somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কামনার পরাগ রেণু

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উনিশ শ পঁচানব্বুই সালের সেই সন্ধ্যা টা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। জলপাই রঙের বার্মিজ কাপড়ের ব্যাগে কাপড় চোপড় সব গোছানো হয়েছে। টিনের ট্রাঙ্কের ভেতর কয়েকটা গল্পের বই, একটা গান শোনার ওয়াক ম্যান, একটা ছবির এ্যালবাম নিয়ে টিনের ট্রাঙ্ক তালা দেয়া হয়েছে।ঈদ উপলক্ষে সিলাই করা প্যান্ট শার্টের উপর ফেড জিনসের জ্যাকেট চাপিয়ে আমি ঢাকা যাবার জন্য প্রস্তুত। আটই জানুয়ারি বুয়েটে আমার ক্লাস শুরু হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হলে থাকব, আমার অবাধ স্বাধীনতা! নিকট ভবিষ্যতের স্বপ্নিল দিন গুলো আমার চোখের সামনে উড়াউড়ি করছে! আমি কল্পনায় দেখছি সাদা শার্টের সাথে টাই পরা ঋজু সুদর্শন একজন স্যার বুয়েটে আমার ক্লাস নিচ্ছেন। হলে আমার রুমে আমার লকার থেকে গল্পের বই বের করে আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরাম করে গল্প বই পড়ছি। বিকেলের দিকে টিএসসি তে আমার একটা প্রেম!
দুরু দুরু বুকে আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে বললেন- অ ফুত!!

অস্ফুট স্বরে ‘অ ফুত’ বলার মানেই আম্মা আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চায়। এমন কিছু যেটা গোয়াল ঘর ছেড়ে বাইরে আসার আগে গরুকে স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরী! আম্মাকে ছেড়ে দিয়ে আমি আম্মার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম। আম্মা নিচু কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন- আমার ছেলে যখন পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হবে তখন আমি নিজে দেখে আমার ছেলের জন্য খুব সুন্দর শরীফ ঘরের বৌ আনব!

রাতের বাসে আধো ঘুমে রোমান্টিক হিন্দি গান শুনতে শুনতে বুঝতে পারলাম মায়ের আদেশ আমার কল্পনাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে নাই।কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম-আমি ডাস এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে নীল শাড়ি পরা কবিতার মত একটা মেয়ে। বিষাদ মাখা বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলছে- আপনি এত শুকনা কেন? ভাত খান না বুঝি?

ব্যক্তির কল্পনা দিয়ে পৃথিবীর বাস্তবতা তৈরি হয়না। সব মানুষের বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কল্পনা যে সম্মিলিত ছবি তৈরি করে সেটাই পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেই ছবির যে অংশটুকুতে আপনি থাকবেন সেটাই আপনার ‘স্থানীয় বাস্তবতা’ হবে! আপনার বিচ্ছিন্ন কল্পনা আপনাকে খুব আলাদা রকম কোন জীবন বা আলাদা রকম বাস্তবতা উপহার দেবেনা। এজন্য একটা সন্মিলত জনগোষ্ঠীর একসাথে একই স্বপ্ন দেখা জরুরী। ‘স্বপ্ন বাস্তবায়ন’ বলতে যেটা বোঝায় সেটা এক্ষেত্রে ঘটা সম্ভব।

উপরের সূত্রানুযায়ী নিজের কল্পনা অনুযায়ী না ঘটলেও সামগ্রিক জীবনের সন্মিলিত ছবির টুকরায় কখনো কারো পাশাপাশি বসে রিকশায় গিয়েছি। কাউকে কবিতা শুনিয়েছি। কারো হাত ধরেছি। বা কারো নাকের ডগাটা একটু ছুঁয়ে দেবার পর তির তির করে কাঁপতে থাকা সেই নাকের ডগায় মুহুর্মুহু জমতে থাকা রক্তিমাভার দিকে তাকিয়ে অনুভব করেছি কেবলমাত্র দুজন নরনারী’র মধ্যে সম্ভব শুদ্ধতম ভালোবাসার নীরব স্পন্দন!

প্রতিষ্টিত সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী একসময় নির্দিষ্ট এক মানবীর সাথে জীবন বিনিময় হয়েছে। সংসার করতে গিয়ে বুঝেছি সংসারে ভালোবাসাটা প্রতিদিনের কোন অনুষ্ঠান নয়। এটা বুকের গভীরে রাখা একটা পারস্পরিক সন্মানবোধ যেটা সবচেয়ে সহজলভ্য পরিস্থিতির সুযোগে একেবারে নিরাপদ বিশ্বাস ঘাতকতা(!) করতেও মন কে বাধা দেয়। আপনি পার্টিতে গিয়ে পরনারী বা পরপুরুষের সাথে সীমা অতিক্রম করে মিশলেন। তারপর ঘরে এসে স্বামী বা স্ত্রী কে বললেন- তোমাকে ছাড়া কেমনে বাঁচি! এটা হল দূর্নিতি করে দেশের বারটা বাজিয়ে বিজয় দিবস আসলে জাতীয় পতাকা বুকে নিয়ে ভণ্ডামি করার মত।ভণ্ডামি করে পিঠ বাঁচানো যায়। দেশ বা সংসার বাঁচানো যায় না।

ধাপে ধাপে জীবনের শিক্ষা গুলো পেতে পেতে যে থুতনিতে হাত বুলিয়ে একদিন বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম দাড়ি উঠেছে আয়নার ভেতর দিয়ে সেই একই থুতনির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখেছি দাড়ি পেকেছে! প্রকৃতির নিয়মে আসা বার্ধক্যকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি। ‘চল্লিশ বছরে যৌবন শুরু হয়’ এই ধরনের বেকুবি কথাবার্তা আমি বলি নাই। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছি মানুষের কল্পনা হল সফটওয়্যার। শরীর হার্ডওয়্যার। শরীরে মরচে ধরে। মনে মরচে ধরে না। মনের উপর যদি কেউ যুক্তিহীন কুসংস্কারের প্লাস্টিক কোট দিয়ে রাখে তার কথা আলাদা।

নর এবং নারী। প্রকৃতি গত ভাবে তাদের সত্ত্বা এক। শারীরিক গড়ন আলাদা। কারন দুজনে মিলে সন্তান উৎপাদন করতে হয়। সন্তান উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য বাতাসে ছড়ানো আছে কামনার অদৃশ্য পরাগ রেণু। যৌবনের কুঁড়ি উদগমের পর পরই নর এবং নারীর নাকে এসে লাগে সেই পরাগ রেণুর সুবাস। ঘুম ভেঙ্গে শিহরিত কিশোর এবং কিশোরী বুকের ভেতর অনুভব করে অদ্ভুত শূন্যতা। বাবা,মা, ভাই, আপা, দাদু, নানু, খালামনি, ফুপির ভালোবাসাটা বুঝি না পেলেও চলে! কিন্তু ‘তার’ ভালোবাসা না পেলে চলে না!!

যৌবনের কুঁড়ি উদগমের সময় জেগে উঠা সেই শূন্যতার প্রেতাত্মা আপনি যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন আপনার সাথেই থাকবে। অনুকূল পরিস্থিতি পেলেই সে জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি আপনার যে কমিটমেন্ট তার সাথে লড়াই এ নামবে। দুজনের মধ্যে কমিটমেন্ট শক্তিশালী হলে কমিটমেন্ট জিতবে। প্রেতাত্মা শক্তিশালী হলে প্রেতাত্মা জিতবে।

সময়ের সাথে যদি পৃথিবীতে সভ্যতা বিকশিত হত তাহলে এসব বিষয় নিয়ে নয়শ শব্দের প্রবন্ধ ফাঁদা লাগত না। তখন কোন মানুষ নিজেকে শুধুই শরীর সর্বস্ব প্রাণী ভেবে শরীরের মাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করতে চাইত না। অথবা কোন মানুষ অন্যকোন মানুষের যেকোন রূপের মধ্য থেকেও তার শরীরী রূপটাকে বের করে আনার জন্য তার প্রতিভার সবটুকু ব্যবহার করত না। তখন মানুষ পরস্পর কে সন্মান করত।

পরস্পর কে সন্মান করে যে খাটি ভালোবাসার চ্যানেল তৈরি হয় সেটাই ঠিক রাখতে পারে কামনার পরাগ রেণুর স্ট্রিম লাইন-এই কথাটা তখন আর কাউকে বলে দিতে হত না।


১১টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×