somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষের মহারাজা,তোমাকে অভিবাদন

১৪ ই জুন, ২০০৮ সকাল ৭:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



[মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার প্রতি,তাঁর জন্মদিনে]

মহারাজ কথাটা তাঁর নামের সাথে একেবারেই যায়না,অন্তত,আর্নেস্তো চে গুয়েভারা নামটার সাথে যায়না। ঔপনিবেশিক মহারাজদের প্রভুত্ব থেকে মুক্তি দিতেই পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুটে বেড়িয়েছেন যিনি,তাঁর নামের সাথে বাড়তি কোন প্রভুত্বসূচক বিশেষণ জুড়ে দিলে তাঁকে অপমান করা হয় কিনা সে বিতর্কও আসতে পারে। তারপরেও কাউকে কাউকে আলাদা আসনে বসাতে হয়,বসে যায় কেউ কেউ নিজ থেকেই,বসতে না চাইলেও। চে গুয়েভারা কোথায় আলাদা হয়ে গেছেন,সেটা নিয়ে নতুন করে আলাপ না করলেও হবে,সবাই জানে,জানত তাঁর মিত্ররা,জানত শত্রুরাও,ভক্তরা তো জানবেই। শুধু এটুকু বলা যায়,নাম না বলে চে'র জীবনী কাউকে পড়ে শোনালে,হঠাৎ মনে হবে,রূপকথা শুনছি,এমন মানুষ থাকতে পারেনা,এমন জীবন কারো হয়না। রূপকথার রাজকুমারের মত পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী রাক্ষস বধ করে করে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছেন তিনি,তখনো মাথা উঁচু করে,রাজার মতই।

জন্ম আর্জেন্টিনায়,মৃত্যু বলিভিয়াতে,মাঝে চষে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী,যেখানেই মানুষ ডাক দিয়েছে,সেখানেই ছুটে গেছেন লড়তে। পেশায় ডাক্তার,নেশায় বিপ্লবী বলাই মনে হয় ঠিক হবে। অন্তত আমরা বলতে পারি,কারণ চে গুয়েভারা নামটা বললেই যে ছবিটা চোখে ভাসে সেখানে দেখি জলপাই সবুজ সামরিক সাজে মাথায় সামরিক টুপিতে মুখে চাপদাড়িতে লম্বা এলোমেলো চুলের কাউকে,দৃষ্টি প্রসারিত অনেক অনেক দূরে কোথাও। চেহারা হয়তো প্রকৃতিদত্ত ব্যাপার কিন্তু সেক্ষেত্রেও চে কে বিপ্লবী তরুণের আইকনই বলতে হবে।ছোটবেলায় যখন প্রথম চে'র ছবি দেখতাম,মুগ্ধতায় মনে হত,এই মানুষটা তো নায়ক হতে পারত,বনে-বাদাড়ে ঘুরে জীবনটা কাটাল কেন? নায়ক হয়েছেন চে,সস্তা কোন সিনেমার নয়,মানুষের নায়ক,মহাকালের নায়ক। অদ্ভুত জীবন তাঁর। যৌবনে ঘুরেছেন পুরো দক্ষিন আমেরিকা,বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর 'মোটরসাইকেল ডায়েরি'তে। বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিয়েছেন গুয়াতেমালা,মেক্সিকো,কিউবাতে। বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করেছেন বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে মিলে,কিন্তু কিউবা তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। ছুটেছেন কঙ্গো,বলিভিয়া সহ পৃথিবীর নানা কোণে। বিপ্লবের তত্ত্ব নিয়ে বসে না থেকে নিজেই হাতে অস্ত্র তুলে মাথাব্যথা হয়ে গেছেন দুনিয়ার তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী আর তাদের তাঁবেদার সরকারের। তাঁর দেশ কোথায়,এর জবাবে বলেছেন,দুনিয়ার তাবৎ নিপীড়িত মানুষের দেশই তাঁর আবাস। কিউবার প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে সগর্বে ঘোষণা করেছেন--"যে সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দুর্বল ভাবত,আজ তারাই আমাদের ভয়ে ভীত,ভীত তারা ২০০ মিলিয়ন দুর্বল ল্যাটিন আমেরিকানের ভয়ে,যাদের হাতে আজ একচ্ছত্র 'ইয়াংকি'
পুঁজিবাদের কবর খোঁড়া হবে।" বুক কাঁপানোর মত ঘোষণাই বটে,অন্তত,হাতে-কলমে যে একবার করে দেখিয়েছে,তাঁর কাছ থেকে এলে তো অবশ্যই।

না,সাম্রাজ্যবাদীরা এই হুমকিকে হালকাভাবে নেয়নি কখনোই,পাগলা কুকুরের মতই চে'কে খুঁজে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশে। কিউবার আশ্রয়ে থাকেননি চে,মানুষের টানে আবার তিনি ঘর ছাড়েন,বন্ধু ক্যাস্ট্রোকে এক চিঠিতে তাঁর শুভকামনা এবং সমর্থন জানিয়ে। ব্যর্থ এক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন কঙ্গোতে। এরপর তানজানিয়া,প্রাগ হয়ে বলিভিয়া,জীবনের শেষ বিপ্লব,শেষ গন্তব্য। সিআইএ এজেন্টদের সহায়তায় বলিভিয়ার স্বৈরাচারী সরকারের হাতে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন,কোন ঝুঁকিতে না গিয়ে,কাপুরুষরা চে'র মৃত্যুতেই তাদের রাস্তা নিষ্কন্টক করার উপায় খুঁজে নিল। মৃত্যুর আগেও মাথা উঁচু করেই বলেছিলেন--"গুলি কর কাপুরুষ,তোমরা শুধু একজন মানুষকেই তো মারতে পারবে।"

সময়টা ছিল ১৯৬৭ সাল,যখন চে'র মৃত্যু হয়। এরপর পৃথিবীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে,চে'র স্বপ্নের কম্যুনিস্ট দেশগুলোর অনেকেই পুঁজিবাদে নিজেদের মুক্তি খুঁজে নিয়েছে,টুকরো হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন,পূর্ব ইউরোপেও কম্যুনিজম আজ মিউজিয়ামের বস্তু,মার্কিনি পা-চাটা শাসকরা জাঁকিয়ে বসেছে আরো অনেক দেশেই। কম্যুনিস্ট নেতাদের আদর্শচ্যুতি হতাশ করেছে মানুষকে দিনে দিনে,রাশিয়ার পলিটব্যুরোর সদস্য যখন নিজে ব্রিটিশ স্কচ হজম করে জনগণকে সাম্যবাদের মুলা ঝুলায় তখন সেটায় আস্থা রাখা একটু মুশকিল বৈকি। মানুষের মুখপাত্র ছিলেন চে,তাঁর লড়াই তো ছিল মানুষের হয়ে অমানুষের বিরুদ্ধে,তাঁর আদর্শের কথা বলেও কি কেউ মানুষের নেতা হতে পেরেছে? অমানুষ তো শুধুই সাম্রাজ্যবাদীরা নয়,কম্যুনিস্ট রাশিয়া যখন আফগানিস্তানে বা চেচনিয়াতে
হত্যাযজ্ঞ চালায় তারাও তো একি কাতারেই শামিল হয়,যখন আমাদের দেশের সমাজবাদী নেতা অর্থের লোভে বিক্রি হয়ে যায় বড় দলের কাছে তাদেরো আমি অমানুষই বলি। নেমেসিস কথাটা শুধু গল্পেই পাওয়া যায়,সেজন্যই চে'র হত্যাকারীর মাথায় বাজ পড়েনি,তাঁর পেছনে ছুটতে থাকা পাগলা কুকুররাও এখন পৃথিবীর সম্রাট হয়ে বসে আছে,নতুনযুগে নতুনভাবে উপনিবেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে লাভের হিসাব মেলাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা। চে এখন ব্যবসার সামগ্রী,তাঁকে নিয়ে লেখা হয় হাজার হাজার লেখা,তাঁর ছবি আঁকা টিশার্ট মগ পোস্টার বিক্রি করে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে তাঁরই হত্যাকারীরা,আধুনিক ফ্যাশনসচেতন
তরুণ বয়সের ট্রেন্ড হিসেবে বুকে চে'র ছবি আঁকা টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়,অবসরের বিলাসিতা হিসেবে সুদর্শন চে'র ছবি টানিয়ে রাখে ঘরের দেয়ালে,কিন্তু ক'জন তার হৃদয়ে টানিয়ে রাখে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি?

তাহলে কি চে হেরেই গেলেন? যে বিপ্লবকে কখনো হত্যা করা যাবেনা বলেছিলেন,তার কবর কি খোঁড়া হয়ে গেছে? অতি আশাবাদী হয়ে অর্বাচীনের মতই বলি,না। জীবিত চে'র চাইতে নিহত চে অনেক বেশিই জিতে গেছেন।টিকে আছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর কিউবা নিয়ে,ভেনেজুয়েলাতে তাঁরই ভাবশিষ্য হুগো শ্যাভেজ উঠে এসেছেন,যে বলিভিয়ার সরকার হত্যা করেছিল চে'কে সেখানেই আজ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছে আদিবাসী কৃষক নেতা ইভো মোরালেসের,এটা কাকতালীয়,নাকি এটাই হবার কথা ছিল? চে'কে কেউ ভুলে যায়নি,প্রতি মুহূর্তেই তাঁকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হচ্ছে,ভাবাতে হচ্ছে। জীবিত চে'কে দেশে দেশে ছুটতে হতো সশরীরে তাঁর অস্ত্র নিয়ে,মৃত চে তাঁর আদর্শ নিয়ে ভেসে বেড়ান আরেক জগৎ থেকেও,ঠিক যেমনটি তিনি বলেছিলেন,তোমরা শুধু একজন মানুষকেই হত্যা করতে পারবে। নেলসন ম্যান্ডেলা যাঁকে বলেছেন প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের অনুপ্রেরণা,জাঁ-পল সাঁর্ত্রের ভাষায় যিনি তাঁদের যুগের সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানব,কিউবান শিশুরা প্রতিটা সকাল শুরু করে যাঁর নামে শপথ নিয়ে--"আমরা চে গুয়েভারা হবো"-ক'টা বুলেট দিয়ে তাঁকে মুছে ফেলবে সাধ্য কার? বলিভিয়াতে চে'র নাম সেইন্ট আর্নেস্ত,সন্তের মর্যাদা যে তাঁকে বেমানান,এমন তো বলতে পারি না।মানুষের জন্য জীবনপাত করা ক্ষমতার দিকে নির্লোভ মানুষটা সন্তের চেয়েও মোহমুক্ত ছিলেন,সেইন্ট আর্নেস্ট তো তাঁকেই বলা হবে। চে'র নাম এখনো সাম্রাজ্যবাদীদের ভুরু কুঁচকে দেয়,রাতের ঘুম নষ্ট করে ঔপনিবেশিকদের।বিপ্লব নেই,বিপ্লব করার মানুষগুলোও নেই,তারপরেও ঘোর অন্ধকারে একটুকরো আগুনের রেখা দেখায় আমাদের কাছে চে'র নাম,সাম্রাজ্যবাদীদের লোভ আর প্রভুত্বের অবিচারে বিধ্বস্ত হতাশ কোন ক্রুদ্ধ রাতজাগা তরুণ পৃথিবীর আনাচে কানাচে এখনো হাত মুঠো করে নিজের অজান্তেই বলে ওঠে--"আমি চে গুয়েভারা হবো।"

এখানেই চে আবারো জিতে গেছেন,চে গুয়েভারা ফিরে ফিরে এসেছেন,চে গুয়েভারা ফিরে ফিরে আসবেন,চে'র মৃত্যু নেই।

মানুষের মহারাজা,তোমাকে অভিবাদন।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০০৮ দুপুর ১:১৪
২৮টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×