somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউ: ঐতিহ্যের ধামাইল গান

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সবুজের সমারোহ, পাখির কিচিরমিচির আর নদী-খাল-বিলের টলটল জলের পরশলাগা এক গ্রামে জন্ম আমার। ছবির মতো সেই গ্রাম। এখনও গাড়ীর কালো ধোঁয়া গ্রামের সবুজ পাতাকে ধূসর করতে পারেনি। এখনও গ্রামের সহজসরল মানুষের ভোরের ঘুম ভাঙে কাকের কর্কশ কা-কা ডাক শুনে। মানুষ স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নের বিস্তৃতি এই গ্রামকে ঘিরেই।

------- শুরুটা এভাবেই। পার্থ তালুকদার তার ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’ বইয়ের শুরুতেই আমাদের চোখের সামনে ছবি আঁকছেন এক অপরূপ গ্রামের। যেখানে তার জন্ম। যেখানে তার বেড়ে ওঠা। আর যেখানে মানুষেরা স্বপ্ন দেখে নিজ গ্রামকে ঘিরে। যে গ্রামের শিশুরা মা-মাসীদের কোলে বসে ধামাইল গান শোনে আনমনে। যেখানে বিয়ে বাড়িতে ধামাইল গান শুনে শ্রোতাদের রাত ভোর হয়। আকুল হয় হৃদয়। ভালোলাগায়, তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মন। কিন্তু এই ধামাইল গান কী? কখন গাওয়া হয়? কারা গায়? কী নিয়ে এই গান রচিত?

এসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর পার্থ তালুকদারের বই ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’

পার্থ তালুকদার তার বইটিতে লিখেছেন, সাধারণত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যেমন ঝুলন যাত্রা, রাস যাত্রা, হোলি, শিশুদের অন্নপ্রাসন, সাধভক্ষণ, গৃহপ্রবেশ, সূর্যব্রত ইত্যাদিতে ধামাইল গানের প্রচলন থাকলেও হিন্দু সম্প্রদয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গানের আধিক্য বেশি। বিশেষ করে বিয়ের আগের রাত অর্থাৎ অধিবাসের রাতে ধামাইল গানের প্রচলন বেশ লক্ষণীয়। এই গানগুলো সাধারণত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নির্ভর হয়ে থাকে। যদিও বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন ধরনের অসংগতি তুলে ধরে লেখকগণ অনেক গান রচনা করেছেন।

তার লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি, ধামাইল গানের জগত সম্পর্কে। জানতে পারি রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহনির্ভর এই গানের পেছনে জড়িয়ে আছে কতো কতো নাম, কতো মমতা, ভালোবাসা। ধামাইল গানের ভাব ও বৈচিত্রের উপর ভিত্তি করে বইটি অনেকগুলো ছোট ছোট অধ্যায়ে বিভক্ত। যেমন-

শুরুর কথা---প্রার্থনা---আসর---গৌররুপ---শ্যামরুপ---বিচ্ছেদ---বাঁশি---কোকিল সংবাদ---দূতী সংবাদ---স্বপন---অভিসার---জলভরা---জামাইস্নান---খেদ---সাক্ষাত খেদ---মান ভঞ্জন---প্রভাতী খেদ---চন্দ্রার কুঞ্জ---মিলন---বিদায়---আউট গান।

আমরা বইটি থেকে জানতে পারি যে, ধামাইল গান মূলত সিলেট অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয় হলেও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ বিশেষ করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকটি উপজেলায় এই গানের প্রচলন লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচরে ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে।

আর একটি মজার তথ্য হলো এই গানে ঢোল ছাড়া তেমন কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় না। গুরুবন্দনা বা প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় ধামাইল গানের আসর। এরপর রাঁধা-কৃষ্ণের প্রেম বিরহের বিভিন্ন অবস্থা ও অনুভূতিকে অবলম্বন করে একে একে গান পরিবেশন করা হয় ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত। বিভিন্ন শিল্পী ও গীতিকার তাদের নিজেদের লেখা ধামাইল গানও পরিবেশন করেন। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকেন সেসব আন্তরিক গান শ্রবণে।

আমি ডাকি কাতরে,
উদয় হওরে দীনবন্ধু, হৃদয় মন্দিরে
তোমার ভক্তের সঙ্গে প্রেম তরঙ্গে করুণা কইরে।।

---------- ভাবুককবি রাধারমণ

প্রথমে বন্দনা করি গুরুপদ স্মরি
গুরুতো মনুষ্য নয় গো প্রকাশ গোলক হরি।।
অখণ্ড মন্ডালাকার যিনি জগত ভরি।
তাহাঁর পদ দেখান গুরু তাকে প্রণাম করি

----------- কাশীনাথ তালুকদার


‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান' বইটির একটি অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে – এতে যেমন অসংখ্য শিল্পীর রচিত ধামাইল গান উল্লেখিত হয়েছে তেমনই সেসব স্বল্পপরিচিত প্রচারবিমুখ শিল্পীদের সম্পর্কেও গল্পের ভঙ্গিতে কথাচ্ছলে বেশ অনেক তথ্যই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন প্রিয় পার্থ তালুকদার।

শ্রদ্ধেয় কাশীনাথ তালুকদার, সুনীলচন্দ্র দাশ, লেখক স্বপন কুমার, দ্বীজেন্দ্র দাশ তালুকদার, আশীষ দেব, লেখক রবীন্দ্র, ধামাইলপ্রেমিক প্রতাপরঞ্জন, শরতচন্দ্র দাস, রামজয় দাশ, প্রবীর দেবনাথ, শিখা রাণী দাশ, আবদুর রহমান, আব্দুল আজিজ, অরুণ বাবু, ফকির শিতালং শাহ, শ্রী অধরচান্দ, হরিপদ চন্দ, সুজিত কুমার চৌধুরী, মহেন্দ্র বাবু, রামজীবন, কাঙাল দয়ানন্দ, আরকুম শাহ, বাউল সম্রাট আবদুল করিম, রাধারমণসহ আরো অনেক চেনাজানা-অচেনা-অজানা শিল্পীর হৃদয়ছোয়া ধামাইল গান বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেগুলো পাঠে আমাদের মন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে। আর আমরা ডুবে যাই বাংলার এক অসাধারণ ঐতিহ্যবাহী গানের জগতে।

তবে ধামাইল শিল্পীরা স্বভাবতই প্রচারবিমুখ। তারা নিভৃতে থাকতেই ভালবাসেন। প্রচারবিমুখ ধামাইল শিল্পীদের সম্পর্কে পার্থ তালুকদার বলেছেন, আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, অধিকাংশ গীতিকারের প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ কোনো ডিগ্রী না থাকলেও শুধু মনের টানে ও সাধনার মাধ্যমে পল্লীতে বসেই আমাদের প্রাণোপ্রিয় এই ধামাইল গানগুলো সযতনে রচনা করেছেন। যা গ্রামের কাদামাখা দুষ্টু ছেলে কিংবা সাধু জনেরাও তাদের মনের অজান্তেই গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন।

কোকিল কইও গো কইও গো বন্ধেরে
তার লাগিয়ে বিষম জ্বালা,
আমার অন্তরে।।

মনে থাকে মনের কথা
বুকটা জুড়ে প্রেমের ব্যথা গো
আমার হৃদয় পুড়ে পিরীতেরও জ্বরে
আসো বন্ধু শেষবারে, দেখি নয়ন ভরে ।।

--------- সঞ্জয়নাথ সঞ্জু


রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনীকে উপজীব্য করে রচিত এই ধামাইল গান বহুবছর ধরে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাঙালির প্রাণ। বাঙালির ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে চুনিপান্নার মত জ্যোতিতে উজ্জ্বল এই গানগুলো। আধুনিক ব্যস্ত সময়েও তাই গানগুলোর আবেদন ফিকে হয়ে পড়ে না। বরং আমরা নাগরিক ব্যস্ততার অবসরে এ গানের সুরে মনকে ভাসিয়ে নিতে পারি অনায়াসেই। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এই গানকে ছড়িয়ে দেবার ও আনুসাংগিক কিছু তথ্য দেবার প্রয়াস থেকেই পার্থ তালুকদার লিখেছেন তার এই গবেষণাধর্মী অনন্য বই ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’।

বইটি সম্পর্কে –



নাম: ঐতিহ্যের ধামাইল গান
লেখক:পার্থ তালুকদার

প্রচ্ছদ: মোবারক হোসেন লিটন
প্রকাশনী: রোদেলা প্রকাশনী
মূল্য: ১৫০ টাকা

যেখানে পাওয়া যাবে –

‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’ বইটি একুশে বইমেলায় ‘রোদেলা প্রকাশনী’র স্টলে পাওয়া যাবে।
পরবর্তীতে বিভিন্ন জেলাশহরের বইয়ের দোকানে পাওয়া যাবে।
এছাড়াও সরাসরি লেখক পার্থ তালুকদার এর সাথে যোগাযোগ করা যাবে।
লেখকের মোবাইল নং – ০১৯১৯৮৮৬২২২

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৬
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×