somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দ্য আর্ট অব ওয়ার' :০৫ : কমান্ডার হিসেবে আপনি কতটা শক্তিশালী?

০৭ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ধরেন আপনি একটা অফিসের বস আর আপনার আন্ডারে দশজন কর্মী কাজ করেন। এদের বেতন ভাতা, ট্রেনিং, পারফরমেন্স, পোস্টিং, প্রমোশন, ছুটি আর ওয়েলফেয়ার দেখার দায়িত্ব আপনার। তো আশা করছি আপনিই ভাল বু্ঝেন কিভাবে তাদের দিয়ে অফিসের কাজ চালিয়ে নিতে হয়। আর আপনি যদি দশজনের একটা অফিস চালাতে পারেন তো ১০০ জনের একটা প্রতিষ্ঠানও পারবেন। এইটা আমার না, মহামতি সানজুর দাবী। সানজু বলেন, ব্যবস্থাপনা আর নিয়ন্ত্রনের (ম্যানেজমেন্ট এন্ড কন্ট্রোল) বিষয়ে একজন সামলাইতে যে ফরমুলা একশজন সামলাইতেও ঐ একই ফরমুলা। সংগঠনের সাইজ অনুযায়ী চেইন অব কমান্ডটা খালি লম্বা হয়, এই আরকি।

আগেকারদিনে সারা যুদ্ধক্ষত্র জুড়ে ছড়িয়ে ছিতিয়ে থাকা সৈন্যদের পরিচালনার জন্য ঢাক, শিঙ্গা, পতাকা ঝান্ডা ব্যবহার করা হত, এখনও নেভাল শীপে পতাকা ব্যবহার হয়। এর কারন একজন কমান্ডারের পক্ষে প্রত্যেক সৈনিকের কানের কাছে গিয়ে কমান্ড দেয়া সম্ভব না। তাই ঢাক, শিঙ্গা, পতাকা ঝান্ডার সংকেতে সৈন্যরা চলে, থামে, আগায় আবার পিছায়। আধুনিক কালে এই ঢাক, শিঙ্গা, পতাকা ঝান্ডার বদলে আসছে ওয়্যারলেস রেডিও, স্যাটফোন ইত্যাদি, কিন্তু উপযোগীতাটা একই। এই কারনেই যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসীরা কখনো একা আগাইয়া যায় না, আবার কাপুরুষরাও কখনো একা পালাতে পারে না! তাই ফরমেশন আর কমুনিকেশন ঠিক থাকলে একটা স্কোয়াড কমান্ড করতে যে বেসিক স্কিল দরকার, একটা আর্মি চালাইতেও মোটামুটি একই স্কিল দরকার।

ধরেন আপনার শত্রু উত্তর দিকে মুখ করে ডিফেন্স নিয়া আপনারে মোকাবেলা করার জন্য ওঁত পেতে আছে। আপনি আপনার আর্মি নিয়া সামনা সামনি তারে এটাক করলেন, এইটারে বলে চেং বা ডাইরেক্ট অথবা সাধারন মেনুভার। আর আপনি যদি তারে সামনে দিয়া এটাক না করে তার ডান অথবা বাম পাশ দিয়ে করেন, সেইটারে বলে চি’ বা ইনডাইরেক্ট অথবা অসাধারন মেনুভার। সানজুর কেরামতি হল তিনি সব যুদ্ধে এই মেনুভারের ওপর দারুন গুরুত্ব দিছেন। তিনি গায়ের জোরে অথবা সৈন্য সংখ্যার চে কমান্ডারদের মেনুভার করার সামর্থ্যকে বেশি প্রাধান্য দিছেন, এই মেনুভারিস্ট এপ্রোচের জন্য তিনি অনন্য।

যুদ্ধে শত্রুকে সামনে থেকে আক্রমনের পরিকল্পনা চরম বলদামি বিশেষ। কারন এই পথেই আপনি আসবেন ভেবেই সে তার সব প্ল্যান আর ফাঁদ সাজাইছে। আর সেই ফাঁদে আপনি সেধে পা দেয়াটা সুইসাইডাল। সাধারনত যুদ্ধে সামনে থেকে শত্রুকে এনগেজ করে রেখে তার কোন একটা ফ্ল্যাঙ্ক থেকে আক্রমন করা হয়। তাই সানজু বলেন যুদ্ধে ডাইরেক্ট মেনুভারটা করা হয় শত্রুকে এনগেজ করতে আর ইনডাইরেক্ট মেনুভার করা হয় জিততে।
সানজুর মতে বিচক্ষন সেনাপতির মাথায় এই ইনডাইরেক্ট মেনুভারের অফুরন্ত আইডিয়া কাজ করার কথা। পাঁচটা মাত্র বেসিক মিউজিক্যাল নোট দিয়ে অসংখ্য মেলোডি বানান সম্ভব, যার সব শুনে শেষ করা অসম্ভব। পাঁচটা মৌলিক রং (সানজু কেন সাতটার জায়গায় পাঁচটা বলছে কে জানে?) মিশিয়ে এত অসংখ্য রং বানান সম্ভব, যার সব দেখে শেষ করা অসম্ভব। পাঁচটা মৌলিক স্বাদের সমন্বয়ে অসংখ্য স্বাদ বানান সম্ভব, যার সব চেখে শেষ করার নয়। তেমনি যুদ্ধে এই ডাইরেক্ট আর ইনডাইরেক্ট মেনুভারের সমন্বয়ে এত অসংখ্য মেনুভার পরিকল্পনা করা সম্ভব যে কেউ একা এঁর সব কখনই আত্বস্থ করতে পারবে না। যেন একটা বৃত্তের মত, কোথায় এঁর শেষ কেউ জানেনা।

পানির স্রোত যেমন পাথরের গায়ে আছড়ে পরে, তেমনি সৈন্যরা যুদ্ধক্ষত্রে শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পরে, একে বলে মোমেন্টাম। আর বাজ পাখি যেমন তার শিকারের ওপর মুহুর্তের ভেতর ঝাঁপিয়ে পরে তার পতনের মোমেন্টামটা কাজে লাগিয়ে শিকারের পিঠ ভেঙ্গে দেয়, একে বলে টাইমিং। শক্তি হল জ্যা যুক্ত তীর ছিলায় টানটান করে ধরে রাখাতে, আর সিদ্ধান্ত হল মোক্ষম সময়ে তা জ্যা মুক্ত করাতে। তাই দক্ষ সেনাপতির সেনাদলের গতি হবে অপ্রতিরোধ্য আর তার আক্রমন হবে সময়োচিত আর সুনির্দিস্ট।

যুদ্ধের ডামাডোলে প্রথমে সব আপনার কাছে এলোমেলো ঠেকবে। কিন্তু আপনি যদি বিচক্ষন কমান্ডার হন, আপনি জানেন আপনার সেনাদল কখন কি করতে যাচ্ছে। আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন যে আপনার সেনাদল যথেস্ট সুশৃঙ্খল, শুধুমাত্র তখনি আপনি বিশৃংখলার ভান করতে পারেন; আপনার সেনাদল যদি আসলেই দুঃসাহসী হয়ে থাকে, তাহলেই কেবল আপনি ভীতু হবার ভান করতে পারেন; আপনি যদি সত্যি সক্ষম হন, শুধু তখনই আপনি দুর্বল সাজার ভান করবেন; আর এসবই আপনি করবেন আপনার শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে, যেন সে ভুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। মনে আছে নিশ্চয়, ইটস অল এবাউট ডিসেপসন!

গোছানো অথবা এলোমেলো হওয়াটা নির্ভর করে সাংগঠনিক দক্ষতার উপর, ডিভিসিবিলিটি সেনাদলসমুহের এক অপরিহার্য বৈশিস্ট, এঁর মানে হল প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত বিভিন্ন সাইজে আর ফরমেশনে বদলে যাওয়া। যেমন অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে যে সেনাদল তাদের ঢাল পাশাপাশি ধরে দেয়াল তৈরি করে নিজেদের বাঁচায়, তারাই আবার সেই ঢাল দিয়ে চাল বানিয়ে উড়ে আসা তীর ঠেকায়।

পঞ্চাশ অভারের ম্যাচে পরে ব্যাট করতে নামা দলের সামনে লক্ষ্য যদি থাকে ৮২ রান, সেই পরিস্থিতিতে ওপেনার রা নেমেই চার ছক্কা হাকাতে থাকে। আবার ঐ একই দল যখন ২৪৫ রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই ৪টা উইকেট হারায়, তখন ব্যাটিং হয়ে যায় সিঙ্গেল-ডাবলস নির্ভর। তেমনি একই সেনাদল অনুকুল পরিস্থিতিতে দুঃসাহসের পারাকাষ্ঠা দেখায়, আবার প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ভীরুর মত লড়ে। একইভাবে রণকৌশলগত অবস্থানের উপর ভিত্তি করে আপাত সামর্থ্য বদলে যেতে পারে সীমাবদ্ধতায় কিংবা উল্টা টাও হতে পাড়ে।

তাই দক্ষ সেনাপতিরা যুদ্ধে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেন শত্রু প্রলুব্ধ হয়ে তার পাতা ফাঁদে পা দেয়, একে বলে কেনালাইজিং অথবা বলতে পারেন শত্রুকে পুর্ব পরিকল্পিত কিলিং জোনে টেনে নিয়ে আসা। আপনি যদি বিচক্ষন কমান্ডার হন, তাহলে আপনি কখনই শুধু আপনার সেনাদল যে যুদ্ধে লিপ্ত আছে তার উপর ভরসা করে বসে থাকবেন না। আপনি পরিস্থিতি নিবিরভাবে পর্যবেক্ষন করতে থাকবেন আর থাকবেন একটা সুযোগের অপেক্ষায়। যুদ্ধ শুধু যোদ্ধাদের লড়াই দিয়ে জেতা যায় না, যুদ্ধ জিততে চাই সুযোগ সন্ধানী কমান্ডার, যিনি প্রতিপক্ষের আগে সুযোগটা চিনে নিতে পারেন আর কাজে লাগাতে জানেন।

কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে চাই উপযুক্ত লোক নির্বাচন যারা কমান্ডারের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে সমর্থ। উপযুক্ত লোক হল গাছের গুড়ি অথবা পাথরের চাই এঁর মত। প্রত্যাশিত হল সমতল ভুমিতে এরা স্থির থাকলেও, ঢালু ভুমিতে এরা গড়িয়ে এগিয়ে যাবে লক্ষ্যের দিকে। এখন আপনি এদের একটা ঢালু ভুমি্র পাশে এনে দাড় করালেন, মানে একটা সুযোগ দিলেন, এখন এদের কাজ গড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুর উপর আছড়ে পড়া। কিন্তু আপনার গুড়ি অথবা পাথর যদি হয় চারকোনা তাহলেই বিপদ। কারন গোলাকার গুড়ি-পাথর ভালই গড়াবে, কিন্তু চারকোনা হলে পথে স্থানেস্থানে এরা আটকে যাবে! তাই প্রয়োজনের সময় উপযুক্ত লোক নির্বাচন খুবই গুরুত্বপুর্ন, আর সঠিক নির্বাচনের জন্য আপনাকে আপনার অধস্তনদের আগে থেকেই খুব ভাল করে চিনতে হবে।

যুদ্ধে তিনরকমের পরিস্থিতি হতে পারে; একঃ মনোবলের দিক থেকে জেনারেল, তার কমান্ডারেরা আর সৈনিকেরা লড়তে ভালবাসছে আর তারা জয়ের জন্য উদগ্রীব। দুইঃ টেরেইনের প্রেক্ষিত, এমন একটা এলাকা ডিফেন্ড করতে হবে যেখানে প্রবেশের রাস্তা কুকুরের ঘরে ঢোকার দরজার মত সংকীর্ন অথবা পাহাড়ী এলাকার ভেতর দিয়ে ভেড়ার পাকস্থলীর মত রাস্তা আকাবাকা রাস্তা, যা হয়েই শত্রুকে তার কাছে আসতে হবে। তিনঃ শত্রুর অবস্থার প্রেক্ষিতে, যখন শত্রু যুদ্ধ আর পথশ্রমে ক্লান্ত অথবা শত্রু এখনো তার শিবির স্থাপন করে সারেনি কিংবা শত্রুদলের অর্ধেক কেবল একটা নদী পার হয়েছে বাকি অর্ধেক এখনো নদীর ওপাড়ে। উপরের তিনটি পরিস্থিতিই যেকোন কমান্ডারের জন্য সুযোগ বিশেষ। সানজুর মতে, এমন সুযোগে একজন কমান্ডার এমন ভাবে তার সৈন্য পরিচালনা করে, যেন খাড়া ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পরা পাথরের বোল্ডার একেকটা, উপর থেকে ফেলতে ধাক্কা লাগে সামান্যই কিন্তু ফলাফল ভয়াবহ!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪৪
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×