আমার নিজের ধারনা ছিল আগেকারদিনে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, আর যুদ্ধের ময়দানে ঢাল তলোয়ার আর তীর ধনুক নিয়া দুই পক্ষ হা-রে-রে বলে একে অন্যের উপর ঝাপায় পরত। যার সৈন্য সংখ্যা আর সৈন্যের কোয়ালিটি যত ভাল, দিন শেষে সেই জিতত। কিন্তু ঘটনাচক্রে একদিন আর কিছু পড়ার না পেয়ে সানজু র 'দ্য আর্ট অব ওয়ার' নামের চটি বইটা পড়ে ফেললাম। তের অধ্যায়ের একটা চটি বই। শুরুতে মনে হল ডেল কার্নেগি টাইপ উপদেশের বই, এইটা কইরোনা, ঐটা করলে সেইটা হবে টাইপ।
কিন্তু বই শেষ করার পর আমার প্রথম উপলব্ধি হইল, এই বই খ্রীস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে লেখা!!! কেম্নে কি!!! যুদ্ধে ট্যাকটিক্স বলতে যে একটা জিনিস আছে আর ঐ আমলের লোকেরা যে এই বিদ্যায় কতটা পারদর্শী ছিল তা জেনে আমার এতোদিনের জাজমেন্টাল ভুল ধারনার জন্য কিঞ্চিত লজ্জাই পাইলাম।
এই বই আমাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য না। তাই শখ করেই পড়া। মজার ব্যাপার হল অনেকদিন পর পর পড়ি আর প্রতিবারই সানজুর স্ক্রিপ্টের নতুন নতুন এঙ্গেল খুজে পাই। যেমন ধরেন এই দেয়াল দিয়ে ঘেরা শহর আক্রমন করতে সানজুর বারনের কথা।
আগিলাদিনে শহর রে দেয়াল দিয়া ঘেরাট দেয়া হত যেন শত্রু বিনা বাধায় শহর দখল করে ফেলতে না পারে। যুদ্ধ লাগলে শহরের ভেতর অস্ত্রপাতি আর রসদ নিয়া আরামসে দিনের পর দিন যুদ্ধ চালায়া যাও। প্রতিপক্ষের অপশান একটাই, শহর ঘেরাও দাও। কিন্তু একবার ভাবেন, আপনি কয়েকশ মাইল দূর থেকে এসে কতদিন একটা শহর অবরোধ করে রাখবেন? এম্নিতেই ত্যাদড় শহরবাসি চান্স পাইলেই তীর-পাত্থর-গরম পানি মারে আপনার তাবুর উপর। তার উপর আপনার রসদ আনতে হয় সেই একশ মাইল দূর থিক্ক্যা। দেয়াল বেয়ে উঠতে গেলে অথবা দেয়াল ভাংতে গেলেই উপর থেকে বৃস্টির মত তীর নেমে আসে।
আপনি সেনাপতি, যুদ্ধ করতে আসছেন, দাবা খেলতে না, যে দিন শেষে দুই ঘুটি নিয়া জিতলেই চলবে। নিজের সৈনের প্রতি আপনার মায়া আছে আর আপনি জানেন যে অনন্তকাল যুদ্ধ করতে এরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়নাই। যথারীতি আপনি বলটা এইবার আপনার রাজার কোর্টে পাস কইরা দিলেন। রাজা হিসেব নিকেষ করে দেখল এন্ড স্টেটে তার লাভ তেমন নাই। শত্রুর দেয়ালের পাশে বইসা পাহাড়া দেওয়ার চে অর ব্যবসা বানিজ্যের রাস্তায় ঠেক দেওয়া লাভজনক আর ফায়দা একই। তো কয়েকদিন হম্বিতম্বি দেখায়া পরের চালান রসদ পাঠানোর আগেই সেনা ফিরত নিয়া নিবেন। আর যদি ব্যাপার হয় ইগো, তাইলে আরো কিছু সৈন্য পাঠায়া দিবেন। আপনি একটা ক্লিয়ার মেসেজ পাইলেন। লা পরোয়া একটা ঝটিকা আক্রমন করবেন, পঙ্গপালের মত আপনার সেনা মরবে, প্রতিপক্ষকেও মারবে। একসময় শহরের পতন হবে, আপনি নিজ হাতে আপনার রাজার ঝান্ডা উড়ায়া রাজার কাছে বার্তা পাঠাবেন, মিশন একোমপ্লিশড! রাজা খুশি হয়ে আপনাকে আরেকটা করকরা নতুন আর্মি গিফট করবেন।
এতো গেল আদ্দিকালের কথা। এই কালে তো দেওয়ালের কোন বেইলই নাই। তাইলে কি? এই কুইজটা বুজতে হলে আপনারে একটু কাল্পনিক হতে হবে। আগে শহরের ডিফেন্সে যেই দেওয়ালটা ছিল অইরকম একটা দেওয়ালতো আর সারা দেশের চারদিকে দেয়া যায় না। দরকারও নাই। কারন শত্রুওতো এখন আর ঢাল-তলোয়ার-তীর-বল্লম নিয়ে আসেনা। এখনকার যেকোন অফেন্সিভ শুরু হয় এয়ার স্ট্রাইক দিয়ে। প্রথমেই একটা সাকসেসফুল এয়ার অপারেশন চালায়া সে আপনারে লুলা বানায়া নিবে। তারপর সে তার গ্রাউন্ড ফোর্সটা পাঠাবে আপনারে পিস মিলে সাবার করতে। আর যদি আপনে শত্রুর অই এয়ার অপারেশনটারে বানচাল করে দিতে পারেন, তাইলেই কেল্লা ফতে। শত্রু এইবার তার গ্রাউন্ড অফেন্সিভ আদৌ কন্টিনিউ করবে কিনা, সেইটা একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এইফাকে আপনি দরকষাকষি করেন, ইউএন ডাকেন, তেজ বেশি থাকলে আপনি কাউন্টার অফেন্সিভেও যাইতে পারেন।
মোদ্দা কথা হল শত্রুর এয়ার অফেন্সিভটা ঠেকানোর জন্য আপনার একটা দেওয়াল দরকার। এই দেওয়ালটারে এই জামানায় বলে এয়ারডিফেন্স। তো সানজু ভুল কইছে কই? আপনার যদি একটা আধুনিক এয়ারডিফেন্সের দেওয়াল থাকেই, তাইলে উনি আপনাকে না বরং আপনার শত্রুকে বলতেছেন, "প্রাচীরবেস্টিত নগর আক্রমন করা সমিচীন নহে।"
এই বই আর্মি লাইব্রেরির শেলফে সযত্নে পরে থাকে। নানান অজুহাতে আমাদের অনেকেই পড়ার আগ্রহ পাইনা। গ্যারান্টি দিতে পারি, পরের যুদ্ধটা কিন্তু ৭১ এর চে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। আর আমাদের মত ছোট রাস্ট্রে সেনাবাহিনী একা কখনও যুদ্ধ করেনা, জনতাকে সম্পৃক্ত হতেই হয়।তাই যুদ্ধের অ আ ক খ জানা-বোঝা কিন্তু আমাদের সবার জন্যই জরুরি।
পুনশ্চঃ
অনেকদিন ধরেই এই বইটা অনুবাদের চেস্টা করে যাচ্ছি। ফিরিঙ্গি প্রকাশক এনওসি ও দিছে। কিন্তু কাজ আগায় না। নিজেই ভাল বুজিনা, ভাবানুবাদ বা রুপান্তর ক্যামনে করি। তারপরও মাঝে মাঝে আরজ আলি মাতুব্বরের কথা মনে পরে, ভরসা পাই। দেখি প্রজেক্টটা শেষ করতে পারি কিনা। ভাবতেছি ব্লগেই এপিসোড বাই এপিসোড লিখব। দোয়া রাইখেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৮