"শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালের লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ছিল তখন তার দাওয়াতে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জিল্লুর রহমান সেখানে যান। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ও মান্নায় ভূইয়া আসেন। সেখানে তারা পান সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে। কার্টার, লতিফুর রহমান ও দুই দলের প্রধান ব্যাক্তিরা সেখানে নির্বাচিত সরকার কি কি করবে এসব বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচিত সব বিষয় থেকে শেখ হাসিনা একটি বিষয়ে বলেন, সেটি হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। সেখানে বলা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি প্রয়োজন, তাই রপ্তানী করতে হবে। উত্তরে শেখ হাসিনা নাকি বলেছিলেন যে গ্যাস বাংলাদেশের মানুষের সম্পদ। এটা তাদের বিষয়, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে গ্যাস রপ্তানি করা হবে। আর খালেদা জিয়া নাকি বলেছিলেন গ্যাস মাটির নীচে রেখে লাভ কি, গ্যাস বিক্রি করে দিলে টাকা পাওয়া যাবে। খালেদার এই কথাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন যে, ২০০১ সালে খালেদা জিয়া বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। শেখ হাসিনার এই বক্তব্য রেকর্ড করা আছে।---- আমরা যদি দেখি ফুলবাড়ির কয়লার বিষয়ে কোন অপতৎপরতা চলছে, সমুদ্রের গ্যাস শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানির ফাইল তার কাছে গেছে কিন্তু সেটা তিনি বাতিল করছেন না এবং সরকার সেটা পাস করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে, তাহলে শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী আমাদেরকে বলতে হবে যে শেখ হাসিনার সরকার কি তাহলে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে!-----"
কথাগুলো বলেছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ১০ জুলাই ২০০৯ তারিখে "সাপ্তাহিক" নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকে। এখন, ২৪ আগষ্ট শেখ হাসিনার সরকার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখেই কনোকো ফিলিপস ও টাল্লোর কাছে সাগরের ৩টি গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে, আনু স্যার কিংবা আর কেউ যদি মুচলেকার বিষয়ে নি:সন্দেহ হয়ে যান, তাদের নিশ্চয়ই দোষ দেয়া যাবে না! আমরা মনে করি, ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মুচলেকা দেয়া এমন কোন কাঠিন বা ব্যাতিক্রমী বিষয় নয়- অস্বাভাবিকও নয়। তবে মুচলেকা না দিয়েও এরা জাতীয় সম্পদ বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে তুলে দিতে পারে- কারণ এটাই তাদের শ্রেণী স্বার্থ ও শ্রেণীগত উন্নয়ন দর্শন, যে কারণে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মত বর্তমান সরকারও জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ধারাবাহিকভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। গ্যাস ও জ্বালানী সংকটের সময়ে ৮০% রপ্তানীর বিধান রেখে গভীর সমুদ্রের ৩টি ব্লক ২টি বহুজাতিক কোম্পানীর কাছে ইজারা দেয়ার ঘটনাটি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
ইজারা কার্যক্রম:
গভীর সমুদ্রের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোকে ইজারা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন দেশের সমুদ্র এলাকাকে মোট ২৮ টি ক্ষেত্রে (৮টি অগভীর ও ২০টি গভীর) ভাগ করে নতুন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির মডেল ও খসড়া দরপত্র উপদেষ্টা পরিষদে তড়িঘড়ি করে অনুমোদন করিয়ে ২০০৮ এর ২৮ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়। এই দরপত্রে যু্ক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনোকো ফিলিপস, অষ্ট্রেলিয়ার স্যান্টোস, চীনের সিনোক, আয়ার ল্যান্ড ভিত্তিক টাল্লো বাংলাদেশ এবং কোরীয় ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন সহ সাতটি কোম্পানী ১৫টি ক্ষেত্র অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব কোম্পানির দরপত্র যাচাই বাছাই করে একই বছরের জুলাই মাসে দুটি কোম্পানিকে নয়টি ক্ষেত্রের জন্য যোগ্য ঘোষণা করে। কোম্পানী দুটির মধ্যে কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রের ১০, ১১, ১২, ১৫, ১৬, ১৭, ২০ ও ২১ -এই আটটি ক্ষেত্রের জন্য এবং টাল্লো বাংলাদেশ অগভীর সমুদ্রের ৫ নম্বর ক্ষেত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়। জনগণের আন্দোলন ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এগুলো ইজারা দেয়ার সাহস না করলেও জনগণের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেই এগুলো রিভিউ করার জন্য অর্থনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠায় এবং অবশেষে ২৪ আগষ্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ ব্লক নম্বর কনোকো ফিলিপসকে এবং অগভীর সমুদ্রের ৫ নম্বর ক্ষেত্র টাল্লো বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মণ্ত্রণালয় মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তের চিঠি পাওয়ার পর পেট্রোবাংলাকে চুক্তি স্বাক্ষরের নির্দেশ দিবে। এই নির্দেশ পেয়ে পেট্রোবাংলা কোম্পানি দুটিকে চিঠি দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বলবে।
মডেল পিএসসি ২০০৮ এর কিছু দিক:
১) আর্টিক্যাল ১৪.৩ অনুসারে কোম্পানীটি বছরে পুরো উত্তোলিত গ্যাসের সর্বোচ্চ ৫৫% পর্যন্ত গ্যাসকে কষ্ট রিকভারী গ্যাস হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। বাকি ৪৫% গ্যাস হলো প্রফিট গ্যাস যা আবার কোম্পানী এবং পেট্রবাংলার মাঝে সুনির্দিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী দুই ভাগে বিভক্ত হবে। আমরা জানিনা আলোচ্য তিনটি ব্লকের ক্ষেত্রে কনোকো ফিলিপস ও টাল্লোর সাথে ঠিক কি অনুপাতে এই ভাগাভাগিটি নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। যাই হোক, আর্টিক্যাল ১৪.৪ অনুসারে কষ্ট রিকভারির খাত গুলো হলো:
ক) পরিচালন ব্যয় বা অপারেটিং কষ্ট
খ) ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচার বা খনি উন্নয়নের জন্য কোম্পানীটিকে যে সময়, শ্রম ও পুঁজি বিনোয়োগ করতে হয়েছে তার খরচ;
গ) অনুসন্ধান বা এক্সপ্লোরেশনের জন্য যাবতীয় খরচ;
২) আর্টিক্যাল ১৫.৪ অনুসারে কন্ট্রাক্টর কোম্পানী পুরো প্রতিবছর সর্বোচ্চ গ্যাস রিজার্ভের ৭.৫ শতাংশ করে উত্তোলন করতে পারবে। তবে বিশেষ নোট দিয়ে বলা হয়েছে, অফসোর বা সমুদ্রবক্ষের গ্যাস ক্ষেত্রের ক্ষেত্রে ৭.৫% কথাটির সাথে অথবা হিসেবে "পেট্রবাংলার সাথে চুক্তি সাপেক্ষে এর চেয়ে আরও বেশী পরিমাণ " বাক্যাংশটি যুক্তকরতে বলা হয়েছে।
৩) আর্টিক্যাল ১৫.৫.১ এ নিম্নোক্ত তিন ধরনের গ্যাসকে এলএনজি হিসেবে রপ্তানী করার বিধান রাখা হয়েছে:
ক) কন্ট্রাক্টরের কষ্ট রিকভারী গ্যাস
খ) কন্ট্রাক্টরের প্রফিট বা লাভের গ্যাস
গ) পেট্রোবাংলার লাভের গ্যাস
এখানে, এলএনজি হিসেবে গ্যাস রপ্তানীর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পেট্রবাংলার সাথে পৃথক চুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
৪) আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে, পুরো উৎপাদিত ও বাজারজাতকরণের উপযুক্ত গ্যাসের ২০% এর বেশী পেট্রোবাংলা তার প্রফিট ন্যাচারাল গ্যাস বা লাভের গ্যাস হিসেবে দাবী করতে পারবে না। তবে এলএনজি রপ্তানী শুরুর ১১ বছরের শুরু থেকে পেট্রোবাংলার অনুরোধে এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০% করা যেতে পারে।
৫) আর্টিক্যাল ১৫.৭ অনুসারে গভীর সমুদ্রের গ্যাসের দাম পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক দরের সমান দরে বিদেশী কোম্পানীর কাছ থেকে ক্রয় করবে । এক্ষেত্রে মানদন্ড হিসেবে এশিয়ান পেট্রোলিয়াম প্রাইস ইনডেক্স(এপিপিআই) এর কোটেশনে ব্যবহ্রত হাই সালফার ফুয়েল অয়েল ১৮০ সিএসটি(এইচএসএফও) এর দামকে মানদন্ড ধরে এবং একে থার্মাল এনার্জি ইকুইভেলেন্ট বা বিটিইউ তে রুপান্তরিত করে গ্যাসের দাম এমএসসিএফ/ডলার হিসেবে হিসাব করতে হবে। আগের পিএসসিতে সমুদ্র-বক্ষের গ্যাসের ক্ষেত্রে এইচএসএফও এর ৯৩% দরে কেনার কথা ছিল। আগে প্রতি টিসিএফ গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্যের সীমা ছিল ১৪০ ডলার আর এই নতুন পিএসসিতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮০ ডলার।
৬) আর্টিক্যাল ১৯.১ অনুসারে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী কোম্পানীটি নিম্নোক্ত যন্ত্রপাতি শুল্কমুক্তভাবে আমদানী করতে পারবে:
ক) স্থায়ী ভাবে আমদানীকৃত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে;
খ) ড্রিলিং, লগিং, সিমেন্টিং, টিউবিং ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য আমদানীকৃত সকল দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে;
গ) কনসিউমেবল বা ব্যাবহারের পর আর সারভিসে লাগে না এরকম যন্ত্রপাতি ও স্পেয়ারের ক্ষেত্রে;
ঘ) খনি-সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যাবহ্রত জিপ এবং পিক-আপ এর ক্ষেত্রে;
৭) চুক্তির কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটে গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ ও জান-মালের ক্ষতি হলে তার জন্য সুনির্নিষ্টভাবে ঠিক কি অনুপাতে ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা দিতে হবে সে বিষয়ে কোন কথা নেই।
এই পয়েন্টগুলো থেকে পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে:
-> কনোকো ফিলিপস কিংবা টাল্লোর মত কোম্পানীগুলো উত্তোলিত গ্যাসের অন্তত ৮০% গ্যাসের মালিকানা ভোগ করবে এবং যার পুরোটাই এলএনজি করে বিদেশে রপ্তানী করতে পারবে।
-> পেট্রোবাংলাকে যদি তার প্রাপ্য ২০% এর বেশী গ্যাস এদের কাছ থেকে ক্রয় করতে হয় তাহলে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে সেই গ্যাস কিনতে হবে। আগের পিএসসিতে এর পরিমাণ ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা কম-৭৫% থেকে ৯৩%।
-> কোম্পানীগুলো বাংলাদেশের প্রয়োজন নয় বরং তাদের মুনাফার হিসেবটি মাথায় রেখে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবিষ্কৃত খনির গ্যাস উত্তোলন করেনি:শেষিত করে ফেলতে পারবে। ফলে পরবর্তীতে প্রয়োজনের সময় আমাদের দেশীয় শিল্পে ব্যাবহারের জন্য গ্যাস পাওয়া যাবে না।
-> কষ্ট রিকভারী গ্যাসের নামে প্রতিবছর উৎপাদিত গ্যাসের একটা বড় অংশ এরা আত্মসাৎ করবে।
-> যন্ত্রপাতি আমদানীর নামে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ভ্যাট, ট্যাক্স, কাষ্টমস ডিউটি থেকে বঞ্চিত হবে।
-> নাইকো কিংবা অক্সিডেন্টালের ঘটনো দুর্ঘটনার পরও শাসক শ্রেণী ক্ষতিপূরণের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছাড়াই গ্যাস উত্তোলনের আয়োজন করে জাতীয় সম্পদ ও পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সরকারী সাফাইয়ের জবাব:
এই ধরণের গণবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ হবে। এবং তা হচ্ছেও- যদিও আওয়ামী লীগের চিরশত্রু বিএনপি-জামাত চক্রের মুখে সংগত কারণেই এ বিষয়ে কোন কথা বার্তা শোনা যাচ্ছে না। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সহ বিভিন্ন বামপন্থী দলের প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কোন বক্তব্য না পাওয়া গেলেও মিডিয়ায় জ্বালানী মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার নামে এই চুক্তির পক্ষে যে বক্তব্য হাজির করা হচ্ছে তা মূলত এরকম:
সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলোর জন্য প্রণীত পিএসসিতে রপ্তানির বিধানকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। পিএসসি অনুযায়ী দেশের যে কোন ক্ষেত্রে প্রাপ্ত গ্যাস প্রথমে কেনার দাবিদার সরকার তথা পেট্রোবাংলা। যদি এমন হয়, এত বড় আকারের একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কৃত হলো, সেখান থেকে বছরে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস তুলতে হবে, অথচ এই পরিমাণ গ্যাসের পুরোটাই হয়তো দেশে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে না, তখন সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর কি হবে? এ অবস্থা থাকলে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে কেন? তাছাড়া এর আগে বিদেশী কোম্পানীর সাথে যে সব পিএসসি হয়েছে তাতেও এরকম বিধান রাখা হয়েছে। আর এবারের পিএসসিতে দেশের স্বার্থ বেশী রক্ষিত হয়েছে বলেই বেশী সুবিধা করতে পারবে না বুঝে অনেক বিদেশী কোম্পানী ডকুমেন্ট কিনেও দরপত্রে অংশ নেয়নি।
আমরা এখানে একে একে বিষয়গুলোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো।
রপ্তানীর বিধান বিষয়ক: রপ্তানীর বিষয়ে প্রতিবাদকারীরা নয় বরং সরকার বা মিডিয়াগুলোই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। যেমন: চুক্তিতে কোথাও লেখা নেই দেশের যে কোন ক্ষেত্রে প্রাপ্ত গ্যাসের প্রথম দাবীদার পেট্রোবাংলা। তারপরও এটা যদি সত্যি বলে ধরেও নেই তখন যে প্রশ্নটি আসে তা হল- বুঝলাম পেট্রোবাংলা প্রথম দাবীদার কিন্তু এই তথাকথিত প্রথম দাবীদার আবিস্কৃত গ্যাসের কত শতাংশ দাবী করতে পারবে? উত্তর মাত্র ২০ শতাংশ। ধরা যাক, ১০ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হলো। চুক্তি অনুসারে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ২ টিসিএফ এর মালিকানা দাবী করতে পারবে। বাকি ৮ টিসিএফ বিদেশী কোম্পানীর। বিদেশী কোম্পানীটি চাইবে বছরে যত বেশী সম্ভব গ্যাস উত্তোলন করে তাকে মুনাফায় পরিণত করতে। এক বছরে সর্বোচ্চ উত্তোলনসীমা অন্যান্য অন-শোর গ্যাসের ক্ষেত্রে ৭.৫% রাখা হলেও সমুদ্রের ব্লকগুলোর ক্ষেত্রে সেরকম কোন সীমা রাখা হয়নি। ফলে কোম্পানীটি চাইলে দ্রুত সমস্ত গ্যাস তুলে ফেলতে পারবে। ধরা যাক, কোম্পানী দেখল প্রতিবছর ২ টিসিএফ করে তুললে তার লাভ বেশী হয়- ফলে সে তাই তুলবে। এখন বাংলাদেশের অবদমিত/অবিকশিত শিল্পখাত কি এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হজম করতে পারবে? পারবে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তখন সে গ্যাস এলএনজিতে রুপান্তরিত করে বিদেশে রপ্তানী করা হবে। পরে যখন বাংলাদেশের শিল্পখাতের বিকাশে প্রচুর গ্যাসের দরকার হবে তখন আর গ্যাস পাওয়া যাবে না কারণ আমাদের গ্যাস ততদিনে তরল গ্যাস হিসেবে বিদেশী কোন শিল্পের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহ্রত হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু যদি চুক্তিটি এমন হতো যে কোম্পানীটি চাইলেই যে কোন পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে না, তাকে বাংলাদেশের বর্তমান চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করতে হবে এবং সেই সাথে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলিত কয়লা ব্যবহারের জন্য যেমন বিদ্যূৎ কেন্দ্র নির্মাণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছিল তেমনি গ্যাসের ক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার সহ বিভিন্ন গ্যাসভিত্তিক কারখানা তৈরীর বাধ্যবাধকতা রাখা হতো তাহলে কিন্তু তড়িঘড়ি করে এই অনবায়নযোগ্য জ্বালানীটিকে বিদেশে রপ্তানী করে নি:শেষ করার প্রয়োজন হতো না। এই শর্তে কোন কোম্পানী বিনিয়োগ করতে আসবে না? না আসুক। পেট্রোবাংলাই এক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ,শেয়ার, বন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করে ঐসব কোম্পানীর বদলে নিজেই বিভিন্ন সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজটি ভালোভাবেই করতে পারবে। বড় বড় কোম্পানীগুলো কিন্ত এইভাবেই পুঁজি সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন সাব-কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে কাজ করায়।
আগের পিএসসির বিধান: আগের পিএসসিতে রপ্তানীর বিধান রাখা হয়েছে বলেই এই পিএসসিতে রপ্তানীর সুযোগ রাখা জায়েজ হয়ে যায় না। মডেল পিএসসি ১৯৯৭ এর আর্টিক্যাল ১৪ তে ৮০ শতাংশ গ্যাস রপ্তানীর সুযোগ রাখাটি তখনও যেমনি গণবিরোধী ছিল এখনকার পিএসসিতে একই বিধান রাখায় এখনকার পিএসসিও তেমনি গণবিরোধী। তাছাড়া সেসময় সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন সরকার সেই ধারা বাতিল করতে বাধ্য হয়। সেই বাতিল করার প্রক্রিয়ায় ২০০১ সালে দুটি জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটি করা হয়। একটা হলো গ্যাস রপ্তানি, আরেকটা হলো সর্বোত্তম ব্যবহার সম্পর্কিত। এই দুটি কমিটির রিপোর্টে বলা হয় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত পিএসসি করা কয় তার দ্বারা বাংলাদেশ যতটুকু লাভবান হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী। কাজেই এখনকার পিএসসি তৈরীর ক্ষেত্রে বরং উচিত ছিল আগের পিএসসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর সংশোধন করে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তার অনুমোদন নেয়া।
দেশের স্বার্থ বেশী রক্ষিত হয়েছে: অনেক কোম্পানী দরপত্রের ডকুমেন্ট কিনেও শেষ পর্যন্ত দরপত্রে অংশ না নেয়ার ঘটনাটিকে নতুন পিএসসিতে দেশের স্বার্থ বেশী রক্ষিত হয়েছে বলে প্রমাণ হিসেবে হাজির করার চেষ্টাটি চরম হাস্যকর। বাস্তবে আগের পিএসসিতে গণবিরোধী যত উপাদান ছিল তার সবগুলোই এই পিএসসিতে আছে। শুধু তাই না, উপরি হিসেবে আরও কিছু বিষয় আছে যেমন: আগের চেয়ে বেশী দরে বিদেশী কোম্পানীর কাছ থেকে নিজের দেশের গ্যাস কেনার ব্যবস্থা, সর্বোচ্চ ক্রয়মূল্যের সীমা ১৪০ ডলার থেকে ১৮০ ডলারে উন্নীত করা ইত্যাদি। তাহলে বিদেশী অনেক কোম্পানী কেন শেষ পর্যন্ত দরপত্রে অংশ নেয়নি? এর উত্তর হলো ভারত ও মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা সংক্রান্ত বিরোধ। ভারত ও মায়ানমার বাংলাদেশের ঘোষিত ব্লকগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপত্তি জানানোর ফলেই এদের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক দেশের কোম্পানী এই দরপত্রে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে।
গ্যাসের জন্য হাহাকার বনাম গ্যাস রপ্তানীর যুক্তি:
সারাদেশে এখন গ্যাসের জন্য হাহাকার। গ্যাস নাই। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কলকারখানা বন্ধ। কাজেই বলা হচ্ছে, যেভাবেই হোক জ্বালানী সমস্যার সমাধান কর। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হলেও কয়লা উত্তোলন করো, ৮০ ভাগ রপ্তানীর বিধান রেখে হলেও সাগর ইজারা দিয়ে দাও। কি অদ্ভুত যুক্তি- একদিকে বিদ্যুৎ সংকটের দোহাই দিয়ে গ্যাস উত্তোলনের কথা বলা হচ্ছে আবার সেই গ্যাস উত্তোলন করে তার প্রায় পুরোটাই তরলীকরণ করে বিদেশে রপ্তানীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে! এর আগে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল গ্যাস রপ্তানীর জন্য। সে সময়কালে দুটি আন্তর্জাতিক কোম্পানী বাংলাদেশে মোট তিনটি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র (সাংগু, বিবিয়ানা, মৌলভি বাজার) আবিস্কার করার ফলে মোট উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ৩.৬৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) বৃদ্ধি পায়। আবিস্কৃত এই গ্যাসটুকু ন্যূনতম সময়ের মধ্যে রপ্তানি করে দ্রুত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ওই আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এবং তাদের এদেশীয় দালালেরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। তখন যদি শাসক শ্রেণী ২০ বছরের চুক্তিতে ৩ টিসিএফ গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারতো তাহলে বর্তমানে দেশে কি ভয়ংকর অবস্থা হতো তা অনুমান করাও কষ্টকর। এবার সেই একই চক্র সমুদ্র বক্ষের গ্যাস রপ্তানির চুক্তি প্রায় গুছিয়ে এনেছে। অথচ বর্তমান সংকটকে আমলে নিয়ে আমাদের এখন ভবিষ্যতের হিসেবটাও করে রাখা দরকার। আনু মুহাম্মদ আগামী ৫০ বছরের একটা হিসেব দিয়েছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যদি ৩% হয়, তাহলে আমাদের প্রায় ৪০ টিসিএফ গ্যাস লাগবে, যদি ৬% ধরা হয় তাহলে আরও ১০০ টিসিএফ লাগবে এবং যদি ৭% প্রবৃদ্ধি হয় তাহলে লাগবে ১৫০ টিসিএফ গ্যাস লাগবে। এখন আমাদের আছে ১০ টিসিএফ এরও কম। কয়লা যদি ধরা হয় তাহলে জামালগঞ্জ সহ আছে ৪০ টিসিএফ এর সমপরিমাণ। এখন সমুদ্র থেকে কি আমরা ১০০ টিসিএফ পরিমাণ গ্যাস পাব? মায়ানমার তাদের তিনটি ব্লক থেকে ৭ টিসিএফ পাওয়ার ঘোষনা দিয়েছে। আমাদের ব্লকগুলো থেকে আমরা কতটুকু পাব সে বিষয়ে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তাহলে এরকম একটা পরিস্থিতিতে কোন যুক্তিতে শাসক শ্রেণী গ্যাস রপ্তানি করতে চাচ্ছে?
লুটেরা উন্নয়ন দর্শন:
এই যে সাগর লুটের আয়োজন সম্পন্ন করে এনেছে শাসক শ্রেণী, সাগরের গ্যাস ইজারার নামে আসলে দেশের ভবিষ্যৎ, জাতীয় সম্পদ ও জ্বালানী নিরাপত্তাকেই ইজারা দিতে চাচ্ছে তার পেছনে ম.তামিম বা তৌফিক এলাহি চৌধুরীদের কারসাজি থাকলেও মূল কিন্তু আরো গোড়ায়, বুর্জোয়া শাসকদের উন্নয়ন দর্শনেই তা নিহিত। যে উন্নয়ন দর্শনে বাজার উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ, প্রবৃদ্ধি, বিদেশী বিনিয়োগ ইত্যাদির দোহাই পেড়ে জনগণের স্বার্থকে জবাই করে গুটিকয়েকের জন্য সোনার ডিম সংগ্রহ করা হয়, সে উন্নয়ন দর্শনের যুক্তিতে গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আরে বাবা, গ্যাস যদি রপ্তানির সুযোগ না দাও তাহলে কি বিদেশী বিনিয়োগ আসবে? আর বিদেশী বিনিয়োগ যদি না আসে, যদি বহুজাতিক দক্ষতা নিয়োজিত না হয়, তাহলে কি আমরা কোনদিনও আমাদের গ্যাস উত্তোলন করতে পারবো, এখন তো তাও ২০% পাচ্ছি, তখন তো সাগরের নীচে পচবে সে গ্যাস! --- এই উন্নয়ন দর্শনটাই ভ্রান্ত, এই উন্নয়ন দর্শন লুটপাটের বাস্তবতা তৈরী করে, এটাকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার। বলা দরকার, পুঁজির অভাবের কথা বলে শাসক শ্রেণী বহুজাতিককে ডেকে আনছে কিন্তু বাস্তবে তো জনগণের টাকা থেকেই সেই বহুজাতিকের বাড়তি পুঁজির যোগান দিচ্ছে। বছরে মাত্র ২০০/৩০০ কোটি টাকার অভাবে যেখানে বাপেক্স অত্যন্ত্ দক্ষ ও সক্ষম একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারছে না সেখানে ডেকে আনা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা- বিদেশী কোম্পানীর কাছ থেকে গ্যাস কেনা হয় ২৫০ টাকা করে আর বাপেক্স থেকে সেটা কেনা হয় মাত্র ১০ টাকা করে! আর দক্ষতার কথা? বহুজাতিক কোম্পানীগুলো নিজেদের অভিজ্ঞ ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির মালিক বলে দাবি করলেও বাস্তবে তারাও যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ানদের ভাড়া করে এনে কাজ করায়। সেই কাজটুকুও যে তারা ঠিক ঠাক করতে পারে না তার নজির বহুজাতিক অক্সিডেন্টাল আর নাইকো মিলে মাগুরছড়া আর টেংরাটিলার প্রায় ৫০০ টিসিএফ গ্যাস (আন্তর্জাতিক বাজারে যার দর এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো)নষ্ট করার মাধ্যমেই দিয়েছে। কই বাপেক্স তো এরকম কিছু ঘটায় নি!
এই রকম একটা বাস্তবতায় বর্তমান সময়ে আমাদের নিম্নোক্ত দাবীগুলো অযৌক্তিক বা অসম্ভব নয় বলেই আমরা মনে করি-
১) কনোকো ফিলিপস এবং টাল্লোকে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
২) গ্যাস/কয়লা ইত্যাদি রপ্তানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৩) মডেল পিএসসি ২০০৮ বাতিল সহ ইতোপূর্বে সম্পাদিত সকল গণবিরোধী পিএসসি চু্ক্তি বাতিল করতে হবে।
৪) বাপেক্স সহ সকল দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেন স্থল ভাগের মতো গভীর সমুদ্রেও দেশীয় কোম্পানীগুলো নিজেরাই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্য চালাতে পারে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে একটি বা দুটি ব্লক থেকে কাজ চালানোর মতো গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের কর্তৃত্ত্বাধীনে দেশী-বিদেশী কন্ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করা যেতে পারে।
আসুন তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে বিবিয়ানা কিংবা ফুলবাড়ির মতো এবারও জাতীয় সম্পদ লুটপাট প্রতিহত করি, শ্লোগান তুলি : তেল-গ্যাস-বন্দর/ইজারা দেয়া চলবে না, আমার দেশের তেল-গ্যাস/আমার দেশেই রাখব।