বাসায় ফিরছিলাম । আমার শহরের হিসেবে রাত মোটামুটি গভীরই হয়ে গেছে বলা যায়, ১২ টার কাছাকাছি । ক্লান্তিকর জ্যাম পেরোনোর পর ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাস মোটামুটি উড়ে চলছে । খোলা জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস, কানের হেড ফোন হালকা সাউন্ডে বাজতে থাকা গান ..... সুন্দর পরিবেশ । সিটে হেলান দিয়ে বেশ ভালো ঝিমুনির মতো চলে আসছিলো, পকেটে রাখা মোবাইলটার ভাইব্রেশনে তা কেটে গেলো । ঘুম ঘুম অবস্থায় থাকার পরও ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে যা শুনলাম তা প্রথমবারেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম । তবুও অবিশ্বাসের কণ্ঠে দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলাম
-- কি বললে ?
- - খালিদ , হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন ।
কি অবিশ্বাস্য একটা কথা! প্রিয় মানুষ গুলোর চলে যাওয়া এতই সহজ ? ফোনটা কানে ধরে রেখেই আকাশের দিকে চোখ চলে গেলো । নাহ , আকাশে সেদিন শুক্লপক্ষের কোন চাঁদ আমার চোখে পড়ে নি , আমি কেবল অন্ধকারই দেখলাম । হঠাৎ করে মনে হলো বাসটা খুব আস্তে আস্তে চলছে , আমি যেন কানের পাশ দিয়ে কেটে যাওয়া বাতাসের প্রতিটা শীষের শব্দে অন্য কিছু শুনতে পারছি । পাশে বসা বন্ধুটাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালাম । সে একটু অবাক হয়ে জানতে চায় চলে এসেছি কিনা ? তিনবারের চেষ্টায় বলতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন । এই চারটা শব্দ উচ্চারণ করতে আমার বুকটা ভেতরটা কে এক সীমাহীন শূন্যতায় ভরে গেলো তা যদি আমি কোন দিন কাউকে বলে বুঝাতে পারতাম ? .......... চারপাশটা কেমন যেন অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো । আমি জানলা দিয়ে আরও একবার আকুল হয়ে মাথা বের করে আকাশের সব কোনে চাঁদকে খুঁজি । সে আজ নেই । অথচ মানুষটা কতো চাঁদের জন্য পাগল ছিল ! কি এমন ক্ষতি ছিল তার আজ আদিগন্ত ফিনিক ফোঁটা রুপালি জোছনায় ভাসিয়ে দিয়ে আকাশ আলো করে রাখলে ? কি এমন ক্ষতি ছিলো ?
বাসের আবছা অন্ধকারে দেখলাম আমার বন্ধুর গাল চিকচিক করছে । মানুষ কার জন্য কাঁদে ? খুব আপন জনদের জন্যেই । আর ২২ – ২৩ বছরের ছেলেদের কান্না খুব বড় ব্যাপার । কারণ এরা সহজে কাঁদে না, কষ্টে বুক ভেঙ্গে গেলেও বাইরে স্বাভাবিক থাকার গুন এদের মধ্যে দেখা যায় যা অন্য বয়সীদের মধ্যে হয়তো অতটা নেই । এবং ছেলেরা কখনো সমবয়সী ছেলেদের সামনে কাঁদে না । কিন্তু আমার বন্ধু সে দিন নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি ....... হুমায়ূন আহমেদ স্যার, আপনাকে কখনো চোখের সামনে দেখি নি, আপনি আমাদের রক্তের সম্পর্কেরও কেউ নন । তবুও আপনি আমাদের কাছে সেই মানুষ যার জন্য আবছা অন্ধকারে বসে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলা যায় । আপনি সেই মানুষ যে আর পৃথিবীতে নেই শুনলে বুকের ভেতরটা সীমাহীন শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে । আমি কেন যেন কাঁদতে পারলাম না, চোখে পানি আসলো না । অথচ খুব ইচ্ছা করছিলো নিজের ভিতরের বোঝাটা কেঁদে একটু হালকা করি । আমি পারি নি । আমি ছোটবেলা থেকেই কিছুটা আবেগশূন্য মানুষ , তবু সে রাতে আমারও ইচ্ছা করেছিলো চিৎকার করে কাঁদি ।
বই মেলায় গেলাম । ইচ্ছা ছিল না । আপনি নেই , কার জন্য যাবো , কেন যাবো? তবুও হয়তো আপনার স্মৃতির কথা ভেবেই গিয়েছিলাম । হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চোখে পড়লো বিশাল বড় এক ব্যানারে আপনার ছবি । সেখানে লেখা –
“ নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,
রয়েছ নয়নে নয়নে। “
সেদিন আর নিজের ভেতরের বাঁধটা টিকলো না । দুচোখ ভিজে উঠলো অশ্রু বিন্দুতে । সে অশ্রু আমি হাজারো মানুষের সামনে থেকেও মুছি নি । কেন মুছবো ? আমি কেঁদেছি আমার খুব প্রিয় একটা মানুষের জন্য , যে আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, যে ভাবতে শিখিয়েছে পৃথিবীটা আসলে কেবল হতাশারই জায়গা না; এখানে আজও স্বপ্ন দেখা যায়, ভালবাসা যায় ।
আপনি চিরদিনই আমাদের মাঝে রয়ে যাবেন । .... যেখানেই থাকুন না কেন , ভালো থাকুন । আমিন ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



