somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দ্য আর্ট অব ওয়ার' : ১ : যুদ্ধ পরিকল্পনা (১-১৬)।

০৩ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছু মানুষ আছে যারা অন্যদেশের সাথে যে কোন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যুদ্ধ ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবতে পারেনা, ইংরেজিতে এই পদের লোকেরে বলে 'হক'। দুইপক্ষের মতের অমিল একটা সংকট, আর এই সংকট সাধারনত ডিপ্লমেসি দিয়ে সমাধা করার কথা। কিন্তু কখনো কখনো ডিপ্লমেটরা ফেইল মারেন অথবা পলিটিশিয়ানরা তাদের ফেইল মারতে বাধ্য করান, আর তখনই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধ মানেই কিন্তু বল প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে আপনার টার্মস এন্ড কন্ডিশন মেনে নিতে বাধ্য করা। মনে রাখার বিষয় হল, যুদ্ধ একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং যেকোন যুদ্ধের নেপথ্যে কুটনৈতিক ব্যর্থতা একটা বড় কারন।

সানজুর তের অধ্যায়ের প্রথম এই অধ্যায়কে ইংরেজিতে বলে 'প্রাইমারি ক্যাল্কুলেশন' বা 'এস্টিমেশন' অথবা 'লেইং প্ল্যানস।' সহজ কথায়, যুদ্ধে যাবেন কিনা কিংবা যুদ্ধে জড়ানোটা আদৌ ঠিক হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্তটা কিভাবে নিতে হয়, এই অধ্যায়ে সেই বিষয়েই সানজু আলোকপাত করেছেন।


সানজু কহেন, "যুদ্ধ একটি রাস্ট্রের পরম গুরুত্বপুর্ন বিষয়; কেননা এ হল জীবন অথবা মৃত্যুর প্রশ্ন; এ পথ বেঁচে থাকবার অথবা সর্বনাশের। তাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন অত্যাবশ্যক।"

মন চাইলেই আপনি যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারেন না। যুদ্ধের জন্য প্রথমেই আপনার দরকার একটা সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনী একরাতে বানানো সম্ভব না, বেতন-রেশন দিয়া দিনের পর দিন এদের ট্রেনিং দিতে হয়, অস্ত্রপাতি কিনে দিতে হয়। ধরা যাক আপনার এইরকম একটা সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু ভুল প্রতিপক্ষের সাথে লেগে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় যুদ্ধ করতে গেলেন। ব্যাস, ম্যাচ হারার জন্য খুব বেশি এফোর্ট লাগেনা, কিন্তু জিতার জন্য সানজুর "পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন অত্যাবশ্যক" কথাটা অপ্তবাক্য হিসেবে মনে রাখা জরুরী।


তাই পরিস্থিতি যুদ্ধের জন্য কতটা অনুকুল তা আপনি পাচটি মৌলিক ফ্যাক্টর এর আলোকে যাচাই করবেন। প্রথম ফ্যাক্টরটা হল 'মোরাল ইনফ্লুয়েন্স' বা নৈতিক প্রভাব। নেতৃত্ব যদি নৈতিক প্রভাব আর উপযুক্ত কারন নিশ্চিত করতে পারে, তবে জনতা ভয় কে জয় করে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাবে।

যুদ্ধে 'রাইচাস্নেজ অব কজ' বা সন্তোষজনক কারন খুব গুরুত্বপুর্ন। '৭১ এ পাক বাহিনী এই ব্রিফিং পেয়ে যুদ্ধ শুরু করল যে পুর্ব পাকিস্তানে সব বিধর্মি বেইমানদের বাস, ওদের নির্বিচারে হত্যা করতে হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই সাধারন সৈন্যরা টের পেয়ে গেল যে, আদতে তারা বিধর্মি নয় বরং মুসলমানদেরই মারছে। ব্যাস, দ্বিধা ঢুকে গেল, নেতৃত্বের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস জন্ম নিল। পাক আর্মি যথেস্ট প্রশিক্ষিত আর উপযুক্ত হয়েও শুধুমাত্র যুদ্ধ করার মত সন্তোষজনক কোন কারন না পায়ে, দ্রুত তাদের সৈনিকসুলভতা হারাল এবং পরাজিত হল। অথচ রাজা লিওনিডাস মাত্র ৩০০ স্পার্টান যোদ্ধা নিয়ে থার্মোপেলি গিরিপথে পার্শিয়ানদের ঘাম ছুটিয়ে ইতিহাসে নাম করে নিয়েছেন। এছারাও প্রায় প্রত্যেকটা ইসলামিক যুদ্ধেও খলিফা আর সেনাপতিদের নৈতিক প্রভাবের অসংখ্য উদাহরন আছে।

দ্বিতীয় ফ্যাক্টর হল, আবহাওয়া। প্রথমে নেপলিয়ন পরে হিটলার রাশিয়া আক্রমন করে হেরেছে। আদতে হেরেছে রাশান ঠান্ডার কাছে। রাশিয়ার মাটিতে রাশিয়াকে হারানোর মত ট্রেনিং অথবা লজিস্টিক কোনটাই না থাকায় হিটলারের অপারেশন বার্বারোসা হয়ে গেল ইতিহাসের অন্যতম ভুল আর মর্মান্তিক সামরিক অভিযান।

আপনার আর্মি যেখানে যুদ্ধ করবে, সেখানকার আবহাওয়ার সাথে কত দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবে, কতদিন টিকে থাকতে পারবে আর আপনি কতদিন রসদ যুগিয়ে যেতে পারবেন, তার উপর জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভরশীল। রাশিয়ার যেমন আছে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শীত, আমাদেরও তেমনি আছে আষাঢ়-শ্রাবন। বর্ষাকালে এসে বাংলার মাটিতে যুদ্ধ করে জিতে যাবার মত আর্মি এখনো বিশ্বের কোন দেশেরই নেই।

টেরেইন আরেকটা বিশাল ফ্যাক্টর। ইংরেজি টেরেইন শব্দের প্রাসঙ্গিক মানে হল একটা যুদ্ধক্ষেত্র সংলগ্ন গাছপালা, পাহাড়-উপত্যকা, নদ-নদী, বসতি ইত্যাদি। দুইটা নদী পার হয়ে যদি আপনাকে আক্রমন করতে হয়, আপনার হিসেব থাকতে হবে দুইটা সামরিক ব্রিজ বানানোর ক্যাপাসিটি আপনার আছে কি নাই, কেননা যুদ্ধের সময় শত্রু ব্রিজ ভেঙ্গে দিতে পারে। আপনি যেখানে আসল যুদ্ধটা করতে চাচ্ছেন, সেখানে আপনার ফোর্স কন্সেন্ট্রেট করতে হবে, যেন অই বিশেষ সময় আপনার ফোর্স রেশিও শত্রুর চে বেটার থাকে। তো সেই মোক্ষম সময়ে কন্সেন্ট্রেশন এচিভ করতে, কোন পথে কোথা থেকে কোন ফোর্স আনাবেন, সেইটা ঠিক করতেও আপনাকে টেরেইন জানতে হবে। টেরেইন জানতে হবে কোথায় গিয়ে বিশ্রাম নেবেন, কোথায় শত্রুকে ক্যানালাইজ করবেন অথবা কোন পথে পিছু হটবেন তা ঠিক করতেও।

চতুর্থ ফ্যাক্টর হল সেনাপতিদের কোয়ালিটি। বিচক্ষন কমান্ডারেরা পরিবর্তিত পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবন করে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, আর সুযোগ কাজে লাগাতে জানেন। নেপোলিয়ন নাকি আগেভাগেই শত্রুর চাল ধরে ফেলতে পারতেন, 'ডেজার্ট ফক্স' রোমেলও নাকি পারতেন। প্যাটন যেবার পেঞ্জার ডিভিশনকে হারিয়েছিলেন সে যুদ্ধে রোমেল ছুটিতে ছিলেন। অচিনলেক এল-আলামিনের যুদ্ধে তিস্টাতে পারছিলেন না, চার্চিল তার বদলে পাঠালেন মন্টগোমারি কে, মন্টগোমারি ঠিকই রোমেলকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিলেন। সেনাপতিদের নামে এবং উপস্থিতিতে যুদ্ধক্ষত্র প্রভাবিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।

পঞ্চম ফ্যাক্টর হল ডক্ট্রিন। যে সেনাবাহিনীর ইউনিট, র‍্যাঙ্ক স্ট্র্যাকচার, চেইন অব কমান্ড আর লজিস্টিক সিস্টেম যতউন্নত, সে সেনাবাহিনীর জয়ের সম্ভাবনা তত বেশি। যুদ্ধক্ষেত্রে পিছুহটা মানেই হেরে যাওয়া না। তারপরও সুশৃঙ্খল আর সু প্রশিক্ষিত সেনাদল পশ্চাদোপসরন করে আবার ফিরে আসে, দুর্বল সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।


সানজু দাবী করেন, "এমন কোন জেনারেল পাওয়া যাবেনা যিনি এই পাঁচটা বিষয় সম্পর্কে জানেন না। কিন্তু যারা এই পাচ বিষয় ভালভাবে আত্বস্থ করতে পারেন, তারাই বিজয়ী হন, আর যারা পারেন না, তারাই হেরে যান।"

যুদ্ধের পরিকল্পনার সময় যদি আপনি বলতে পারেন কোন পক্ষের নেতৃত্বের নৈতিক প্রভাব বেশি, কার সেনাপতি বেশি সক্ষম, কারা আবহাওয়া আর টেরেইনের সুবিধা বেশি পাবে, কাদের ডক্ট্রিন অধিক ফলপ্রসু, কাদের সেনারা বেশি উজ্জীবিত, কাদের অফিসার আর সৈন্যরা বেশি প্রশিক্ষিত, এবং কাদের প্রশাসনে পুরস্কার আর তিরস্কার সমুচিত ভাবে নিশ্চিত করা হয়; তাহলে আপনিও ভবিষ্যতবাণী করতে পারবেন, কে জিতবে আর কে হারবে। সুতরাং সানজুর দাবী, জেনেশুনে যে জেনারেল তার এই শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে, তাকে অনতিবিলম্বে অবসরে পাঠানো হোক, কারন সে ইতোমধ্যেই একজন হারু জেনারেল, এইটা যুদ্ধে হেরে প্রমানের কোন দরকার নাই। আর ভাল জেনারেলরা তার এই শিক্ষাকে বিবেচনায় রেখে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলে ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে আনবে।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:০৯
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×