somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উচ্চশিক্ষার অধিকার এবং বেনিয়াদের ধান্দাবাজিঃ প্রসঙ্গ জগন্নাথ

০১ লা অক্টোবর, ২০১১ রাত ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় আইন করে দেয়া হয়েছিল, একটা নির্দিষ্ট সময় পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করবে। ভাল কথা, দেশ যেমন স্বনির্ভর হতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই শুরু হোক না! কিন্তু বেয়াদব ছাত্র-ছাত্রীরা বেঁকে বসেছে, তারা কিছুতেই বাড়তি পয়সা দেবে না। এই নিয়ে ভাঙচুর, হট্টগোল, ছেলেমেয়েদের উপর পুলিশ আর সরকারী ছাত্রগুণ্ডাদের হামলা, সব মিলিয়ে রমরমে খবর। জনগণ ২ ভাগ হয়ে গেছে, একদল বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পয়সা কি, সরকার কি ঘাস কাটে? আরেকদল, যাদের ট্যাঁকের জোর বেশি, তারা বলছে, শিক্ষা বিনা পয়সায় কেন আসবে? পারলে "খাইট্টা খা", মানে কিনা, পয়সার জোর না থাকলে, এইচএসসি পাশ করে কারিগরি শিক্ষায় ঢুকে পড়ো, দেশ-জাতির উন্নয়ন করো, সেই উন্নয়নের জোয়ারে আমরা জাহাজ ভাসাই।

এবার একটু অন্যদিকে তাকাই। আজকের পত্রিকার খবর-- "কর দেবেন না মন্ত্রী-সাংসদরা।" নাও সামলাও এবার, ২ পয়সার কর্মচারীরাও কর দেবে কিন্তু মহান নেতারা দেবেন না, তারা যে আমাদের ভোটে দেশ-জাতি উদ্ধারের ইজারা পেয়েছেন। দেশের সব লোক গাড়ি আমদানি করলে ৪০০% শুল্ক, হুজুররা করলে শুল্ক মাফ। নামে-বেনামে থাকা তাদের নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা কত হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেন সেটা বাদ-ই দিলাম, কিন্তু এই সরকারী বেতন-ভাতার উপরও নির্লজ্জের মত করটা মওকুফ করিয়ে না নিলে তাদের হচ্ছিলো না। এখানে আবার মজার বিষয় আছে, সারাবছর আমাদের দু'দলের নেতা-নেত্রীরা একে অপরের মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করে থাকেন, কিন্তু বেতন-ভাতা বৃদ্ধি বা কর-শুল্ক মওকুফের বেলায় সব সুড়সুড় করে এক বাক্সেই ভোট দেন, এমনকি বিরোধিতার খাতিরেও কেউ বিরোধিতা করেন না। কতখানি বেহায়া হতে হয় এই দেশে রাজনীতি করতে হলে?

আবার প্রথম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমজনতার যেকোন দাবীকে যেকোন সরকারই সন্দেহের চোখে দেখে থাকে, আমাদের দেশের সরকারগুলো আরো এক কাঠি বেশি সন্দেহবাতিকগ্রস্থ, মানুষের যে কোন দাবীকেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। সরকারপ্রধানদের কানে পানি ঢালার জন্য সুবিধাবাদী চাটুকারদেরও অভাব হয় না, কাজেই জগন্নাথের ছাত্রদের প্রতিবাদে সরকারের প্রতিক্রিয়াও আশার বিপরীত কিছু হয়নি, পুলিশ নামিয়ে এবং সাথে দলীয় ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী নামিয়ে বেয়াদব পোলাপানকে আচ্ছামত শায়েস্তা করা হয়েছে। সরকারের এধরনের প্রতিক্রিয়ায় আজকাল আর অবাক বা হতাশ কোনটাই হই না, অনেক আশা নিয়ে ভোট দিয়ে বোকা জনগণ বুটের লাথি খাবে এটাই নিয়ম হয়ে গেছে, এবং যতদিন এসব আবর্জনাকে ছুঁড়ে ফেলার মত বুদ্ধি তাদের মাথায় না গজাবে ততদিন এই লাথি তাদের পাওনা বলেই মনে করি, পৃথিবীটা বোকাদের জায়গা না। কিন্তু হতাশ এবং আতঙ্কিত হই, যখন আন্তর্জালের শিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণীর লোকজন "অর্থের বিনিময়ে উচ্চশিক্ষা" জাতীয় ধারণা নিয়ে কোমর বেঁধে নামেন, আর নানারকম উচ্চমার্গের যুক্তি আর রেফারেন্স দিয়ে সেটাকে জায়েজ করার চেষ্টায় প্রাণপাত করেন।

এই শ্রেণীর লোকজনের যুক্তিগুলোর ২-১টা নমুনা দেয়া যাক। প্রথম ও প্রধান যুক্তি, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, উচ্চশিক্ষা নয়, সেটা "প্রিভিলেজ" বা সুবিধা। আরেকটা হলো, দেশের সরকারের টাকা নেই, এত টাকা উচ্চশিক্ষায় ব্যয় করে শিক্ষিত বেকার বাড়ানোর কোন মানে নেই, তারচেয়ে এই টাকা প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় করা ভালো (আহা, কত দরদ!)। আরো একটা হলো, আমেরিকার সব বিশ্ববিদ্যালয় তো নিজের খরচে চলে, আমরা পারবো না কেন? বেশ, খুবই চমৎকার সব যুক্তি, দেখা যাক এগুলোর পেছনে সারবস্তু কতটুকু। প্রথমেই, উচ্চশিক্ষা মৌলিক অধিকার নয়, গরিবের জন্য ওটা বিলাসিতা, ঐ জিনিস শুধু বড়লোকদের অধিকার। বটে? তোর বাপের পয়সা আছে বলে তুই সব খাবি, আমার বাপের নেই বলে আমি দু'পাতা বেশি পড়তে পারবো না? মহোদয়গণ, যে পয়সায় আপনি উচ্চশিক্ষা কিনতে চান, সেটা কি আপনি জন্মের সময় পকেটে করে নিয়ে এসেছেন? বাপের পয়সায় এমন ফুটানি যে অন্যদেরকে উঠতেও দেবেন না, সব নিজেই খাবেন? দেশের সব সম্পদ এবং সুবিধা একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শ্রেনীর ভোগ করার বন্দোবস্তকে পাকাপাকি করে ফেলার এই বু্দ্ধি অনেক আগেই ব্রিটিশরা আমাদের দিয়ে গিয়েছিল, এখন তাদেরই উত্তরাধিকারী বিশ্বব্যাংকের কূটচাল সফল করার জন্য হায়দরাবাদের নিজাম আর মীরজাফরের প্রেতাত্মাদের মাঠে নামতে দেখে খানিকটা আতঙ্ক বোধ না করে উপায় থাকে না। দোযখের বাঙালির কড়াইতে যে দারোয়ান লাগে না, এবং সামান্য হাড্ডি পেলেই যে আমরা স্বজাতির গায়ে কামড় বসাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না, এটা বেনিয়ারা অনেক আগেই বুঝেছিল আর সে বোঝাতে যে কোন ভুল ছিল না, নিজেরটুকু আদায় করে নিয়ে অন্যের অধিকার বন্ধ করে দেয়ার পক্ষের দালালদের গলাবাজিতে সেটা স্পষ্ট।

এরপরের যুক্তিটা আরো হাস্যকর, সরকারের টাকা নেই, কাজেই শিক্ষাখাতে ভর্তুকি কমাও। ঠিক ঠিক, দেশে আরো অন্তত ১০০ টা লোকসানি খাত আছে, সব বাদ দিয়ে কিনা শিক্ষাকেই ধরতে হবে। প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল ব্যয় হয়, একটু কাটছাঁট করা হোক, বাংলাদেশ বিমান বিশাল অংকের লোকসান দেয়, সেটাকে লাভজনক করা হোক, যত বড় ব্যবসায়ী আছে, প্রতি বছর তারা কয়েক হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে থাকে, প্রকাশ্যেই ফাঁকি দেয় বলা যায়, সেসব বকেয়া কর আদায় করা হোক, আদায় করা হোক সকল খেলাপী ঋণ। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের দুর্নীতি বাদ-ই দিলাম, শুধুমাত্র উপযুক্ত লোকসানি খাত সনাক্ত করে সেগুলো কিভাবে লাভজনক করা যায় সেই পরিকল্পনা নিলে এবং বড় অংকের কর ফাঁকিগুলো ধরলেই এরকম কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় রাজার হালে চালানো যায়। সেটা না করে, কোন খাত লোকসান দিলেই সেটা বন্ধ করে দেয়া মানে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা। এখানে উল্লেখ করা যায় আদমজীর কথা, ইউনিয়নবাজি আর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে আদমজী বন্ধ করে দেয়া হলো এমন একটা সময়ে, যখন বিশ্ববাজারে নতুন করে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা দেখা দিচ্ছে। চাইলেই যে খাতটিকে অন্যতম লাভজনক শিল্পে পরিণত করা যেত, বেনিয়াদের সুপারিশে সেটা বন্ধ করে সেই বাজারটা তুলে দেয়া হলো ভারত এবং শ্রীলঙ্কার হাতে। তাছাড়া বড় কথা হলো, শিক্ষা কি কোন ব্যবসা খাত যে এটায় লাভ-লোকসান দেখতে হবে?

শেষ যুক্তিটা সবচেয়ে হাস্যকর, আমেরিকাতেও তো উচ্চশিক্ষা বিনা পয়সায় হয় না। কথা সত্যি, তবে ফাঁকি আছে। আমেরিকার সরকারি বেসরকারী সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিপুল পরিমাণে গবেষণা তহবিল আসে, ছাত্র-ছাত্রীদের সেটা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সুযোগ আছে। আমেরিকা সেভাবে জনশক্তি রপ্তানি করে না, ওদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাইরে গিয়ে দেশের নাম ফাটাবে, এমন লক্ষ্যও তাদের নেই। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বের হয়ে বেকার ঘুরে বেড়ায় না, এদের অনেকেই পশ্চিমা দেশগুলোরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সাথে কাজ করছে। এসব ছেলেমেয়ের অনেকেরই নিজের পয়সায় উচ্চশিক্ষা নেয়ার সামর্থ্য ছিল না, এই "অর্থের বিনিময়ে উচ্চশিক্ষা"র নীতি অনুসরণ করলে ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে উন্নত জীবন পাবার বদলে এদের অনেককেই এখন মোটর গ্যারেজে সেইসব অর্থবিত্তবান উচ্চশিক্ষাধারীদের গাড়ী মেরামত করেই জীবন কাটাতে হতো। আর উচ্চশিক্ষার মডেল যদি অনুসরণ করতেই হয়, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মডেল কেন নয় যেখানে উচ্চশিক্ষা অবৈতনিক? কেন বিশ্বব্যাংকের মডেলই নিতে হবে, যাদের মডেল অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত কোন উন্নয়নশীল দেশ কোন দীর্ঘমেয়াদী সুফল পায়নি?

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে এই অধমের ব্যক্তিগত কিছু মতামত আছে। শিক্ষা জিনিসটা কোন বাজারি জিনিস নয় যে সেটা অর্থমূল্যে পরিমাপ করা যাবে। শিক্ষা, সেটা প্রাথমিক হোক আর উচ্চশিক্ষা হোক, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী, এর মুল্য "ফিনানসিয়ালি" বা "অর্থকরী" ভাবে পরিমাপ না করে "ইকোনমিক্যালি" বা "অর্থনৈতিক"ভাবে পরিমাপ করাই উচিত। শিক্ষার উদ্দেশ্য টাকাকড়ি কামানো নয়, জ্ঞান অন্বেষণ এবং আত্মিক উন্নতি, এবং সত্যিকার অর্থে প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি্ষ্ঠার উদ্দেশ্য সেটাই ছিল, সে অতীশ দীপঙ্করের পাঠশালাই হোক আর অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজই হোক। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সব বিষয় পড়ানো হয় যেগুলোর তাৎক্ষণিক আর্থিক মূল্য মাপা সম্ভব নয়। দর্শন বা সংস্কৃত বা প্রাচ্যের ইতিহাস পড়ে কয় টাকা রোজগার হয়? ইজিপ্টোলজি পড়ার কি দরকার? সরবোঁতে যে পাগল ভাষাবিজ্ঞান পড়ে, সে কত টাকা রোজগারের আশায় যায়? ক্যালিগ্রাফির কোর্স করে কি হয়? মজার ব্যাপার হলো,, এই জ্ঞান অন্বেষণের ধারণাটা পশ্চিমারা নিজেদের মাঝে রেখে দিলেও সুকৌশলে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে--"লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে", অর্থাৎ কিনা, পড়াশোনা করার লক্ষ্য হলো পয়সা কামানো। আর সত্যি বলতে কি, পয়সা কামাতে পড়াশোনা না করলেও চলে, বাজারের চালের আড়তদারের পয়সাকড়ি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু অধ্যাপক মশাইয়ের সাথে কথা বলে যে আত্মিক উন্নতিটুকু হয়, চালের আড়তদারের সাথে সারাদিন আড্ডা পেটালেও সেটা হচ্ছে না, এখানেই গোলমাল। কিন্তু আমাদের মাথায় ঢুকে গেছে, লেখাপড়া করতে হবে পয়সা কামানোর জন্য, কাজেই ব্যাঙের ছাতার মত গজাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, আর সেখানে পড়ানোর বিষয় হলো হয় বিবিএ নয়তো কম্পিউটার নয়তো তড়িৎকৌশল, বাজারদর বেশি যে!

সে হোক, বাজারদর বেশি এমন বিষয় পড়ানোতে দোষের কিছু নেই, দক্ষ জনশক্তি খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা বাঁধে যখন এই বাজারি ব্যবসা চালু রাখতে গিয়ে উচ্চশিক্ষার আসল উদ্দেশ্যের ঘাড়ে কোপ মারা হয়। যেহেতু ধারণা ঢুকে গেছে যে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো পয়সা কামানো এবং সেটার জন্য উচ্চশিক্ষার কোন দরকারই নেই, কাজেই পয়সা দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পোষার দরকার কি, দাও বন্ধ করে। স্বীকার করতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি, অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মাঝারি মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ভাল নয়, বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজটমুক্ত অনেকাংশে, রঙচঙও বেশি, কাজেই ভর্তুকি বন্ধ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার খরচ ১০ গুণ করে দিতে পারলে নিশ্চিতভাবেই এসব ছেলেমেয়ে সরকারি বাদ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ভর্তি হবে। লাভ টা কার? পরিসংখ্যান না দিলেও খোঁজ নিলে জানা যাবে, এই ভর্তুকি বাতিলের জন্য যারা কাজ করে যাচ্ছে, তাদের অনেকেরই এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় অংশীদারিত্ব আছে, অনেকগুলোর উপাচার্য বা শিক্ষক বা প্রশাসনিক পদেও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে এসব কুলাঙ্গার। দীর্ঘমেয়াদী সুফল? ছেড়ে দিন না, আগেই তো বলেছি দোযখের বাঙালি কড়াইতে দারোয়ান লাগে না, নিজেরটা খেতে পারলে আমরা কবে পাশের লোকের দিকে তাকিয়েছি? আর বিশ্বব্যাংকের লাভ? হালাকু খান বাগদাদ দখল করে সবার আগে তার গ্রন্থাগার ধ্বংস করে দিয়েছিল, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার আগে মেরে সাফ করে দিয়েছিল এদেশের বুদ্ধিজীবিদের। একটা দেশকে চিরতরে পঙ্গু করে রাখতে চাইলে, একটা চিন্তাভাবনার ক্ষমতাশূন্য মেধাহীন প্রজন্ম গড়ে তোলার বিকল্প আর কি হতে পারে?

সবশেষে একটু নিজের কথা বলি। মোটামুটি নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলে ছিলাম, ছোটখাটো একটা চাকরির বেতনে ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়ার খরচা সামলে বাবা মোটামুটি কষ্ট করেই পড়াশোনা করিয়েছেন, এক সন্তান না হলে পারতেন কিনা সন্দেহ। বুয়েটে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম খানিক, ভর্তি হতে লেগেছে ৩৬০০ টাকা, বছর শেষে দিতেও হয় ওরকম একটা কিছুই। পরের বছর থেকে দেখি সেটা ১৪ হাজার বা ১৫ হাজার হয়ে গেছে, আমার বাবার বেতনের প্রায় সমান, মনে মনে ভাবলাম, যাক বাবা বেঁচে গেছি, স্বার্থপরের মতই। খরচ তেমন নেই, টুকটাক টিউশনি করি, ভালই চলে যায়। টনক নড়লো কিছু সিনিয়র, সহপাঠী এবং জুনিয়রকে দেখে, এমন অনেক ছেলে আছে বুয়েটেও, যাদের বছরশেষে ঐ ৩৬০০ টাকা দিতেও কষ্ট হয়, নিজেকে টিউশনি করে চলতে তো হয়-ই, বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়, কখনো কখনো খাওয়ার কষ্টেও ভুগতে হয়। যারা একটু বেশি মনোযোগী ছাত্র, তাদের পক্ষে বেশি টিউশনি করা কঠিন, এদের অবস্থা না বলাই ভাল, আমার বিভাগের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ফলাফল করা এক বড় ভাই টিউশনি করতেন না, কোনমতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওয়া বৃত্তিগুলো (সেগুলোর পরিমাণও এত কম যে শুনলে লজ্জা পেতে হয় নিজেরও) দিয়ে চলতে হতো। বাকি গল্পটুকু রূপকথার মত, ঐ বড় ভাই আমার বিভাগেরই শিক্ষক হয়েছেন, ঐরকম ছেলেমেয়েরাও প্রায় সবাই দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, এবং এটা শুধু নিজের দেখা অংশটুকুর কথা বলতে পারি, নিশ্চিত করে বলতে পারবো এমন রূপকথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ বছরের ইতিহাসে আরো হাজারবার লেখা হয়েছে, এবং হবে, এবং খুঁজলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এমন গল্প কম পাওয়া যাবেনা। যেসব কুলাঙ্গার বলে উচ্চশিক্ষা মানুষের অধিকার নয়, যারা বলে যাদের বাবার টাকা নেই তাদের উচ্চশিক্ষার দরকার নেই, সেসব সারমেয়শাবকদের কাছে একটাই প্রশ্ন, বুয়েটের ইতিহাসের সর্বোচ্চ সিজিপিএ ধারীদের একজনের কি উচ্চশিক্ষা পাবার অধিকার ছিল না?

বুয়েটে ভর্তির যুদ্ধটা বেশ তীব্র, উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করে শুনে বুয়েটে পরীক্ষা দেবার আগে আরো ২-১টা জায়গায় ভর্তির আবেদন করেছিলাম, একটা ছিল আই ইউ টি। গিয়ে দেখি, ভর্তি হতে লাগে ২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, যার মাঝে ৪ বছরে আবার বেশ খানিকটা ফেরত দেয়া হয়। হিসেব মিললো না, যদিও আই ইউটি-ও চলে ওআইসি'র ভর্তুকির টাকায় এবং অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় খরচটা অনেক কম, তারপরেও এত টাকা? মানে মানে কেটে পড়লাম, বুয়েটে যদি না-ও হয়, অন্য কোন একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা পাবোই এমন আশায়। সুযোগ পেয়েছি, পড়ালেখা শেষ করে প্রকৌশলী হয়েছি, বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করি এখন, বাবা-মায়ের উজ্জ্বল মুখের দিকে যখন তাকাই, নিজের জীবনটা সার্থক মনে হয়, এক জীবনে আর কি চাইতে পারি? তারপর যখন পত্রিকার পাতায় দেখি, আমার মত ছেলেগুলো নিজের অধিকার চাইতে গিয়ে বুটের লাথি খাচ্ছে, আর সুবিধাভোগী শ্রেণীর কিছু বরাহ শাবক, যারা কখনোই বুঝবে না পয়সার জন্য পড়তে না পারার কষ্ট টা কেমন, দাবী করছে যে সামর্থ্য না থাকলে উচ্চশিক্ষার "ঘোড়ারোগ" বাদ দিয়ে কারিগরি শিক্ষায় ঢুকে পড়তে যাতে সারাজীবন তাদের পদলেহন করা যায়, তখন সেই মুখ কালো হয়ে যায়। আমার মত "ফকিন্নির পোলা" দের তাহলে অধিকার নেই "হুজুর"দের কাতারে ওঠার? ব্রিটিশ ভূত তাহলে এখনো আমাদের ছাড়েনি যেখানে প্রভু সর্বদা প্রভু থাকবেন আর দাস থাকবে দাস? আমার মত হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যারা সরকার এবং জনগনের বদান্যতায় নিজের জীবনটা গড়ে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছি, দেশে-বিদেশে থেকে কিছু একটা করার সুযোগ পাচ্ছি, তারা আসলে এতদিন অনধিকার সুযোগ ভোগ করেছে? একদিন আমিও আকাশ ছোঁব, এই স্বপ্ন দেখার অধিকার তাহলে আর কোন সামর্থ্যহীন ছেলে বা মেয়ের থাকবে না?

নিজের ভেতর থেকে জানি যে যদি প্রায় বিনা খরচে উচ্চশিক্ষা নেয়ার এই সুযোগটুকু আমার দেশের সরকার এবং মানুষ আমাকে করে না দিত, এখানে বসে নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এই লেখাটা লেখার সামর্থ্য আমার হতো না, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসও করতে পারতাম না, তাহলে কেন আমরা অন্যের আকাশ ছোঁয়ার সুযোগটুকুকে শুধুমাত্র তার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে রুদ্ধ করে দিতে চাই?

এইটুকু স্বপ্ন দেখার অধিকার দিতে,এইসব সামর্থ্যহীন ছেলেমেয়ের মাঝে যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সেটা বিকাশের সুযোগ করে দিতে তো বিপ্লবী হবার দরকার নেই, মানুষ হলেই চলে।
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×