somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্যাশন ভিকটিম/ ট্রু কস্ট অব চিপ ক্লথস (দুই খণ্ড যুক্ত করে রিপোস্ট)

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ১১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অথ সস্তা সমাচার
১৩ বৎসর বয়স হইতেই লিনা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করিতেছে। আট ভাইবোনের মধ্যে সেই বড়। এক ভাই অসুস্থ হইয়া পড়ায় তাহার পড়াশোনার পাট চুকিয়া যায়। টিকিট কাটিয়া ঢাকার একটি বাসে সে উঠিয়া পড়ে, চাকুরির সন্ধানে। ইহা ছাড়া তাহার অন্য কোন পথ খোলা ছিল কি? নয় বছর পর এখন সে বেশ বড়সড় একখান ফ্যাক্টরীতে কাজ করে যাহারা Primark, Asda এবং Tescoতে মাল সরবরাহ করে। খুব অল্পদিনেই সে কাজ শিখিয়া যায় এবং তাহার বেতন দাঁড়ায় ২২৫০ টাকায়। এইজন্যে তাহাকে সপ্তাহে ৬০-৯০ ঘন্টা খাটিতে হয়।

পাঠক, বলা নিস্প্রয়োজন কিংবা অবান্তর যে, উপরের এই বিবরণ অতি সরলীকৃত। ইহার ভিতর লুকাইয়া আছে একটি পরিবারের ইতিহাস এবং ইতিহাস, বিশেষ করিয়া নিম্নবর্গের ইতিহাস, অতটা সরলপথে আগায়না। কিন্তু আমরা সেই দিকে যাইতে চাহিতেছি না সেইটা আমাগো লক্ষ্যও না। পাঠক চাহিলে নিজের পর্যবেক্ষন শক্তির সাহায্যেই গল্পের ভিতরকার খাঁজগুলো চিনিয়া লইতে পারিবেন।

লিনার আয় সত্যিকার অর্থেই অনেক কম। এই আয় দিয়া ঢাকা শহরে কোন রকম টিকিয়া থাকাই খুবই কষ্টকর। তাহার স্বামী অসুস্থ এবং কোন ধরনের কাজই সে করিতে পরে না। তাহাকে নিয়মিত চিকিৎসা করাইতে হয়। ইহা সত্ত্বেও সে তাহার গ্রামের বাড়ীতে টাকা পাঠাইবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। এতকিছুর পরেও সে বলিয়াছে সে সুখী। ইহাদের সুখও কত সস্তা!

বিবরণ খানার মাঝখানে একবার আমরা Primark, Asda এবং Tescoর নাম লইয়াছিলাম। যোগটা কোথায়? এইবার আমরা সেইদিকেই যাইব। Primark, Asda এবং Tesco ইহারা হইল খুচরা বিক্রেতা। ইহারা আমাদের নিকট হইতে সপ্তায় কাপড় কিনিয়া ইউরোপ, আমেরিকাতে বিক্রি করিয়া থাকে। এই কোম্পানীগুলা নিজেগোর মধ্যে হামেশাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে লিপ্ত - কে কত সস্তায় মাল দিবার পারে। এইডা হইল বাজার দখলের পবিত্র লড়াই। এই লড়াই পবিত্র এবং পূজনীয় এই কারণে যে ইহাতে রক্তপাত হয় না এবং সেইহেতু আমরা পীড়িত বোধ করিনা। মানবতার পতাকখানি পতপত করিয়া উচ্চে উড়িতেছে। আহা! ধীরে পাঠক ধীরে, অতটা আশ্বস্ত হইয়েন না। কাহিনী আছে। ঐ কোম্পানীগুলা কিভাবে সস্তায় কাপড় বিক্রি করে? একমাত্র তখনই এইডা সম্ভব যখন সে তাহার থেকে অনেক অনেক সস্তায় কাপড় কিনবার পারে। এবং এই অনেক অনেক সস্তাকে সম্ভব করিয়া তুলিতেছে লিনারা। এইডা করিতে গিয়া রক্তপাত হয় পাঠক, তরে সেইটা বাহিরে নয়, ভিতরে। আর আমি, আপনি আজকাল এতটাই ভোঁতা যে চর্মচক্ষুর বাইরে কোনকিছু দেখিবার পাইনা।

অনেকেই বলিয়া থাকেন যে এইসব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী না হইলে এইসব লিনারা না খাইয়া মরিত। তা আমাদের প্রশ্ন এখনই কি তাহারা বাঁচিয়া আছে? আপনারা টিকিয়া থাকিবার নাম দিয়াছেন বাঁচিয়া থাকা এবং এই ভয়াবহ শোষণকে এইভাবেই করিয়াছেন জায়েজ। লিনার মত এইরকম ছয়খানা ফ্যাক্টরীতে কর্মরত ষাট জনের সহিত আমরা কথা বলিয়াছি। এই ছয়খানা ফ্যাক্টরীই Asda এর জন্য কাপড় তৈরী করে, চারখান আবার Tescoর জন্যও কাজ করিয়া থাকে এবং Primark এর জন্যে করিয়া থাকে তিনখান। আমরা ইহাদের মাধ্যমেই এই গার্মেন্টসের ফ্যাক্টরীগুলার ভিতরের পরিস্থিতি জানিবার চেষ্টা করিব।

আইরিশ সংবাদপত্র The Post একবার Primark এর ক্রয়নীতি বিষয়ক একখান রিপোর্ট ছাপাইয়াছিলঃ

একবার এক ফ্যাক্টরী মালিক Primark এর Managing Director Arthur Ryan এর নিকট একটা প্রস্তাব লইয়া আসে। প্রস্তাবটা ছিল একটা Product এর যাহার মূল্য পড়িবে 5 Pound এবং সেইটা 10 pound এ বিক্রি করা যাইবে। Ryan তৎক্ষণাৎ এই বলিয়া জবাব দিয়াছিলেন যে তিনি এই প্রস্তাব তখনই গ্রহণ করিবেন যখন Product cost হইবে 3 Pound এবং সেইটা 7 Pound এ বিক্রি করা যাইবে। এরপর তিনি বলিয়াছিলেন "আমি জানি না আপনারা এইটা কিভাবে করিবেন, কিন্তু এইটাই করিতে হইবে।"

i don't care how you go about it- just do it
Asda হইল মার্কিনী Walmart এর খালতো ভাই। ইহারা বলিয়া থাকে যে ইহারা সস্তায় মাল এইজন্যে দিবার পারে কারণ তাহারা Huge volume এর Fabric কিনিয়া থাকে। কথা সত্য কিন্তু আংশিক। এই বয়ানে আমরা তাহাই বিবৃত করিব।

Primark, Asda এবং Tesco প্রত্যেকেই প্রতি বছর বাংলাদেশ হইতে হাজার কোটি টাকার কাপড় ক্রয় করিয়া থাকে। এই মহব্বতের কারণ কি? কারণটা সোজা এবং সস্তা। এই বাংলাদেশেই ১৯৯০ এর পর থাইকা গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন অর্ধেকে নামিয়া আসিয়াছে এবং এই কারণেই তেনারা এইখানে ছুটিয়া আসিয়াছেন। মুনাফার জন্যে ইহারা পাতালে যাইতেও প্রস্তুত। যদি কোন এক সুন্দর প্রত্যুষে ইহারা এই মর্মে খবর পান যে পাতালে বাংলদেশের থাইকাও সস্তা শ্রমের হদিস মিলিয়াছে তবে তাহাদের এই মহব্বত পাতালগামী হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিবে না। এইটা খালি এই বঙ্গদেশেই ঘটিতেছে না, দুনিয়ার তামাম দেশেই যেইখানে যেইখানে আমাদের ঐ আব্বাগোর সরবরাহকারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আছে, সকলখানেই ঠিক একই নীতি কাজ করিতেছেঃ
i don't care how you go about it- just do it

ইহার মানে সোজা - জলবৎ তরলং। শ্রমিকের মজুরী কমাও, সুযোগ সুবিধা কমাও, চিকিৎসভাতা কমাও (পারো যদি শূন্যে নামাও) এবং যত পার বেশি খাটাও, আরো বেশি খাটাও। Ryan চাচারা care করেন না কিন্তু এইসব জানেন। ঐ বাক্যমধ্যে অনেক না বলা জিনিস রহিয়াছে। কিন্তু উনারা তো এইসব সরাসরি বলিতে পারিতেন? না, পারিতেন না। কারণ ইহাতে তাহাদের ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হইত এমনকি তাহারা হয়ত পুরোপুরি ঐ কোম্পানির মাল খরিদ করাই বন্ধ করিয়া দিত। তাই Ryan চাচা ঐ কথাগুলো বলেন নাই কিন্তু যাহাকে বলিয়াছেন তিনি আবার সমস্তই বুঝিয়া লইয়াছেন। আকেলমান্দ কি লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়।

সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা
Primark, Asda এবং Tesco ইহারা সকলেই একখানা আচরণবিধিতে সহি দিয়াছিলেনঃ
কর্মীদেরকে কোনভাবেই সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি খাটানো যাইবেনা এবং অতি অবশ্যই সপ্তাহে একদিন পুরোপুরি ছুটি দিতে হইবে। অতিরিক্ত সময় (Overtime) কাজ করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে কর্মীর ইচ্ছাধীন। সপ্তাহে ১২ ঘন্টার অধিক অতিরিক্ত সময় খাটানো যাইবেনা। খেয়াল রাখিতে হইবে যেন কোন ভাবেই এইটা (Overtimeটা) নিয়মিত না হয় এবং অতিরিক্ত সময়ের জন্য অবশ্যই তাহাকে উপযূক্ত হারে (Premium rate এ) পারিশ্রমিক দিতে হইবে।

বাস্তবচিত্রটা কি রকম ? অনুসন্ধানে আমরা ইহার বিপরীত বাস্তবতাই পাইয়াছি। ছয়খানা কারখানার অধিকাংশ কর্মীদের সাথেই কথা বলিয়া আমরা জানিতে পারিয়াছি যে তাহাদিগকে প্রতিদিন ১২-১৬ ঘন্টা খাটানো হয় এবং সপ্তাহান্তে সেইটা দাঁড়ায় অনূন ৮০ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ৬ দিন।

মিলি সেলাই করিয়া থাকে Asda এবং Primark এর জন্যে। তাহাকে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করিতে হয়। আব্দুলকে, যে Asda এবং Tescoর জন্যে খাটে, প্রতি সপ্তাহে ৬০-৭০ ঘন্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করিতে বাধ্য করা হয়। রহিমুল তাহার সহকর্মী, সে কাজ করে ৯০-১০০ ঘন্টা। ইফাত এর ব্যাপারখানা আমাদিগকে হতভম্ব করিয়া দিয়াছে। ২০০৬ এর আগষ্টে তাহাকে ১৪০ ঘন্টা অতিরিক্ত খাটিতে হইয়াছে (মানে দাঁড়ায় প্রতিদিন ৮ ঘন্টা overtime ! )। কর্মীরা বলিয়াছে তাহারা খুব কম দিনই রাত ১১ টার পূর্বে ছুটি পাইয়াছেন। আমিবের মালিক এই Primark, Asda এবং Tesco এই তিনটাতেই মাল সরবরাহ করিয়া থাকে। সে আমাদিগকে বলিয়াছে যে কর্মীদেরকে প্রায়শই একটা লক্ষ্য বাঁধিয়া দেয়া হয় এবং কেউ সেটা শেষ না করিবা পর্যন্ত তাহাকে ছুটি দেওয়া হয় না। ফারজানা, যে ইফাত এর সহিত কাজ করে, বলিয়াছে - "যদি নাইটশিফট থাকে তাইলে আমাগোরে ভোর ৩টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। শুক্রবার আমাগোর ছুটি থাকলেও প্রায় শুক্ররবারই আমাগোর ভিউটিতে আইতে হয়।"
শুক্রবার অফিসিয়াল ছুটি হইলেও আমরা দেখিয়াছি যে প্রতিটা সপ্তাহই শেষ হয় ৭ দিনে। রেনু বলিল যে গত দুইমাসে তাহাকে প্রতি শুক্রবারই কাজ করিতে হইয়াছে। আব্দুল ও তাহাই বলিল। আবার যদি কেউ শুক্রবারে না আসে তবে তাহাকে গালাগালি তো করা হয়ই, সেইসাথে তাহার ১ দিনের বেতনও কাটিয়া লওয়া হয়।

Overtime duty কাগজে কলমে কর্মীর ইচ্ছাধীন বলা হইলেও বাস্তবে তাহা ঐ কারখানার management এর অধীন। management এর সিদ্ধান্তে তাহাকে মাসের পর মাস Overtime করিতে হইতেছে। Premium rate তো দূরের কথা, এইসব হতভাগারা অনেক সময় মূল বেতনটা ও ঠিকমত পায়না। মূল বেতনের দাবীতেই যেইখানে এইসব কর্মীদের আন্দোলন করিতে হইতেছে, রাস্তায় মিছিল এবং সেইসাথে উপরিপাওনা হিসেবে পুলিশের লাথি, ঘুঁসি এমনকি মাঝে মাঝেই বুলেট পর্যন্ত খাইতে হইতেছে সেইখানে Overtime এর টাকার কথা তুলিলে হয়তোবা রাস্তায় ট্যাঙ্কও নামিয়া পড়িতে পারে। After all দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখিতে হইবে তো! এইসব মজুরের দলকে কোনভাবেই দেশের শান্তি বিনষ্ট করিতে দেওয়া যায় না। ঐ সব মজুরেরা ইহাদের প্রাপ্য দাবী জানাইলেই দেখি BGMEAর হর্তাকর্তারা AC রুমে গোলটেবিল বৈঠকে বসিয়া যান এবং কিয়ৎক্ষণ পরেই অপেক্ষমান মিডিয়াকে বলিয়া থাকেনঃ "আমরা গভীর ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাইয়াছি এই দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করিবার জন্যে অমুক তমুক কাজ করিতেছে........... ইত্যাদি ইত্যাদি হল্‌না তশকা। আমরা অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করি।" আর যায় কোথা, সাথে সাথেই রাষ্ট্র তাহার সমস্ত কিছু লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে এইসব নিরস্ত্র, নিরন্ন মানুষগুলার উপর। রাষ্ট্র তো ইহাদেরই, ইহারাই ইহাদের পুঁজিকে রক্ষা করিবার নিমিত্তে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়াছে এবং সেইসাথে রাষ্ট্রকে করিয়াছে সর্বতোভাবে সংগঠিত যাহাতে তাহারা এইসব মোকাবিলা করিতে পারে।

ঘন্টায় ৫ ট্যাহা
১৯৯৪ সাল থাইকা বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস কর্মীর সর্বনিম্ন মজুরী হইলো গিয়া ৯৪০ টাকা (প্রতিমাসে)। এই লইয়া তাহারা যখন ২০০৬ সালে আন্দোলনের ডাক দেয়, ডাক দেয় ধর্মঘটের, তখন The National Minimum Wage Board এর কর্তারা বৈঠকে বসেন। তাহারা প্রস্তাব করেন ইহাকে মাসপ্রতি ১৬০০ টাকায় উন্নীত করিবার। এইডা দিয়া যে চলা যায় না তাহা Primark, Asda এবং Tesco ওয়ালারাও স্বীকার করিয়াছেন। তাহারাও মানেন যে এইখানে সর্বনিম্ন মজুরী (lowest wage নহে living wage) হওয়া উচিত অন্যূন ৩০০০ টাকা (মাসপ্রতি)। ঐ মানা পর্যন্তই। আমরা অনুসন্ধানে যাহা পাইয়াছি তাহা ৯৯৫ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে। গড় করিলে দাঁড়ায় ১০০০ টাকা ।

নাজেরা প্রতিমাসে পায় ১১০০ টাকা। সে যে ফ্যাক্টরীতে কাজ করে তাহারা Asda এবং Tesco তে supply দেয়। তাহার সহকর্মী আব্দুল বেশ হতাশার সাথেই কহিল - "এইখানে কাম কইরা আমাগো কোন ভবিষ্যত নাই।" রুনা পায় ১০৫০ টাকার মত কিন্তু আরেকটু ভালো থাকিবার জন্যে সে Overtime করে। Overtime সহ সব মিলাইয়া সে পায় ১৪৫০ টাকা। মহুয়া আর হুমায়ুনের লগে আলাপ করিয়া আমরা জানিতে পারিলাম যে তাহারা মাসে প্রায় ২০০০ টাকার মতো পায় কারণ তাহার সেলাইকল চালাইতে বেশ দক্ষ। কিন্তু এইজন্যে তাহাদেরকে সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা খাটিতে হয়। সকল মিলাইয়া হিসাব করিলে দাঁড়ায় ঘন্টাপ্রতি তাহাদের মজুরী ৫ টাকা বা তার সামান্য কিছু বেশী। ইহাই যদি হয দক্ষ শ্রমিকের মজুরী তবে বাকীদের হিসেবের আর প্রয়োজন থাকে কি?

পুরো ২০০৬ সালটাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে একের পর এক আন্দোলন হইয়াছে। গার্মেন্টস নেতৃবৃন্দ বারংবার সরকার ও BGMEA কর্তাদেরকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ইত্যাদি লইয়া আলোচনায় বসিবার আহব্বান করিয়াছিলেন। তাহারা তখন অন্যত্র মগ্ন ছিলেন (হয়তোবা আসন্ন নির্বাচন লইয়া)। এইদিকে ফেব্রুয়ারী ২০০৬ এ একখানা গার্মেন্টস ভবন পুরোপুরি ধসিয়া পড়ে। মারা পড়ে ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক, পঙ্গু হয় তারও বেশি। কিন্তু ইহাতেও কাহারো কিচ্ছু যায় আসে না। এই বঙ্গদেশে শ্রমিকের জীবনের দাম মশা-মাছির অধিক নহে।

আমরা যাহাদের সাক্ষাৎকার লইয়াছি তাহারা সবাই বলিয়াছে যে তাহাদের জরুরী নির্গমন পথ (Emergency Exit) সর্বদা তালাবদ্ধ থাকে। অতএব আগুন লাগিলে ঐখানে পুড়িয়া মরা ছাড়া তাহাদের আর গত্যন্তর থাকে না। কোট-টাই পরা ভদ্রলোকদের অফিসে আগুন লাগিলে উদ্ধারার্থে সেইখানে হেলিকপ্টার যাইতেও আমরা দেখিয়াছি কিন্তু ইহাদের বাঁচাইতে সেইরূপ কোন কর্মকান্ড অদ্যাবধি আমরা দেখিতে পাই নাই। যে দমকল বাহিনী যায় তাহাদের লক্ষ্য থাকে যন্ত্রপাতিকে উদ্ধার করা, মানবসদৃশ ঐ কীটপতঙ্গগুলিকে নয়। ইহারা মরিলেই কি ! একপাল মরিলে আগামীকালই আরো এক পাল কারখানার গেটে লাইন দিবে কাজের আশায়। যন্ত্রপাতি বাঁচানো গেলে তো ক্ষয়ক্ষতি একটু কম হয়, নাকি?

মে মাসের দিকে আন্দোলন তীব্র হইয়া উঠে। Tesco মামাদের supply দেনেওয়ালা এক কারখানায় মজুরী হ্রাসের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা রাস্তায় নামিয়া আসে। সাথে সাথেই আমাগো আজ্ঞাবাহী পুলিশ চাচারা লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ (ইদানীং ইহা বেশ পুলিশপিয় হইয়া উঠিয়াছে) শুরু করিয়া দেয়। ইহাতে একজন শ্রমিক শহীদ হয় এবং শতাধিক মারাত্মক আহত হয়। শ্রমিকরা তখন সুনির্দিষ্ট ১০ দফা দাবীনামা পেশ করে যাহতে মজুরী বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার এর মত মৌলিক বিষয়গুলো ছিল যেগুলো Tesco মামুদের দেশে অনেক আগে থেকেই নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে। আসলে এইটা হঠাৎ কইরা শুরু হইয়া যায় নাই। অনেক দিন ধরিয়াই গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক অসন্তোষ একটু একটু করিয়া বাড়িতেছিল। ২০০৫ সালের দিকে Primark কে সরবরাহকারী এক ফ্যাক্টরীতে তত্ত্ববিবায়ক মহাশয় (Superviser) তিনজন শ্রমিকের গায়ে হাত তুলিলে শ্রমিকরা management এর লগে সংঘর্ষে জড়াইয়া পড়ে। ২০০৪ সালেও এইরকম একটি ঘটনা ঘটে। ট্রেড ইউনিয়ন করা ২২জন শ্রমিকের একখানা দল তাহাদের প্রাপ্য Overtime চাহিলে management তাহদের উপর চড়াও হয় এবং মিথ্যা অভিযোগ করিয়া তাহাদের হাজতে পুরে। পুরবেই তো! ফ্যাক্টরী তাহাদিগকে বেশ কিছু সহজ প্রস্তাব দিয়াছিল - ১৯ ঘন্টার শিফট (দৈনিক, Overtime ছাড়া) এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুযোগসুবিধা বাতিল। ব্যাটাদের সাহস কত বড় ! দলবল লইয়া Overtime চাহিতে আসে !!!

এক্ষণে পাঠকের মনে এই প্রশ্ন উদয় হইলেও হইতে পারে যে গার্মেন্টস সেক্টরে হঠাৎ কী এমন ঘটিল যে এইসব শ্রমিকেরা জান-মালের কথা না ভাবিয়া বেপরোয়া আন্দোলন শুরু করিয়া দিয়াছে? সরকারের মূর্খনীতি (গার্মেন্টস সেক্টর লইয়া) এবং মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা এইটাই হয়ত উত্তরে আপনার মনে হইবে প্রথমত। ইহা সত্য, কিন্তু অধিকতর সত্য হইল -
i don't care how you go about it - just do it

No chance at all, they have no place at wal-mart
এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানিই (Asda, primark, tesco) শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে বলিয়া দাবী করিয়া থাকে। শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করিতে পারিবে, তাহাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করিতে পারিবে। এমনকি ম্যানেজমেন্ট এর লগে তাহাদের দাবী দাওয়া লইয়া দর কষাকষিও করিতে পারিবে! সত্যি নাকি?

primark, Asda এবং tesco এই তিনটিতেই সরবরাহকারী একখানা ফ্যাক্টরীর শ্রমিকেরা আমাদের জানায় যে ২০০৫ সালে কামাল নামে একজন শ্রমিককে (ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করিবার গুরুতর অপরাধে) চোর সাব্যস্ত করিয়া কারখানা হইতে বের করিয়া দেয়া হয়। অথচ ইহা ছিল বানোয়াট। তাহার সত্যিকার অপরাধ (গুরুতর)- সে শ্রমিক ইউনিয়ন দাঁড় করাইবার চেষ্টা চালাইতেছিল। তাহাকে বেদম মারধর করা হয় এবং সবশেষে তাহার চাকুরী কাড়িয়া লওয়া হয়। এইভাবেই আমাদের বাজানরা আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন করিবার স্বাধীনতা সংরক্ষণ করিয়া থাকেন।

অধিকাংশ শ্রমিকই তাহাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নহে। ভুল বলিলাম, প্রকৃতপক্ষে তাহারা জানেনই না তাহাদের কি কি অধিকার রহিয়াছে। এই সুযোগখানিই ইহারা গ্রহণ করিয়া থাকে। চারিদিকে ইহারা তৈরী করে একে ভয়ের বাতাবরণ। আমি ট্রেড ইউনিয়ন করি, মালিকপক্ষ ইহা জানিতে পারিলেই আমার চাকুরী যাইবে এই ভয়ে সর্বদা উৎকণ্ঠিত থাকে শ্রমিকেরা। আর কে না জানে যে চাকুরী গেলে ইহাদের সকলই যাইবে। সুমহান মালিকশ্রেণীর সেবা করিতে না পারিলে ইহাদের জীবনের আর মূল্য থাকিল কোথায়?

আমরা কেবল একজনকেই পাইয়াছিলাম যে আমাদের কাছে স্বীকার করিয়াছিল সে ট্রেড ইউনিয়ন করে - “যদিও আমার ইউনিয়নের মালিক আমারে চিনে না কিন্তু আমি ইউনিয়ন করি এইডা জানলেই মালিক আমারে চাকুরি থাইকা বাদ দিয়া দিব।” এই প্রতিবেদন প্রণয়নকালে আমরা দেখিয়াছি এবং বুঝিয়াছি ট্রেড ইউনিয়ন আতঙ্ক কাহাকে বলে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সর্বদাই ট্রেড ইউনিয়নের সহিত কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট না হইবার জন্যে হুমকি দেয় এবং এই মর্মে শাসায় যে ট্রেড ইউনিয়ন করিলে তোমাদের ‘চাকরি not’। ট্রেড ইউনিয়ন হইতে শ্রমিকদের দূরে সরাইয়া রাখিবার আয়োজনই কেবল চলে না, এমনকি যাহাতে কোন ধরনের ইউনিয়নই গড়িয়া উঠিতে না পারে সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখে মালিকের পোষা কুত্তারা। ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা যাহাতে ফ্যাক্টরীতে ঢুকিতে না পারে সেইজন্যে স্থানে স্থানে ইহাদের পাহারা থাকে। আপনি ট্রেড ইউনিয়ন করিয়া থাকিলে এই কুত্তাগুলোর ঘেউ ঘেউ শুনিবার অভিজ্ঞতা আপনার নিশ্চয়ই হইয়াছে।

Primark, Asda এবং Tesco মামুদের website এ গেলে শ্রমিকের অধিকার লইয়া পাতার পর পাতা বিভিন্ন ধরনের গালভরা বুলি দেখিবেন। অথচ আসল জিনিসটাই আপনি সেইখানে খুঁজিয়া পাইবেন না- সেইটা হইলো ইহাদের Company Policy, আপনেগোরে একটা খবর দেই তাইলে। মার্কিন মুল্লুকের Wal-mart (Asda’i parent company) হইলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ চেইন মার্কেট (আমাদের দেশের নন্দন, Agora, Meena Bazar) এবং অতি অবশ্যই Multinational। পৃথিবীর ম্যালা দেশে ওগোর ব্যবসাপতি আছে। এরা 'Trade union' রে কতটুকু ডরায় শুনিবেন? এনাগোর একটা 'Rapid Reaction Team' আছে যাহাদের নিজস্ব বিমানবাহিনী সবসময়ই WalMart এর ভিতরে যাহাতে TUV (Trade Union Virus) হান্দাইতে না পারে সেই লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করিতেছে। তাহাদের জবানেই শুনেনঃ
“অন্যান্য কোম্পানিতে ট্রেড ইউনিয়ন থাকিলেও থাকিতে পারে কিন্তু আমাদের এইখানে? ? No chance at all. They have no plae at WalMart”

এইসব করিতে গিয়া Asda একবার ধরাও খাইছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন হইতে বিরত রাখিতে চাহিলে একটা Employmnet Tribunal, Asda কে ৮৫০০০০ পাউন্ড জরিমানা করে। এইটা ছিল ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। মাস তিনেক পরেই অর্থাৎ মে মাসেই Asda তাহার নতুন US Franchise এর জন্যে লোক চাহিয়া একখানা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। তাহাতে বলা হইয়াছিল “ট্রেড ইউনিয়নের সহিত যে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতাকে প্রার্থীর অযোগ্যতা বলিয়া বিবেচনা করা হইবে।” থাইল্যান্ডে Tesco’ র Franchise হইলো Tesco Lotus । এইখানে ট্রেড ইউনিয়ন দাঁড় করাইতে লাগিয়াছে পাঁচ বছর। ট্রেড ইউনিয়ন যাহাতে ঠিকঠাক কাজ করিতে না পারে সেইজন্য যথোপযুক্ত চাপ ও তাপ অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশ অদ্যাবধি সেইখানে বজায় রহিয়াছে।

চুপ, কোন কথা নাই
প্রতিবেদনখানা তৈরী করিবার সময়কালে ‘Guardian' পত্রিকায় Asda'র একখানা বিজ্ঞপ্তি আমাগোর নজরে আসে। বিজ্ঞপ্তিখানাতে Asda বলিতেছিল-
“আমরা যে সকল স্থান হইতে supply লইয়া থাকি সেইখানে কোন ধরনের আপোষ করি না (অর্থাৎ সেইখানকার কাজের পরিবেশ লইয়া)। এই কারনেই গত বৎসর আমরা, Wal Mart এবং Asda, প্রায় তের সহস্রাধিক এরও বেশী কারখানাতে অডিট (Audit) করাইয়াছি। দুইশত অডিটর (Auditor) এবং নিরপেক্ষ (Independent) পরিদর্শক কারখানাগুলোর কাগজপাতি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়াছেন এবং হাজারখানেকেরও বেশী শ্রমিকদের সহিত কথাবার্তা বলিয়াছেন। তাহারা শ্রমিকদের কাছে জানিতে চাহিয়াছেন যে তাহাদের সহিত কিরকম আচরণ করা হয়, তাহাদিগকে ঠিকঠাক মজুরী প্রদান করা হয় কিনা, তাহাদিগের কাজের পরিবেশ কিরকম ইত্যাদি ইত্যাদি। এই হইলো আমাদের ব্র্যান্ড এবং ইহার মানে আমাদের কাছ থাইকা অমলিন বিবেক লইয়া আপনি ক্রয় করিতে পারিবেন (একটুও ময়লা লাগিবে না) ”।

সত্যি নাকি? পাঠক আপনি হয়ত আমার থাইকাও বেশী ভালো করিয়া জানেন যে এইসব মাল্টিনেশনওয়ালারা মিথ্যাচারে কি পরিমাণ পারদর্শী। আমরা যে সকল কারখানাগুলোতে গিয়াছি প্রায় প্রত্যেকেটাতেই কিন্তু ভিন্ন বাস্তবতা দেখিয়াছি। গার্মেন্টসওয়ালারা আগেই শ্রমিকদের নোটিশ দিয়া অডিট এর জন্য প্রস্তুত করিয়া রাখে। তাহাদিগকে কাজের পরিবেশ, সময়, মজুরী, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাজনিত প্রায় সকল বিষয়গুলোতেই মিথ্যা বলিতে বাধ্য করা হয়। এই আক্রার বাজারে চাকুরী চলিয়া যাইবার ভয়ে তাহাদের আর কিইবা করার থাকে। এইখান থাইকা আপনি হয়তো বুঝিতে পারিবেন মালিকপক্ষ এবং তাহাদের প্রতিনিধিত্বকারী এবং সমশ্রেণীদ্‌ভূত সরকার ঠিক কোন কারণে ট্রেড ইউনিয়নকে দূর্বল করিবার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

অডিটর হইয়া যাহারা আসেন তাহাদের সামনে কিছু শ্রমিকদের হাজির করানো হয় যাহাদেরকে ম্যানেজাররা আগেই শিখাইয়া পড়াইয়া তৈরী করিয়া রাখে। আমিন বলছিল- “ইন্টারভিউ লওনের সময় আমারেও মিছা কথা কইতে হইছিল কারণ ফ্যাক্টরী ম্যানেজমেন্ট আমারে ডর দেখাইছিল যে তাদের কথা না শুনলে আমার চাকরি থাকব না।”

শ্রমিকের আসলেই কোন রাস্তা নাই। অডিটরদেরও তাহারা বিশ্বাস করিতে পারে না। কি করিয়া সে জানিবে যে অডিটরের নিকট সত্য বলিলে সে ম্যানেজারদের তাহা বলিয়া দিবে না? দেখিতে যে তাহারা একই রকম! Asda এবং Tesco তে Supply দেনেওয়ালা এক কারখানাতে কর্মরত এক শ্রমিক আব্দুল আমাদের জানায়- “এই সকল লোকেরা যারা বায়ার (Buyer)গোর থাইক্যা আহে তারা আসলে মালিকগোরটাই দ্যাহে, আমাগোরটা না।”

গত বছর Asda’র Parent company Wal Mart এর Clean-Clothes campaign চলাকালে শ্রমিকেরা জানায় -
“প্রতি মাসেই বায়ারদের থাইকা দুই/তিন বার অডিটররা আসে কিন্তু তারা মূলত ম্যানেজমেন্ট এর লগেই কথা সারে। ম্যানেজমেন্ট আমাদের আগেই জানাইয়া রাখে কখন তারা আসবে এবং ম্যানেজমেন্ট আগেই ঠিক করে কোন শ্রমিকদেরকে অডিটরদের কাছে পাঠানো হবে। আমরাও তাই বলি যা ম্যানেজমেন্ট আমাদের বলতে বলে এবং আমাগোর মাঝে যাগোর রগ একটু ত্যাড়া মানে যারা হয়ত একটু উল্টাপাল্টা কইবার পারে তাগোরে অডিটর চইলা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কারখানাতে ঢুকতে দেয়া হয় না।’

Asda, Primark, Tesco এইসব অডিটই ক্রেতাদের প্রদর্শন করিয়া বলিয়া থাকে যে তাহারা কিভাবে কারখানাগুলোতে সুন্দর এবং মানবিক কাজের পরিবেশ রাখিতে মালিকপক্ষকে বাধ্য করিতেছে। ক্রেতারাও খুশী। সস্তায় কাপড় কিনিয়াও তাহারা শুদ্ধ অমলিন বিবেক বজায় রাখিতে পারিতেছে। তাহার ব্যবহৃত ব্র্যান্ড কোম্পানী অন্তত শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন করিতেছে না। কি আনন্দ! চায়নার Shenzhen এ অবস্থিত Institute of contemporary observation এর Dr. Liu Kaiman কিন্তু জানান অন্যকথা, তিনি বলেন- “এইসব খুচরা বিক্রেতারা (Asda, Primark, Tesco) এবং তাদের সরবরাহকারীরা আসলে এক ধরনের খেলা খেলে। তাদের আসলে নজর ভোক্তা ক্রেতার উপরে, শ্রমিকের কাজের পরিবেশ এর দিকে নয়।”

প্রতি বছর এই রকম প্রায় সহস্রাধিক অডিট হয়। কিছু হয় কোম্পানীর নিজস্ব মনিটরিং এর মাধ্যমে আর কিছু হয় বাইরের অডিট ফার্মগুলা দিয়া। এই রকম একখানা অডিট এ থাকে তিনটা জিনিস-
১। কাগজপত্র দেখভাল - বেতনভাতার খাতাপত্র (Wage sheet), কর্মদিবস এবং কর্মঘন্টার খাতাপত্র, শ্রমিকদের ব্যক্তিগত রেকর্ড ইত্যাদি।
২। সাইট (Site) পর্যবেক্ষণঃ স্বশরীরে কারখানায় গিয়া কর্মরত শ্রমিকদের পর্যবেক্ষণ, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার।
৩। সাক্ষাৎকার- ম্যানেজার থাইকা শুরু কইরা শ্রমিকদের লগে কথাবর্তা। খুব বেশী হইলে ট্রেড ইউনিয়ন এর লগেও কথাবার্তা হয়।

সুধী পাঠক সিস্টেম তো ভালোই, নাকি কন? কিন্তু ঘটনা যে ভাই প্যাঁচ খাইয়া যায়। এইসব অডিট এর বেশীর ভাগেই কতক্ষণে হয় জানেন? মাত্র কয়েক ঘন্টায়! কোন কোন ক্ষেত্রে পরিদর্শক আসার ২০ দিন আগেই আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে দেয়া হয় যাতে তারা এর মধ্যেই সবকিছু গোছগাছ কইরা রাখে। কারখানার গায়ে তখন লাগে নতুন রং, সবকিছু পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন কইরা রাখা হয়, সবকিছু। কারখানা, শ্রমিকদের কলোনী (যদি থাকে), তাগোর বেতন ভাতার কাগজপত্র, টাইম টেবিল সব। বেতন ভাতার কাগজপত্র, টাইম টেবিল ? এইগুলা পরিস্কার করে ক্যামনে? হরে ভাই এইগুলাও পরিস্কার হইয়া যায়। পুরানা সংখ্যাগুলোর বদলে বসে নতুন সংখ্যা। অডিটররা হাত পা চেনে না, মুখ তো দূরের কথা। ওদের চোখ কেবল সংখ্যা চেনে, সুন্দর সুন্দর সংখ্যা। চার অংকের বৃহত্তম সংখ্যা, ক্ষুদ্রতম সংখ্যা। বিয়োগ চেনে? জানি না।

মালিকপক্ষ তাহার ম্যানেজারগুলার মাধ্যমে শ্রমিকদের হাতে প্রশ্ন এবং যথাযথ (!) উত্তর সম্বলিত কাগজপত্র ধরাইয়া দেয়। পরিদর্শকরা উত্তর পাইয়া খুশী, খুশী মালিকপক্ষ, খুশী ম্যানেজারবৃন্দ, খুশী সরকার, খুশী Asda, Primark, Tesco, খুশী আমাগো দাতাগোষ্ঠী, সবাই খুশী। আমরা কেবল পারিলাম না। কি কইরা পারি বলেন যহন শুনি এইডা সকলেই জানে যে প্রত্যেকটা কারখানাতেই দুই সেট খাতা রাখা হয়- একটা মালিকপক্ষের হিসাব নিকাশের লাইগা, আরেকটা পরিদর্শকদের দেখানোর লাইগা! এমনকি পরিদর্শকও সেইটা জানে।* (* আমার এক চাচাতো ভাই যে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক সেও আমাকে এই কথা বলিয়াছে যে তাদেরকে দুই সেট খাতাপত্রে সই করিতে হয়।)

একদল গবেষক ২০০৫ সালে পরিচালিত এক নিরীক্ষাতে দুনিয়ার চলিশ্লখানা ফ্যাক্টরীর ৬৭০ জন শ্রমিকের লগে কথাবর্তা কয় যারা WalMart এ Supply দেয়। চায়নাতে কিছু ম্যানেজার তাহাদের জানায় WalMart এর পরিদর্শকদের বেআক্কেল বানানো আসলে সোজা। কারণ WalMart এর অর্ডার খুব কম পয়সার এবং পরিদর্শকরাও খুব বেশী ঝামেলা টামেলা করে না।

এই দিকে কেনিয়ার এক ফ্যাক্টরীর (এরাও Walmart এ Supply দেয়) শ্রমিকরাও জানায়-
“এইসব অডিট আসলে আমাদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য না, এইসব হইলো অর্ডারগুলা যাতে ঠিকঠাক থাকে এবং ধূর্ত ম্যানেজমেন্ট তাই অডিটরদের সামনে আমাগোরে কুমিরর ছানার লাহান হাজির করে।”

যেইভাবে গবেষণাটা করা হইয়াছেঃ
গবেষকরা যে ছয়খানা ফ্যাক্টরীতে গিয়াছেন তাহারা হয় Tesco, Asda নয় Primark কিংবা সবগুলোতেই Supply দেয়। এই কারখানাগুলো এলোপাতাড়িভাবে নিবার্চন করা হইয়াছে। এমন নহে যে বাজে পরিস্থিতির কারখানাগুলো খুঁজে বের করা হইয়াছে এবং নির্বাচিত কারখানাগুলো যাহাতে বৈশিষ্ট্যসূচক প্রতিনিধিত্বকারী হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখা হইয়াছে। গবেষকরা শ্রমিকদের আস্থা আছে এমন সব ট্রেড ইউনিয়ন এবং স্থানীয় শ্রম অধিকার সংরক্ষণকারী দলের মাধ্যমেই শ্রমিকদের সহিত যোগাযোগ করিয়াছেন। ২০০৬ এর আগষ্ট হইতে অক্টোবরের মধ্যে ষাটজন শ্রমিকের সহিত গবেষকগণ কথা বলিয়াছেন এবং নিরপত্তাজনিত কারণে সকল শ্রমিকের নামই পরিবর্তন করা হইয়াছে।

যে মূল সমস্যাটি গবেষকদের মোকাবিলা করিতে হইয়াছে সেইটা হইলো শ্রমিকদের টাইম টেবিল। মেটামুটিভাবে সবগুলা সাক্ষাৎকারই নেয়া হইয়াছে রাত ৮টার পরে। ইহার আগে তাহাদের সহিত যে দেখা হইবার ফুরসৎই নাই। বস্ত্রবালিকাদিগের (মহান পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল কর্তৃক প্রদত্ত নাম) ক্ষেত্রে তো গবেষকদের রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইয়াছে এবং সব ক্ষেত্রেই গবেষকগণ শ্রমিকেরা যেখানে থাকেন সেইখানে কথাবার্তা বলিয়াছেন কারণ কারখানায় তাহারা এইসব বলিতে ভয় পায়।

শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করিতেও কিছুটা সময় গিয়াছে। গবেষকগণ সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়িয়াছেন মেয়ে শ্রমিকদের সহিত কথা বলিতে গিয়া কারণ Gender Sersitivity বাংলাদেশে বেশ বড় একটা ইস্যু। এই সময়টাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বেশ টালমাটাল ছিল।


কারখানা--শ্রমিকের সংখ্যা--মেয়ে শ্রমিক---যেখানে Supply দেওয়া হয়
ক--------৫০০-----------৭০%--------- Asda, Tesco, Pri
খ--------১১০০----------৭৩%--------- Asda
গ--------১২০০----------৭৫%--------- Asda, Pri
ঘ--------৫০০-----------?------------- Asda, Tesco, Pri
ঙ--------১২০০----------৬৯%--------- Asda, Tesco
চ--------৫৭৫-----------৬১%---------- Asda, Tesco

আমাগোর কথাঃ
এইসব অডিট আসলে পরিচালিত হয় ফ্যাক্টরীগুলার ক্যাপাসিটি বাড়ানোর লাইগা যাতে তারা আরো বেশী বেশী ঝঁঢ়ঢ়ষু দিবার পারে। বেশী মাল, বেশী লাভ। শ্রমিক এইখানে কুমিরের ছানা। না, ঠিক হইলো না, শ্রমিক হইলো ব্যাঙের পোনা। ব্যাঙের পোনার মত এরা জন্মাবে, কারখানার গেটে হাজির হবে, কোনরকমে বাঁইচা থাকার লাইগা যেনতেন একটা মজুরীতে কাজ করবে সকাল নয়টা থাইকা রাত এগারোটা পর্যন্ত, কাজ করতে করতে একদিন ধুপ কইরা মইরা যাবে। ততদিনে জন্মাইয়া যাবে আরও লক্ষ লক্ষ পোনা। আর এইসব ব্যাঙের পোনার শ্রমে বাঁইচা থাইকা আমরা লেইখা যামু আরো দুয়েক কিস্তি।



মূল রচনাঃ
Fashion Victims/ The True Cost of Cheap Cloths at Primark, Asda, Tesco (Published December 2006
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:০৮
১৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×