somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দ্য আর্ট অব ওয়ার' : ০৪ : রণকৌশলগত বিন্যাস।

০৬ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান এটাক রে বলত "ব্লিতজক্রিগ"। ঐটা ছিল জার্মানদের ট্রাম্পকার্ড। ব্যাপারটা হল শুরুতেই প্রতিপক্ষের সারা ডিফেন্স জুড়ে হামলে পরে একটা ফাটল খুঁজে বের করা। এরপর ডিফেন্সের ঐ ফাটলটা দিয়ে সর্বশক্তিতে দ্রুত প্রতিপক্ষের যতটা সম্ভব গভীরে পৌছে যাওয়া, যেন ডিফেন্সটা দুই ভাগ হয়ে ইমব্যালান্স হয়ে পরে। ফলাফল হল প্রতিপক্ষ আয়েশ করে যুদ্ধ শুরু করার আগেই দেখে বেইল নাই।

তো এই জার্মানরাই যখন আবার রাশানদের হাতে মস্কোর আশেপাশে নাস্তানাবুদ হতে লাগল, তখন তারা হেজহজ ডিফেন্স নিল। মানে ছোট ছোট পকেট অফ রেজিস্টেন্স যেখানে জার্মানরা ট্রেঞ্চ গেড়ে বসে থাকত আর আকাশপথে তাদের রসদ সরবরাহ করা হত। এইসবগুলো পকেট ক্লিয়ার করে করে এগুনো রাশানদের জন্য ছিল বিশাল এক হ্যাপা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্মানদের কিন্তু হারতেই হল।


আদ্দিকালের ঝানু যোদ্ধারা প্রথমে নিজেদের সুরক্ষিত করে নিয়ে তারপর শত্রুর দুর্বলতার জন্য অপেক্ষায় থাকত। নিজেদের সুরক্ষিত করাটা সহজ, কিন্তু শত্রু কখন সুযোগ দেবে সেটা নির্দিস্ট করে বলা কঠিন। আপনি শত্রুকে যত বেশি জানবেন, ততই তার দুর্বলতাগুলো আপনার চোখে পরবে। আর এই দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগানোর সামর্থ্য আপনি যত বাড়াবেন ততই আপনার জেতার সুযোগ বেড়ে যাবে। এখন সুযোগ আপনি কবে কখন কিভাবে কাজে লাগাবেন, অথবা আদৌ লাগাবেন কিনা, সেইটা সম্পুর্নই আপনার নিজস্ব ব্যাপার।


কথিত আছে লখিন্দরকে সুরক্ষিত রাখতে নাকি লোহার ঘর বানানো হয়েছিল, তারপরও বেহুলাকে কিন্তু সাপে কাটা স্বামী লকিন্দরকে নিয়ে ভেলায় ভাসতে হয়েছিল। প্রতিরক্ষা বা ডিফেন্স অবশ্যই জরুরী এবং সুচিন্তিত প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা আপনাকে প্রায় অপরাজেয় করে দিতে পারে। কুয়েত জবরদখলের পর সাদ্দাম যেমন সারা কুয়েত জুড়ে নজিরবিহীন ডিফেন্স নিয়েছিলেন। যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীও কুয়েত ঘিরে বসেছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু এই অচলাবস্থা কদ্দিন?

সব দুর্গেই কোন না কোন ফাটল থাকে, আর অদম্য সেনাপতিরা ঠিকই কোন না কোন উপায় বের করে নেয়। পাচ মাসব্যাপি লজিস্টিক বিল্ড আপ আর এয়ার অপারেশন শেষে যৌথবাহিনী সেই কাঙ্ক্ষিত ফাটল খুজে পেয়ে ঠিকই সাদ্দাম বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। তাই প্রতিরক্ষা আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে, কিন্তু জয়ের জন্য আক্রমনের কোনই বিকল্প নেই।

যুদ্ধে যার শক্তি অপেক্ষাকৃত কম সে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে, আর যার বেশি সে আক্রমনের পায়তারা কষে। বিচক্ষন সেনাপতি যখন ডিফেন্স নেয় তখন সে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজায় যে আক্রমনকারী কোন পথে কোথায় আক্রমন করবে তা বুঝে উঠতে পারেনা। আর যখন সে আক্রমনে যায় তখন এমন এমন অপ্রত্যশিত স্থান থেকে উড়ে এসে আঘাত করে, যে ডিফেন্সে থাকা শত্রু ঠাহরই করতে পারেনা যে কোন দিক রেখে কোন দিক সামলাবে। আর যারা প্রতিরক্ষা আর আক্রমনে সমান সিদ্ধহস্ত, সার্বিকভাবে তারাই বিজয়ী হয়।


বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে বিজয় চিনতে পারায় কোন বাহাদুরি নেই, এমনকি একটা যুদ্ধে আপনি জিতে এলেন আর সবাই বলল, "সাবাশ", একেও যুদ্ধে পারদর্শীতার উতকর্ষ বলেনা। মরা একটা খরগোসকে যে কেউ তুলতে পারে, সুর্য আর চাঁদ চিনতে পারাকে কেউ চোখের পরীক্ষা বলেনা, আর বজ্রের শব্দ যে শুনতে পায় তাকে কেউ খুব কানখাড়া বলে বাহবা দেয়না। আগেকারদিনে চৌকষ যোদ্ধা তাদেরই বলা হত যারা শুধু জিততই না বরং খুব সচ্ছন্দ্যেই জিতত। কিন্তু সহজ বিজয়ে না আছে বিচক্ষনতার খ্যাতি, না আছে সাহসের কৃতিত্ব।

বরং একজন প্রকৃত যোদ্ধা নির্ভুল ভাবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এমন বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে যেখানে যুদ্ধক্ষত্রে পা দেবার আগেই, পরিকল্পনার টেবিলেই সে শত্রুকে পরাজিত করে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফিল্ড মার্শাল স্লীমের ১৪তম আর্মি বার্মা থিয়েটারে জাপানিদের হাতে এয়সা মার খেল যে তার আর্মির নাম হয়ে গেল 'ফরগোটেন আর্মি' আর জাপানিরা হয়ে গেল 'ইনভিনসিবল জ্যাপস'। পিছুহটে ভারত এসে স্লীম বুঝল যে সদ্য মধ্যপ্রাচ্যের মরুভুমিতে যুদ্ধকরে ফেরত তার ডিভিশন গুলো বার্মার জঙ্গলে লড়বার মত স্কিলড ছিলনা। তাই তিনি জঙ্গল যুদ্ধের উপর তার আর্মিকে দক্ষ করতে ম্যাসিভ ট্রেনিঙ্গের ব্যবস্থা করলেন। এরপর যখন তিনি বার্মা থিয়েটারে তার আর্মি নিয়ে পা রাখলেন, তখন সবকটা জাপানিকে ঝেটিয়ে বিদায় করে তবে থামলেন।

বিচক্ষন সেনাপতিরা এমন অবস্থান থেকে যুদ্ধে নামেন যে যেখান থেকে তাকে আর পরাজিত করা অসম্ভব, এবং তারা যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করার ন্যুনতম সুযোগটাও নিতে কখনো পিছপা হননা। মাজিনো লাইন নামের প্রতিরক্ষা দেয়ালের ওপাশে বসে ফরাসীরা ভেবেছিল জার্মানদের কি সাধ্যি এই মেজিনো লাইন পেড়িয়ে এসে তাদের আক্রমন করে। সেই অপরাজেয় মেজিনো লাইনের একটা গ্যাপে ছিল আর্ডেন ফরেস্ট। কেউ কস্মিকালেও ভাবেনি কোন সেনাবাহিনী এই ঘন বনের ভেতর দিয়ে মার্চ করতে পারে। জার্মানরা পুরা মেজিনো লাইন অটুট রেখে সেই আর্ডেন ফরেস্ট দিয়েই ঢুকে ইংগ-ফরাসী দের এমন ধাওয়া দিল যে ডানকির্কের উপকুলে অপারেশন ডাইনামো নামে ইতিহাসের অন্যতম বৃহত পিছুহটার দৃস্টান্ত রচিত হল।

সফল সেনানায়কেরা তাদের সেনাবাহিনীতে ন্যায়বিচার আর শৃংখলার চর্চা করে সাফল্যকে নিয়ন্ত্রন করেন। আলেকজান্ডার থেকে চেঙ্গিস থেকে খালিদ বিন ওয়ালিদ, এরা কেউই নিজ সেনাদলের শৃংখলার সাথে কখনই আপোষ করেননি। এজন্যই বলে, বিচক্ষন সেনাপতি যুদ্ধক্ষত্রে জয়ের সব রাস্তা ভেবেই তারপর যুদ্ধক্ষত্রে পা দেন। আর যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে এসে তারপর জেতার রাস্তা খোঁজেন, তিনিই শোচনীয়ভাবে হারেন।


পাঁচটি দৃস্টিকোন থেকে যেকোন পরিস্থিতিকে যুদ্ধের জন্য যাচাই করতে হয়। প্রথমেই যুদ্ধক্ষেত্রের দুরত্ব অনুধাবন করুন। এবার হিসেব করুন এই দুরত্ব পেড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে কি পরিমান রসদ চাই। এরপর শত্রুর সংখ্যার বিপরীতে আপনার কি পরিমান সেনা আর সরঞ্জামাদি দরকার সে হিসেব করুন। সর্বোপরি শত্রু আর আপনার তুলনামুলক বিচারে নির্ধারন করার চেস্টা করুন এই যুদ্ধে আপনার জেতার সম্ভাবনা কতখানি। যদি শত্রুর বিরুদ্ধে আপনি উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হন, তবে আপনার সেনাবাহিনী প্রবল জলস্রোতের মত প্রতিপক্ষের সব প্রতিরোধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×