somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্থিরচিত্র

১৬ ই জুন, ২০০৭ রাত ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বটু মিয়া, তোমার কী মনে অয়? ইলেকশন অইবো?' মধ্যবয়সী জারুল জিজ্ঞেস করে প্রবীণ বটগাছকে। বটু মিয়া তার লম্বা একটা ডাল দিয়ে এতোক্ষণ ঝুরি বুলোচ্ছিল। জরুর কথা ঝুরি থেকে ডাল সরায়। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তুই দেহি কদম আলির মতোন জিগাস। দ্যাশের রাজনীতির কোনো আগা মাথা আছেনি! এইডাতো ফুটবল খেলনের জায়গা না। যে যার খুশি মতো খেলে, গোল দেয়। পায়ের তলায় বল থাকাটাই আসল কতা।’
জারুল কথার মারপ্যাঁচ অতো বোঝে না। অন্যদিকে কদম আলি তথা হৃষ্টপুষ্ট কদম গাছটা বটু মিয়ার কথায় কিছুটা আহত হয়। সে জারুলের মতো বোকা নয়। যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। কিন্তু সমস্যা হলো, তার তলায় পত্রিকা স্ট্যান্ড নাই। সাইজে বড় হওয়ায় বটের তলাতেই পেপার বেচা হয়। দেশ-বিদেশের খবর তাই বটের কাছেই পাওয়া যায়। বটু মিয়া ভোর বেলাতেই উবু হয়ে ঝটপট সবগুলো পত্রিকার হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে নেয়। বাকিটা লোকের মুখে শুনে শুনে।
জারুল অনেক্ষণ কোনো প্রশ্ন করে না। জানে, যাই জিজ্ঞেস করুক তার পেছনেই এক বেলাইনের ফিরিস্তি জুড়ে দেবে। মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাবে না। কথায় বটুর সঙ্গে পারে কারো সাধ্য নেই। সেই চারাবেলা থেকেই এটা জানে জারুল ওরফে জরু। তারচেয়ে কদম আলির কাছ থেকে কিছু রসালো গল্প শোনা যেতে পারে। বটু মিয়া কানে কিঞ্চিত্ কম শোনে। তাই প্রবীণ হওয়া সত্বেও বটুকে উপেক্ষা করে নির্দ্বিধায় আলাপ শুরু করে জরু ও কদম।
‘কদম আলি! আইজকা হেরায় কী কইল?’। ‘অনে..ক’।
শরমের কোনো কতা কয় নাই?
হ, তাতো কইবই! তোর মতোন ভীতুনি!
কও না! এট্টু হুনি!
হেই আর এমন কি, এই ধর ‘সোনামনি’ কইল আর বিয়ার পর... ধুর! ওইসব তুই বুইজা ল।
জারুল উচ্ছ্বাসিত হয়। কদমতলার প্রেমিক-প্রেমিকাদের খবর জানাটা যে কী আনন্দের! দুর্ভাগ্যবশতঃ তার নিজের তলার ঠিক পাশেই একটা পঁচা ডোবা। প্রেমিক-প্রেমিকারা তাই জারুলতলা এড়িয়ে চলে। এ নিয়ে অবশ্য জরুর খুব একটা আফসোস নাই। খবর জানলেই সে খুশি।
কদম আলি কী যেন বলার জন্য উশখুস করতে থাকে। এমন সময় বটু মিয়া গা দুলিয়ে ওঠে। দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে। বিকেল হলে গা এলিয়ে বিশ্রাম নেয় বটু মিয়া। তখন আশপাশে বোমা ফাটলেও বটু মিয়া শুনবে না।
ও জরু দিনকালতো সুবিধার না রে!
ক্যান! কী হইছে! জরু সচকিত হয়।
তয় হুন। কাইল রাইতে মাত্তর ঘুম দিতে লাগছি এমন সময় তলায় দেহি কারা যেন ফিসফাস করতাসে। চাইয়া দেহি একটা পোলা আর একটা মাইয়া। মাইয়ার ঠোঁটে লাল লিবিস্টিক।
জরু বলে, তা রাইতের বেলায় লাল বুজলা ক্যামনে!
কতার মধ্যে বাম হাত ঢুকাস ক্যান।
কও কও! তাড়াতাড়ি কও!
পোলাডা মাইয়াডারে কী যেন কইল। আর দেহি হে শরমে কুটিকুটি।
কদম আলি! আর কইও না! আমার শেকড়ে শিরশিরা দিতাছে।
জারুলের ডাল কাঁপে, পাতা কাঁপে। ভাবে আহা! মানুষগুলান কততো সুখী! কেমন সোন্দর কইরা শরম পায়! কদম মৃদু হাই তোলে। ভাবে, জরুটা অল্পতেই বেশি বেশি। আসল কাহিনীতো তাকে সে বলেইনি!
এক সময় সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। বটু মিয়া ডালের সঙ্গে ডালের ঘষা দেয়। তার মানে সে এখন কিছু বলতে চায়। কদম আলী জেগে আছে। জরু ঘুমাচ্ছে।
কদম, ও... কদম।
কও হুনতাছি।
করিম বেপারির পান্ডাগুলা কামডা কি ঠিক করলো? কদম উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। বটু মিয়া এ নিয়ে এ গল্প কয়েক বার করেছে। বারবার সেই ভয়ংকর স্মৃতি কদমকে মনে করিয়ে দিতে চায়।
হুঁ জানি, কইতে অইবো না!
বটু মিয়া তারপরও মাসখানেক আগের এক রাতের ঘটনা সবিস্তারে বয়ান করে। অবশ্য জরু জেগে থাকলে বলতো না। সে আবার ওই ঘটনা শুনলে বেশি ভয় পাবে।
ইশ! সরা মিয়া না হয় হাজার দুই ট্যাকাই চুরি করছে! তাই বইলা গলা কাইট্টা দিতে অইবো? আমার গোড়াটা পুরা রক্তে ভাসা। হালার আর কোনো গাছ পায় নাই!
‘বাদ দাও ওইসব’। কদম আবার বাধা দেয়। ‘তারচেয়ে রাজনীতির আলাপ কর’।
হেইডা আর কী কমু! সবেতো বেড়াছেড়া লাইগা গেল। কেডা যে কহন কোন দিকে পল্টি খায়!
নাসার কোনো খবর নাই?
বটু মিয়া অন্যমনস্ক হয়। বিজ্ঞান বাবদ তার কোনো আগ্রহ নাই। তারপরও কদমের জন্য টুকিটাকি খবর তার রাখতে হয়।
হেরায়তো এবার চান্দে যাওনের লাইগা বুঁচকা বানতাছে।
চান্দে যাইয়া কী লাভ কও দেহি বটু মিয়া। না আছে মানুষ, না আছে গাছ, হ¹লতে মাডি।
হেগো ট্যাকা হেরা যায়, তোর আমার কী?
বয়সের বিস্তর ফারাক থাকলেও গাছ তিনটা অনেকটা একই পরিবারের সদস্যের মতো। হয়তো অনেকদিন পাশাপাশি আছে বলেই। বটু মিয়ার চোখের সামনেই বড় হয়েছে কদম আর জরু। বটুর কাছ থেকে দুজনে যথেষ্ট শিখেছেও। আশপাশে আর কোনো গাছ নেই।
এ ফাঁকে জরুর একটা গোপন কষ্টের কথা বলা যাক। তার গজ তিনেক দূরেই ছিল একটা বকুল। কী তার রূপ! পূর্ণিমার রাতে তাকে মনে হতো ভরা গাঙ। সেই গাঙে ডুব মারতো জরুর যৌবন। বকুল কথাই বলতো না। হুঁ হাঁ করতো শুধু। জরুও লজ্জায় কখনো মনের কথা বলতে পারেনি। শেষতক আর বলাই হলো না। জরু এখনো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর সামনের রাস্তায় মাস্টারকে হেঁটে যেতে দেখলে ক্রোধে জ্বলে ওঠে। জরুকে এ নিয়ে কদম আলি অনেক বুঝিয়েছে। এ জগত আর কদিনের। সবাইকে তো যেতেই হবে। মায়া বাড়িয়ে কী লাভ! তারচেয়ে যে কদিন থাকা একটু আধটু এনজয় করে নিলেই হলো। তবু প্রেমিক হৃদয় বলে কথা। বাইরে থেকে দেখে না বুঝলেও বকুলকে এখনো ভোলেনি জরু। পূর্ণিমার রাতে লুকিয়ে চুকিয়ে একটুখানি কাঁদেও। প্রথমদিকে চোখ বন্ধ করলেই জরু দুঃস্বপ্ন দেখতো। স্বপ্নে কুঠারের ধপ ধপ শব্দটা তার বুক চিরে দিয়ে যায়।
দুই সপ্তাহ পরের কথা। পূর্ণিমার রাত। জরু চাঁদ দেখছে। বাকি দুজন অঘোরে ঘুমুচ্ছে। জরু উদাস হতে থাকে। হঠাৎ কঁকিয়ে ওঠে বটু মিয়া। জরু কদম দুজনই সচকিত।
কী অইল! ও বটু মিয়া কী অইছে!
উফ্ গেলাম! মাইরা ফালাইল!
দ্বিতীয়বার ‘ঠুক’ শব্দটা হতেই সবাই বুঝে যায় কী ঘটেছে। বটুর গোড়ায় কেউ একজন পেরেক ঠুকছে। কদম আলি বটুর গায়ে হাত রাখে। শান্ত হও! ধৈয্য ধর, বেশিণ লাগবো না। বটু মিয়া শান্ত হয়। উবু হয়ে শরীরে সদ্য পুঁতে দেয়া সাইনবোর্ডটি পড়ার চেষ্টা করে। এক সময় এসবে গা করতো না বটু মিয়া। কিন্তু ইদানীং বয়সের কারণে অল্পতেই ঘাবড়ে যায়।
জরু এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। তার মনে ভালো মতোই ভয় ঢুকেছে। চাঁদটাকেও কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। চাঁদের কালো দাগগুলোকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড এক গাছ। হয়তো বকুল। আবার মনে হচ্ছে চেয়ারম্যানের মুখ। তার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। জরুর মনে এক অপার্থিব ভয় জেগে ওঠে। বটু আর কদম আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। জরু তাকিয়ে আছে সামনের খোলা জায়গাটায়। বকুল যেখানটায় ছিল সেখানে একটা হাস্নাহেনার ঝাড়। তার তলায় দলা পাকিয়ে একটা সাপ শুয়ে আছে। জরু ভয় আরো বাড়ে। ডাল-পালা শক্ত হয়ে আসে। কাণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। নাকি এসব অশুভ কোনো সঙ্কেত! চারপাশে থৈ থৈ জোছনা। বকুলের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। জরুর পাতায় ধীরে ধীরে শিশির কণা জমতে থাকে। ভয় আর আবেগের এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে। জরু আবার চাঁদের দিকে তাকায়। এইতো বকুল। আহা! কী রূপবতী হয়েছে! কী আলো!
পরদিন সকাল। কদম আর বটু চোখ বন্ধ করে আছে। তবে চাইলেও তারা কান বন্ধ করে রাখতে পারছে না। শব্দটা তাই শুনতেই হচ্ছে। কুঠার আর করাতের শব্দ ছাপিয়ে কানে বাজছে জরুর গগনবিদারী চিৎকার। আর বড়জোর মিনিট দশেক। তারপর সব সুনসান। বটু শক্ত করে কদমের একটা ডাল ধরে আছে। কদম মাঝে মাঝে ফোঁপানোর মতো শব্দ করছে। একটু পরেই জরুর দেহ মড়মড় করে আছড়ে পড়বে। বটু মিয়া শত চেষ্টা করেও পুরনো স্মৃতিগুলো সরাতে পারছে না। জরু যেদিন প্রথম এসেছিল। কী দুষ্টুই না ছিল! বটু কিছু বোঝাতে গেলেই পাতা উঁচিয়ে বলতো, ইয়েস স্যার। বটু মিয়া থরথর করে কাঁপতে থাকে। কদম আলি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। জরুকে এভাবে কেটে ফেলছে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। এতোদিনকার সম্পর্কের মানে রইল কী!
বটু মিয়া একবার বামে তাকায়। খালি খালি লাগছে। ভেতরটাও। সন্ধা ঘনিয়ে আসে। কদম ক্লান্ত। বটু মিয়া আকাশ দেখছে। পাখিও দেখছে। কতো স্বাধীন তারা। দুজনেই ঠিক করেছে, নিচে আর তাকাবে না। নিজের মানুষগুলোর ওপর তাদের প্রচণ্ড অভিমান। নিচে যাই ঘটুক, এখন তারা শুধু আকাশ দেখবে। হোক সে নিশ্চল আকাশ।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×