ইঙ্গ-ফরাসী শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের রাজা ৫ম হেনরি তখন তার আর্মি নিয়ে ফ্রান্সের আজিনকোর্টে। সেই আগস্ট মাসের মাঝামাঝি তিনি ফ্রান্সে পা দিয়েছেন, এখন অক্টোবর শেষ হতে চলল। ফরাসীরা সেভাবে যুদ্ধের সুযোগই দিচ্ছেনা তাকে তাই সাফল্য বলতে কিছুই পাননি। তার ওপর চলতি বছরের যুদ্ধের মৌসুমও প্রায় শেষের দিকে। একেকটা কেম্পেইনের খরচ কম না, এভাবে খালিহাতে তো আর দেশে ফেরা যায় না, তাই সিদ্ধান্ত নিলেন নরম্যান্ডি হয়ে কেলাইস পর্যন্ত যাবেন। অবশেষে আজিনকোর্টের কাছে এসে তিনি ফ্রেঞ্চ আর্মির দেখা পেলেন।
নরম্যান্ডি থেকে কেলাইস যাবার পথে আজিনকোর্ট, রাস্তার বামে আজিনকোর্ট বন আর ডানে ট্রামেকোর্ট বন। এই দুই ঘন বনের মাঝের এলাকার দুই দিকে ইংলিশ আর ফ্রেঞ্চ আর্মি মুখোমুখি অবস্থান নিল। স্বভাবতই নিজ দেশের মাটিতে ফ্রেঞ্চরা সংখ্যায় অনেক বেশি। কিন্তু ইংলিশদের সুবিধা হল ঘন বনের কারনে ডান অথবা বাম থেকে আক্রান্ত হবার ভয় নেই। তাই যুদ্ধক্ষেত্রটা দুই বনের মাঝের খোলা জায়গাতেই সীমাবদ্ধ, যা আবার পুরোটাই চষা ক্ষেত, তারউপর বৃস্টিভেজা কর্দমাক্ত।
এই যুদ্ধে ইংলিশরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ফ্রেঞ্চদের হারিয়ে দিল। ফ্রেঞ্চ পরাজয়ের কারন ত্রিবিধ; একঃ সীমাবদ্ধ যুদ্ধক্ষত্রে ফ্রেঞ্চ সেনারা এতবেশি ঘন হয়ে এগুচ্ছিল যে ইতিহাসবিদদের ভাষ্যমতে তাদের তৃতীয় সারির সেনারা ঠিক মত নিজের তরবারিই চালাতে পারছিলনা। দুইঃ ইংলিশ লং বো তীরন্দাজদের নৈপুন্য। তিনঃ যুদ্ধক্ষত্রের হাঁটু সমান কাদা ডিঙ্গিয়ে আসতে গিয়ে ফ্রেঞ্চ অশ্বারোহী আর পদাতিক উভয় সেনারা পথে বারবার আটকে যাচ্ছিল আর এই সুযোগে ইংলিশরা তীরন্দাজেরা আয়েশ করে লক্ষ্যভেদ করছিল। স্রেফ কর্দমাক্ত যুদ্ধক্ষত্রের সুবিধা কাজে লাগিয়ে আজিনকোর্টের এই ইংলিশ জয় সমর ইতিহাসে টেরেইনের গুরুত্ব অনুধাবনের অনন্য দৃস্টান্ত হয়ে আছে।
১
প্রুশিয়ান জেনারেল আর বিখ্যাত সমরবিদ কার্ল ভন ক্লসউইতজের মতে টেরেইন থেকে যুদ্ধে দ্বিবিধ সুবিধা পাওয়া যায়। একঃ উপযুক্ত টেরেইন কখনো কখনো শত্রুর চলার গতি কমিয়ে দেয়, অথবা শত্রুকে ব্যাটেল ফর্মেশন ছেড়ে কলাম হিসেবে এগুতে বাধ্য করে। দুইঃ টেরেইনের বিভিন্ন ফিচার, যেমনঃ পাহাড়, বন ইত্যাদি, নিজ সেনাদলকে কাভার নিয়ে যুদ্ধ করতে সহায়তা করে। প্রথম সুবিধাটা শুধু ডিফেন্ডার দের জন্য প্রযোজ্য হলেও, দ্বিতীয় সুবিধাটা সবার জন্যই জরুরী।
সানজুর মতে টেরেইন অবশ্য ছয় প্রকার।
একঃ একসেসেবল গ্রাউন্ড। এ ধরনের এলাকায় যাতায়তের ভাল রাস্তাঘাট থাকে, তাই চলাচল সহজ আর দ্রুত হয়। একসিসেবল গ্রাউন্ডে যে আগে অপেক্ষাকৃত উঁচু আর আলোকিত এলাকায় অবস্থান নিতে পারে, এবং তার রসদ সরবরাহ ঠিক রাখতে পারে; সেই সুবিধামত লড়তে পারে। সমর ইতিহাসের বেশিরভাগ যুদ্ধেই সেনাপতিরা অসংখ্যবার এভাবেই জিতেছেন।
দুইঃ এন্ট্র্যাপিং বা এন্ট্যাংলিং গ্রাউন্ড। যেমন পুরান ঢাকার গোলকধাধার মত এলাকা, যেখানে ডিরেকশন ঠিক রাখা কঠিন। এন্ট্র্যাপিং বা এন্ট্যাংলিং গ্রাউন্ড এ শত্রু যদি অপ্রস্তুত থাকে তো আপনি ঝটিকা আক্রমন করে জিততে পারবেন। কিন্তু শত্রু যদি প্রস্তুত থাকে তবে এমন গ্রাউন্ডে তাকে হারানো কঠিন, আর একবার এই এলাকায় ঢোকার পর অক্ষত বেরিয়ে আসা আরো কঠিন। তাই এহেন এলাকায় যুদ্ধ অলাভজনক।
তিনঃ ইনডিসাইসিভ বা টেম্পোরাইজিং গ্রাউন্ড। এধরনের এলাকায় ছোটখাটো নদীনালা, কর্দমাক্ত চষা জমি ইত্যাদি থাকে, ফলে সেনাদলের গতি কমে যায়। ইনডিসাইসিভ বা টেম্পোরাইজিং গ্রাউন্ড এ আপনি নিজে প্রবেশ না করে শত্রুকে প্রলুব্ধ করুন যেন সে এগিয়ে আসে। আর যখনি তার অর্ধেকের মত ফোর্স এই এলাকা থেকে বের হয়ে আসবে আর বাকি অর্ধেক তখনো আসা বাকি, তখনি আপনি আক্রমন চালাবেন।
চারঃ কনস্ট্রিকটেড গ্রাউন্ড। যেমন দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলা রাস্তা। চাইলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগুনো মুশকিল। কনস্ট্রিকটেড গ্রাউন্ড এ আপনি যদি আগে পৌছাতে পারেন তো ঐ এলাকায় প্রবেশের সব রাস্তা আপনি বন্ধ করে দিন। আর যদি আপনার শত্রু যদি আগেই পৌছে সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে থাকে, তবে অরক্ষিত কোন রাস্তা খুজে দেখুন। যদি তাও না পাওয়া যায়, তাহলে আক্রমনের আইডিয়া বাদ দিন।
পাঁচঃ প্রেছিপিশাস গ্রাউন্ড। যেমনঃ পর্বত সঙ্কুল বন্ধুর এলাকা। প্রেছিপিশাস গ্রাউন্ড এ আপনি আগে গিয়ে উঁচু আর আলকিত অবস্থান গুল দখল করে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করুন। আর যদি শত্রু আপনার আগেই এলাকার দখল নিয়ে থাকে, তাহলে তাকে অনুসরনের চেস্টা না করে বরং চেস্টা করুন শত্রুকে ঐ এলাকার বাইরে নিয়ে আসতে।
ছয়ঃ ডিসট্যান্ট গ্রাউন্ড। যে এলাকা নিজ অবস্থান থেকে অনেক দুরে এবং যেখানে যেতে পর্যাপ্ত রসদ জ্বালানী মজুদ থাকা চাই। ডিসট্যান্ট গ্রাউন্ড এ থাকা শত্রু যদি আপনার সমকক্ষ হয়, তাহলে তাকে যুদ্ধে প্ররোচিত করা দুস্কর, আর আপনি যেচে গিয়ে লড়তে যাওয়াটাও অলাভজনক হবে।
প্রত্যেক জেনারেল যুদ্ধে যাবার আগে অবশ্যই টেরেইন নিয়ে বিশদ গবেষনা করেন। টেরেইনের প্রকৃতি তার রণ পরিকল্পনার অন্যতম ফ্যাক্টর। ইউ এস আর্মিতে প্রচলিত ইন্টেলিন্স প্রিপারেশন অফ ব্যাটেলফিল্ড পদ্ধতি এই বাস্তবতার আলোকেই তৈরি। প্রতিনিয়ত আপডেটেড করা এইসব ম্যাপের কারনেই পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে, যেকোন আবহাওয়ায় তাদের চে দ্রুত যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত আর্মি খুব কমই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৫৬