে খাওয়া দাওয়া, ঘুম, সেক্স, পায়খানা এসবের বাইরে বেশি কিছু আসলে করতে পারে না।
এসব জৈবিক ব্যাপারের বাইরে যে আনন্দ হতে পারে সেটা হল মহৎ একটা বই পড়ার আনন্দ। গুন গুন করে একটা কবিতা আবৃত্তির আনন্দ। সংগীত শোনার আনন্দ। শ্রষ্ঠার কাছে প্রার্থনার আনন্দ। হায়, এসব আনন্দ পাবার জন্য ত লাগে সুগঠিত মন। অবৈধ পয়সা নয়!
‘কেউ কারো অধিকার হরণ না করে সবাই যার যার যায়গায় সৎ এবং সক্রিয় থাকলেই দেশের প্রতিটা দেহকোষ হেসে উঠে’ এই অনুভব দিয়ে যদি আমরা আমাদের প্রজন্ম কে বড় করতে পারতাম তাহলে অসৎ বিভ্রান্ত মানুষে দেশ কখনোই ভরে যেত না। মানুষ যখন পরস্পর থেকে সততার উদাহরণ পেত তখন কখনোই দিনের শেষে তার এই উপলব্ধি হত না- দেশ টা নষ্ট হয়ে গেছে। এই উপলব্ধি না আসলে দেশ ছেড়ে চিরতরে পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে বরং চিন্তা করত কি করলে দেশের আর একটু ভাল হয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৩:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


