বুক রিভিউঃ হৃদয়পুরে দেশান্তরী
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বলে গুণীজনে বিরহের গুণে ভালোবাসা হয় হিরন্ময়,
এ অধম তাতে ঈমান আনে না, বিরহকে তার ভীষণ ভয়।
পলক ফেলার সমান বিরহ মনে হয় যেন অন্তহীন
দুনিয়া আখের নিমেষে ফুরায় শেষ হয় না সে বিরহ দিন!
কি অদ্ভুত কথা! কি অদ্ভুত বাণী! কি অদ্ভুত তার প্রকাশ! যে ভালোবেসেছে, যে বিরহে কাতরেছে সেই জানে এই চারটি লাইন কত মূল্যবান। বিরহ সহজে ফুরনোর নয়। দুনিয়া- আখেরাত ফুরিয়ে গেলেও মনে হয় বিরহ কাল যেন ফুরায় না। চোখের এক পলক কালের বিরহ সময়কেও মনে হয় যেন অনন্তকাল।
আরেকটা দেখি-
ভাগ্য লেখেন আল্লাহতালা দুঃখে তিনি দেন নিদান।
জীবনজোড়া দুঃখ লেখা এটাও মানি তাঁর বিধান।
এমন কেনো ভাগ্য আমার, জানবো আমি কার কাছে?
হাজার পাহাড় টপকে এসেও পৌছাবো না তার কাছে!
এই যে আহাজারি, এই যে বিলাপ, এই যে দুঃখ গাঁথা, তাকে কবি চমৎকারভাবে ছন্দে ছন্দে আবদ্ধ করেছেন। কেউ যদি বলেন এর মধ্যে কোনো দর্শন নেই তা আমি মানতে রাজী নই। এতো আমাদের সহজিয়া জীবনের আত্ম জিজ্ঞাসা। এই আত্ম-জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েই আমরা পাড়ি দিতে চাই জীবনের উত্তাল সময়, পৌঁছতে চাই আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে। সক্রেটিস যখন বলেন, 'নিজেকে জানো', লালন যখন বলেন, 'আপন ঘরের খবর লে না' তখন আমরা এই জানতে পারি, কিছু প্রশ্নের জবাব কেবল আত্মজিজ্ঞাসাতেই পাওয়া যায়। কবি প্রকারান্তরে সেই একই দর্শনকেই ছুঁয়ে গেছেন।
কবি এ, টি, এম, মোস্তফা কামালের 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী' বইটি সাজানো হয়েছে এমনি আটানব্বইটি চতুষ্পদী নিয়ে। কবি দেশান্তরী হতে চাইছেন হৃদয়পুরে। কেননা এই চতুষ্পদীগুলোতে একবার আপনি ডুব দিলে আপনি নিজেকে কেবল হৃদয়পুরেই খুঁজে পাবেন। যে আঁচে হৃদয় জ্বলে সেই ঝাঁঝটুকু নিয়ে রচিত বুদ্ধিদীপ্ত অথচ রোমান্টিক ধাঁচের এই চতুষ্পদীগুলো অত্যন্ত সুকোমল এবং সহজ পাঠ্য। কেবল কবিতা নয়, কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ ও হয়েছে অত্যন্ত চমৎকার।
চতুষ্পদী কবিতা মানে চার লাইনের কবিতা। চার লাইনের কবিতা মানেই মনের জানালায় উঁকি মারে রূবাইয়াতের কথা। কিন্তু 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী' রূবাইয়াৎ নয়। যদিও রূবাইয়াতের একটা নির্দিষ্ট গঠনপ্রনালী রয়েছে। রূবাইয়াতে বাক্য শেষের শব্দটি মিলকরনের ক্ষেত্রে ক ক খ ক এই রীতিকে অনুসরণ করে লেখা হয়। কিন্তু কান্তি ঘোষ, ওমর খৈয়ামের যে অনুবাদ করেছেন তাতে সেই রীতিকে ভেঙে ক ক খ খ রীতিতে রূবাইয়াত রচনা করায় অনেকের কাছে এই চতুষ্পদীকেও রূবাইয়াৎ মনে করাটা অস্বাভাবিক নয়। কেবল এই রূবাইয়াতগুলোতে সুফিবাদ বা মরমি দর্শন থাকে এখানে তার অনুপস্থিতি আমাদের বিশেষভাবে জানান দেয় এগুলো চতুষ্পদী কবিতা।
বইয়ের চতুষ্পদী সম্পর্কে কবির ভাষায়, 'বাংলা চিরকালই কবিতার দেশ। সে কবিতায় গীতিমাধুর্য আর ছন্দোময়তার প্রবল প্রতাপ। রোমান্টিকতা, নানা দর্শন আর তীক্ষ্মবুদ্ধির পরিমিত মিশেলেই চলে বাংলা কাব্যসাধনা। এ বইতে বাংলা কবিতার সেই আবহমান রূপই গলাগলি করে আছে। গীতিপ্রবণ কবিতাগুলোতে রুবাই আর শের- এর কিছু ছাপও হঠাৎ চোখে পড়ে। বৈষ্ণব পদাবলী আর রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে ভালোবাসা নানা ভঙ্গিমায় রূপায়িত হয়েছে। হৃদয়পুরে দেশান্তরীর চতুষ্পদী কবিতায় সেই প্রেমকেই ছোট ছোট টুকরা করা আয়নার মতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। .... একুশ শতকের ব্যস্ততার যুগে যে মানব-মানবীর বসবাস তাদের সবার জীবন এখন ছোট হয়ে মুঠোফোন, ক্ষুদে বার্তা আর ফেসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে আবৃত। দীর্ঘ কবিতার রস সেবনের সময় কি আছে তাদের? কিন্তু মানুষের জীবন যাই হোক ভালোবাসার আকুতি তার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ছোট ছোট অবয়বে সেই ভালোবাসাকেই এখানে সেঁটে দেয়া হয়েছে। শুভ হোক সবার হৃদয়পুরের দেশান্তরী হবার যাত্রা।'
নিজের কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে এমন চমৎকার বিশ্লেষণের পর আর বেশি কিছু বলার থাকে না। তার পরও ভালো লেখার গুণগ্রাহী পাঠকের জন্য ভালো বই গুলোর প্রচার হওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। বইটির যে পৃষ্ঠাই মেলে ধরুন আর পড়ুন আপনি পাবেন এক অদ্ভুত আবেশ। মনে হবে এতো আপনার মনের কথাই। আর যে কবি আমার আপনার সকলের মনের কথা পড়তে পারে, তিনিই তো সত্যিকারে কবি।
চতুষ্পদী কবিতাগুলো নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ করা যায় তবে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে তাই কেবল ছন্দ নিয়ে বলি। পদ রচনায় বেশির ভাগই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা চতুষ্পদীগুলোর কোথায়ও ছন্দের পতন হয়েছে এমন নজরে আসেনি। এ নিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন বক্তৃতায় ডঃ তপন বাগচী কবির ছন্দ জ্ঞানের বিশেষ তারিফ করেন। পাঠক মাত্রেই বইটি পাঠ কালে অনুভব করবেন।
আমার আছে আরো একটি বিষয় চোখে পড়েছে। সেটি হলো কিছু নতুন শব্দ বা শব্দ গুচ্ছের ব্যবহার করা চেষ্টা করেছেন যা অত্যন্ত স্বার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ
প্রত্ন-প্রতিমা
চাঁদ-বিছানা
উড়াল-আচল
ঘাম-সুরভি
এগুলো চমৎকার ভাবে উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরো কিছু যেমন
দামের চুলায় আগুন দিতে
কাজের খোলস পরাই
কথার বাঁধা পাহাড় সেজে
এমনি অনেক সূক্ষ্ম কাজ চোখে পড়ে। এই সব ধরতে পারা, বুঝতে পারার মধ্যেই রয়েছে পাঠকের আনন্দ। আমি আশা করবো পাঠকশ্রেনি এই অনাবিল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। সংক্ষেপে বইটি সম্পর্কে জানিয়ে শেষ করছি 'হৃদয়পুরে দেশান্তরী'র পাঠ পরিচিতি।
কবিঃ এ, টি, এম, মোস্তফা কামাল
বইয়ের নামঃ হৃদয়পুরে দেশান্তরী
প্রকাশকঃ অনুপাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ নবী হোসেন
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
প্রকাশ কালঃ নভেম্বর ২০১৪
উৎসর্গঃ মাহফুজা খন্দকার তিথি (কবির অর্ধাঙ্গিনী)
সবাইকে বইটি কিনে পাঠের অনুরোধ রইলো। সকলে ভালো থাকবেন, সুন্দর থাকবেন। বইমেলায় এসে বই কিনবেন। ভালো বই কিনবেন। এতে ভালো লেখক আরো ভালো কিছু সৃষ্টিতে উৎসাহী হবে। ধন্যবাদ।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর
বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন