somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম আলোর ইতিহাস দখল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নির্মাণ প্রকল্প

১৮ ই আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অজানা অধ্যায় উন্মোচন?

প্রথম আলো ইতিহাসের এক "অজানা অধ্যায় উন্মোচন" করেছে! মিজানুর রহমান খানের ৪ কিস্তির একটি রিপোর্টের মাধ্যমে প্রথম আলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই কুটনীতিকের জবানিকে স্বাক্ষী রেখে রীতিমত ঘোষণা করেছে যে "যুক্তরাষ্ট্র সরকার পচাত্তরের আগষ্টের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডকে অনুমোদন দেয় নি।" হ্যা, দুজন মার্কিন কুটনীতিকের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া এই সিদ্ধান্তটি প্রথম আলোরই- কেননা উদ্ধৃতি চিহ্ণ ছাড়াই প্রথম আলো এই শিরোনামটি ব্যবহার করেছে এবং মার্কিন কূটনীতিক দ্বয়ের দাবীগুলোকে "তথ্য" হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যদিও প্রতিবেদনটির ভেতরে স্বাক্ষাতকার দুটির আংশিক রর্ণনা দেয়া হয়েছে, তথাপি "বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৩৫ বছর পর এই প্রথম পঁচাত্তরের ঘটনাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মার্কিন কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে কিছুটা বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানা সম্ভব হলো। প্রথম আলো কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থানসহ ইতিহাসের নানা অজানা অধ্যায় উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে'-- এ কথা বলার মাধ্যমে প্রথম আলো এই ব্যাখ্যাগুলোর ওপর নিজের দাবির-ই জানান দিচ্ছে। গত ১৫-১৮ আগষ্ট ২০১০ এ, প্রথম আলোর প্রথম পাতায় মুজিব হত্যাকান্ড বিষয়ে চার কিস্তির প্রতিবেদনটির ভিত্তি হলো চার্লস ষ্টুয়ার্ট কেনেডি কে দেয়া দুই মার্কিন কুটনীতিক ডেভিস ইউজিন বোষ্টার ও ষ্টিফেন আইজেনব্রাউন এর দুইটি তথাকথিত "অপ্রকাশিত" স্বাক্ষাতকার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা কিছু তারবার্তা। ডেভিস ইউজিন বোষ্টারের স্বাক্ষাতকারটি নেয়া হয় ১৯৮৯ সালে এবং ষ্টিফেন আইজেনব্রাউনেরটি ২০০৪-২০০৫ সালে। যদিও প্রতিবেদনটিতে প্রথম আলো স্বাক্ষাতকার দুটিকে "অপ্রকাশিত বিশেষ স্বাক্ষাতকার" হিসেবে দাবী করা হয়েছে, ইন্টারনেট ঘেটে দেখা গেছে ডেভিস ইউজিন বোষ্টার ও ষ্টিফেন আইজেনব্রাউন উভয়ের স্বাক্ষাতকারই "লাইব্রেরি অব কংগ্রেস- আমেরিকান মেমরী"র ওয়েবসাইট থেকে দিব্যি পড়া যাচ্ছে। সেখানে স্বাক্ষাতকার দু'টির প্রকাশকাল হিসেবে যথাক্রমে ১৯৮৯ এবং ২০০৪ এর কথা উল্ল্যেখ করা হয়েছে যাদের কপিরাইট হয়েছে যথাক্রমে ১৯৯৮ এবং ২০০৬ সনে!(সূত্র:১)

প্রকাশিত স্বাক্ষাতকার কে 'অপ্রকাশিত' বলার মাজেজা:

দেখা যাচ্ছে, ইউজিন বোষ্টার তার এই ১৯৮৯ সালের স্বাক্ষাতকারে মুজিব হত্যাকান্ড সম্পর্কে বলেছেন:"ওটা ছিল একটা নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঐ হত্যাকান্ডকে অনুমোদ দেয় নি।" একই ভাবে ২০০৪-০৫ সালের স্বাক্ষাতকারে ষ্টিফেন আইজেনব্রাউনও বলেছেন:"আমরা অবশ্যই মুজিব হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত ছিলাম না"। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউজিন বোষ্টার ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত গুয়েতেমালার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দ্বায়িত্ব পালনের পর আমেরিকার ফরেন সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসর নেন কিন্ত ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ইন্টিলিজেন্স অফিসের কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন।(সূত্র:২) অর্থাত ইউজিন বোস্টার ১৯৮৯ সালে যখন এই স্বাক্ষাতকার দেন তখনও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত। একই ভাবে ষ্টিফেন ব্রাউন ও ২০০৪/০৫ সালে যখন স্বাক্ষাতকার প্রদান করেন তখন তিনি চুক্তির ভিত্তিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাথ কাজ করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় দুজন সাবেক কূটনীতিক আরেকটি দেশের রাষ্ট্রপতি হত্যাকান্ডে তাদের দেশ যুক্ত ছিল এরকম প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি দেবে এটা বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে চালানো মুশকিল। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মার্কিন কূটনীতি অধ্যয়নকারী সমিতির কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় নেয়া এই স্বাক্ষাতকারে মার্কিন সরকারে কর্মরত দুই সাবেক কূটনীতিকের মুজিব হত্যাকান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত না থাকার এই দাবীটি খেলো হয়ে যায় যদি এই স্বাক্ষাতকারটিকে "অপ্রাকাশিত" বলে চালানো না যায়। একারণেই প্রকাশিত ও উন্মুক্ত একটি স্বাক্ষাতকার প্রথম আলো কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নির্মাণ প্রকল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার খাতিরে পরিণত হলো "অপ্রকাশিত" স্বাক্ষাতকারে!

লক্ষণীয় বিষয় হলো, কর্মরত অবস্থায় মার্কিন কূটনীতিকদের ভাষ্যকে প্রামাণ্য ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত টানা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠবে এটা প্রথম আলো ভালো ভালো করেই জানে। ফলে প্রথম পর্বে দুই কুটনীতিকের রেফারেন্স ব্যাবহার করে "যুক্তরাষ্ট্র সরকার পচাত্তরের আগষ্টের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডকে অনুমোদন দেয় নি" জাতীয় সিদ্ধান্ত টানলেও প্রতিবেদনটির তৃতীয় পর্বে এসে বলা হয়: "কর্মরত থাকাকালে বিধিবদ্ধ কূটনৈতিক কায়দা-কানুনের ঘেরাটোপে থাকতে হয় রাষ্ট্রদূতদের। এর বাইরে এসে পেশাদার কূটনীতিকেরা যাতে স্বাধীনভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, তার সুযোগ তৈরি করা কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। বোস্টার সে ধরনের কোনো মতামতের প্রতিফলন তাঁর এই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে রাখেননি; বরং সতর্কতার সঙ্গে তিনি মুজিব হত্যার বিষয়ে কিসিঞ্জার প্রশাসনের তৈরি করা সরকারি ভাষ্য অটুট রাখতে সংকল্পবদ্ধ থাকেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।"

প্রশ্ন হলো, বোষ্টার যদি সরকারি ভাষ্য অটুট রাখতে সংকল্পবদ্ধ থাকেন তাহলে আইজেনব্রাউন ও কি তাই ছিলেন না? তাহলে ৩৫ বছর পর মুজিব হত্যাকান্ড নিয়ে এই দুই কূটনীতিকের জবানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্য নতুন করে ফলাও করার উদ্দেশ্য কি?

ইউজিন বোস্টার প্রকাশ্য স্বাক্ষাতকারে শেখ মুজিব হত্যাকান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও জীবিত অবস্থায় প্রকাশ না করার শর্তে ফার ইষ্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ এর সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফশুলজকে দেয়া গোপন স্বাক্ষাতকারে বাংলাদেশের ততকালীন সিআইএ ষ্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি'র সাথে মোশতাক গং এর যোগাযোগ থাকার কথা স্বীকার করেন। বোষ্টার দাবি করেন, খন্দকার মোশতাক গং কর্তৃক সম্ভাব্য ক্যূ এর আলামাত পেয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যাক্তিগত ভাবে মার্কিন দূতাবাসের প্রত্যেকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যেন মোশতাক গ্রুপের সাথে দূতাবাসের কেউ কোন যোগাযোগ না রাখে কিন্তু ১৫ই আগষ্টে বিষ্ময়ের সাথে বোষ্টার লক্ষ করেন খুনীদের মধ্যে মোশতাক গ্রুপের সেই ব্যাক্তিটিও রয়েছে যার সাথে যোগযোগের ব্যাপারে তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তার নিষেধ স্বত্ত্বেও সিআইএ'র ফিলিপ চেরী এবং তার ষ্টাফরা খুনীদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল কি-না, লিফশুলজের এই প্রশ্নের জবাবে বোষ্টার বলেন: ""Let me answer this question theoretically, outside the context of Bangladesh. No, this kind of thing is not done by the Station Chief, But, as one American to another, it has been done." অর্থাত "তত্ত্বগত ভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতটিকে বাইরে রেখে বলবো, না না স্টেশন চিফ এ ধরণের কাজ করেনি। কিন্তু একজন আমেরিকান হিসেবে আরেকজন আমেরিকানের কাছে বলতে গেলে বলব, হ্যা, সে এই কাজ করেছে।"(সূত্র:৩)

প্রথম আলো ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুজিব হত্যাকান্ড বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফশুলজের কাছে দেয়া ততকালিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোষ্টারের স্বীকারোক্তিটি সম্পর্কে জানে না এমন নয়, ২০০৫ সালের অগাষ্ট মাসে প্রথম আলোতেও লিফশুলজ এর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এখন পত্রিকাটি মার্কিন সাম্র্যাজ্যবাদের স্বার্থে মার্কিন সরকারে কর্মরত অবস্থায় মুজিব হত্যাকান্ড বিষয়ে দুই কূটনীতিকের অস্বীকার বাণীর সাহায্যে লরেঞ্জ লিফশুলজ এর গবেষণাকে খারিজ করে দিতে চায়, পত্রিকাটির ভাষ্যমতে যার নাম "নতুন করে আলো ফেলা"!

দুই ট্র্যাকের খেলা:

শুধু দুই কূটনীতিকের "অপ্রকাশিত" স্বাক্ষাতকার থেকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো গোপন তারবার্তা থেকেও প্রথম আলো যুক্তরাষ্টের অনিহা আবিস্কার করেছে। প্রথম আলোর ১৬ আগষ্ট ২০১০ এর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়:"চুয়াত্তরে ফারুকের অভ্যুত্থান ঘটানোর আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরকে ২১৫৮ নম্বর গোপন তারবার্তার মাধ্যমে ১৫ মে, ১৯৭৪ অবহিত করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এই বার্তা থেকে অবশ্য দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফারুক রহমানের সরকার উৎখাতের প্রস্তাব তাৎক্ষণিক নাকচ করেছিল।"

বার্তার একমাত্র যে বাক্যটি থেকে প্রথম আলো এই মহান সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে তা হলো: "গ্রেসাম মেজর রহমানকে বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে।"

এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন দূতাবাসের কর্মকতা জন গ্রেসাম কর্তৃক "বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না"- কথা থেকে প্রথম আলো কি করে নিশ্চিত হলো জন গ্রিসামের এই "নাকচ" খোদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের "নাকচ"? দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জন গ্রিসামের এই "নাকচ"টিকে যুক্তিরাষ্ট্রের সত্যিকার মনোভাব হিসেবে ধরে নেয়ার কোন যুক্তিই থাকেনা যেখানে খোদ রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার মোস্তাক গং এর সাথে যোগাযোগের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেও নিশ্চিত ছিলেন না যে সিআইএ চিফ ফিলিপ চেরি তার নির্দেশ মানছেন কি মানছেন না! অর্থাত লরেঞ্জ লিফশুলজের কাছে ইউজিন বোস্টারের দেয়া স্বাক্ষাতকারটির মাধ্যমে মার্কিন সরকারের "দুই ট্র্যাক" বা দ্বৈত কৌশলের যে সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার পর দূতাবাসের এক কর্মকতা কি বলল না বলল সেটাকে মার্কিন সরকারের মতামত হিসেবে চালিয়ে দেয়া ধূর্ততা এবং চালিয়াতি ছাড়া আর কিছু না।

দুই ট্র্যাক কৌশলটি সম্পর্কে ক্রিস্টোফার হিচেনস তার "দ্য ট্রায়ালস অব হেনরি কিসিজ্ঞার" বইয়ে চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে হত্যাকান্ডের সাথে মুজিব হত্যাকান্ডের তুলনা তুলে বলেছেন: "দুই ট্র্যাক কৌশলটি তখনও সবার কাছে পরিচিতি পায়নি। এটি এমন একটি কৌশল যার পাল্লায় পড়ে চিলির আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এড ক'রি একসময় আবিষ্কার করেন, তার গোয়েন্দা অফিসার আর সামরিক কর্মকর্তারা তার পেছন দিয়ে আর মাথার উপর দিয়ে নিজেদের খেলা চালাচ্ছে যেসবে রয়েছে ওয়াশিংটনের গোপন অনুমোদন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেঞ্জ লিফশুলজ এর বিশদ গবেষণায় পরিস্কার যে চিলির মতো বাংলাদেশেও "দুই ট্র্যাক" স্কিম প্রয়োগ করা হয়েছিলো।"(সূত্র:৪)

যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিকতা ও মহানুভবতার "তথ্য"!

বাংলাদেশে নিযুক্ত ততকালীন সিআইএ স্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী লরেঞ্জ লিফশুলজকে দেযা স্বাক্ষাতকারে মুশতাক গ্রুপের সাথে সিআইএ'র যোগাযোগকে অস্বীকার করলেও কংগ্রেসম্যান স্টিফেন জে সোলারজ এর ১৯৮০ সালে চালানো তদন্ত থেকে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সিআইএ'র সাথে মোশতাক গ্রুপের সংযোগের বিষয়টিকে অস্বীকার করছে না কিন্তু একই সাথে তারা দাবী করেছে যে তারা নাকি মুজিবকে এই সংযোগ এবং সম্ভাব্য ক্যূ সম্পর্কে সতর্ক করেদিয়েছিলো! এই বিষয়টা নিয়ে ক্রিষ্টোফার হিচেনস তার "দ্য ট্রায়ালস অব হেনরি কিসিঞ্জার" বইয়ে আলোচনা করেছেন। সিআইএর স্টেশন চীফ ফিলিপ চেরীর অস্বীকারের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট এর এই স্বীকারোক্তি এবং মুজিবকে সতর্ক করার দাবী সম্পর্কে ক্রিষ্টোফার হিচেনস এর মন্তব্যটি গুরুত্পূর্ণ:"যদি সত্যিই এই দাবী করা হয়, তাহলে বলবো এই দাবীটি করা হচ্ছে প্রথম বারের মতোন এবং এমন একটা মানুষের নামে যিনি সেই ক্যূ এর মাধমে খুন হয়েছেন এবং এখন এই দাবীটিকে এসে অস্বীকার করে যেতে পারবেনা না। যেভাবেই দেখি, এই স্বীকারোক্তিটি দাবীটির চেয়ে বেশী জোরালো।" (সূত্র:৫)

অর্থাত হিচেনস তার ২০০১ সালে প্রকাশিত পুস্তকে মুজিবকে সতর্ক করা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ভাষ্যটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে রেখেছেন অথচ ২০১০ সালে এসে প্রথম আলো এ বিষয়ে দুই মার্কিন কূটনীতিক এর জবানীতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ভাষ্যকেই পুনরুতপাদন করেছে কোন ধরণের বিচার ছাড়াই! প্রথম আলো লিখেছে: "....সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার মুজিবকে সতর্ক করেছিলেন। সতর্ক করার বিষয়টিকে তারা নৈতিক দায়িত্ব বলেও গণ্য করেছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান বিষয়ে দুই সাবেক মার্কিন কূটনীতিকের দেওয়া দুটি অপ্রকাশিত বিশেষ সাক্ষাৎকার থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।" এখানে খেয়াল করার বিষয়, হিচেনস তার বইয়ে এ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুজিবকে সতর্ক করার বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের "ক্লেইম" বা "দাবী" হিসেবে ব্যবহার করলেও, প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে এগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র বা দু্ই কুটনীতিকের দাবী হিসেবে না বলে একেবারে "তথ্য" হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে!

লক্ষণীয় হলো, প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মহানুভবতা ও মুজিব হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত না থাকার "তথ্য" আবিস্কার করার পর, "মোশতাকের সমর্থনে কিসিঞ্জার-বোস্টার" শিরোনামের চতুর্থ কিস্তিতে এসে আবার জানান দেয় "বোস্টার বাংলাদেশে তাঁর মিশনে কিসিঞ্জারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে গেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।" একদিকে বলা হলো যুক্তরাষ্ট্র মুজিব হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিল না বরং মুজিবকে এ বিষয়ে সতর্ক পর্যন্ত করেছিলো(যদিও তাদের বক্তব্য অনুসারেই দেখা যাচ্ছে তারা হত্যার পরিকল্পনাকারীদের নাম-ধাম জানায়নি মুজিবকে!) অন্যদিকে আবার উপসংহার টানা হলো মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোষ্টার কিসিঞ্জারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছেন! তাহলে প্রশ্ন আসে কি সেই ইচ্ছা কিসিঞ্জারের যা বাস্তবায়নের অপরাধে অপরাধী বোস্টার? মুজিব হত্যা? না, সে সম্ভাবনা তো প্রথমেই বাতিল করা হয়েছে দুজন কূটনীতিকের স্বাক্ষাতকারের বয়ানের মাধ্যমে। তাহলে বাকি থাকে হত্যা পরবর্তী মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানানো। হ্যা, প্রথম আলোর জানাচ্ছে: "বোস্টার স্টুয়ার্ট কেনেডিকে বলেন, যে-ই আসুক না কেন, মুজিব হত্যার পরের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। কিসিঞ্জার মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।" আর কিসিঞ্জারের ইচ্ছা অনুসারেই "খন্দকার মোশতাক ও জিয়া সরকার যাতে টিকে থাকে, সে জন্য বোস্টার তৎপরতা চালিয়েছেন।"

মুজিব হত্যাকান্ডের পর মোশতাক সরকারকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছিলো এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য। এই স্বীকৃতি জানানোর পেছনে ততকালীন রাষ্ট্রদূত বুষ্টার ও হেনরি কিসিঞ্জারের যে ভূমিকা ছিল সেটাও কোন অজানা বিষয় নয়, তাহলে ৩৫ বছর সেই তথ্য নতুন করে আবিস্কার করার কারণ কি? কারণটি হলো, যুক্তিরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নির্মাণ প্রকল্পটির গ্রহনযোগ্যতা তৈরী করা; হত্যাকারী মোশতাককে স্রেফ সমর্থন দেয়ার মতো ছোট-খাট একটা অপরাধের সাথে মার্কিন দূতাবাসকে অভিযুক্ত করার বিনিময়ে যদি মুজিব হত্যা পরিকল্পনার মত বড়সর একটি অপরাধের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্তরাখা যায় তাতে মন্দ কি!

আসল কথা
৬০ এবং ৭০ দশকের ইতিহাস একদিকে দেশে দেশে স্বাধীনতা ও শোষণ মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস আর অন্যদিকে তার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন পুজির স্বার্থে দেশে দেশে অভ্যুত্থান, গণহত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে মার্কিন পুজির বিনিয়োগ, বিনিয়োগকৃত পুজির অবাধ চলাচল কিংবা সোভিয়েত ও চীনের কমিউনিস্ট ব্লকের হাত থেকে বিভিন্ন দেশকে "মুক্ত" রাখার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের "মহান বাসনা" বাস্তবায়নের ইতিহাস। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে এসময় মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের জন্য সিআইএর সহায়তায় বহু সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা যদি শেখ মুজিবর রহমানের জাতীয়করণ প্রকল্প (তা সে যতই লোক দেখানো ও অকার্যকর হোক না কেন এবং লুটপাট ও দুর্নিতীর জন্ম দিক না কেন) ও বেসরকারী পুজি বিনিয়োগের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা'র বিষয়টি মাথায় রাখি, যদি ভারত ও সোভিয়েত ব্লকের সাথে ঘনিষ্ঠতার কথাটি স্মরণে রাখি কিংবা দেশের ভেতরে শেখ মুজিব কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার দল আওয়ামি লীগের লুটপাট, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড কিংবা দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্বিসহ জীবন যাত্রা এবং এক পর্যায়ে ৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বাকশাল গঠন ও জনগণের কন্ঠরোধ ইত্যাদি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাসদ, ভাসানী ন্যাপ কিংবা সর্বহারা পার্টিগুলোর বিপ্লবাত্মক ততপরতা ও তার ফলে বাংলাদেশে বাম রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাব্যতার বিষয়গুলোকে এক সাথে যুক্ত করে দেখি তাহলে দেশের অভ্যন্তরের লুটেরা নব্য ধনিক শ্রেণীর সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মৈথুন অস্ভাবিক মনে হবে না। শেখ হাসিনার সরকার কয়েকজন খুনিকে ধরে ফাসি দিলেও এ ঘটনার আসল মোটিভ এবং তার সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুক্ত থাকা না থাকা বিষয়ে কোন অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে কোন উতসাহই প্রদর্শন করেনি এবং মার্কিন সাম্যাজ্যবাদের সাথে গাট ছাড়া বাধা শাসক শ্রেণীর একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই "নিরাপদ" আচরণ খুব একট অস্বাভাবিকও নয়।

এরকম একটা বাস্তবতাই কিন্তু প্রথম আলোর মতো কর্পোরেট মিডিয়ার হাতে আজকে ইতিহাস দখল করে ইতিহাসের নয়া নয়া ভাষ্য হাজির করা এবং ইতিহাসের দখলকৃত জমিনে মার্কিন ভাবমূর্তি নির্মাণ প্রকল্প চালানোর ক্ষমতা তুলে দেয়!


তথ্যসূত্র:
১) ইউজিন বোষ্টারের স্বাক্ষাতকারের জন্য দেখুন: Click This Link
ষ্টিফেন আইজেনব্রাউনের স্বাক্ষাতকারের জন্য দেখুন: Click This Link

২) ওয়াশিংটন পোষ্ট, জুলাই ১১, ২০০৫ Click This Link)।

৩) ১৫ আগষ্ট, ২০০৫ সাল থেকে ডেইলি ষ্টার পত্রিকায় প্রকাশিত লরেঞ্জ লিফশুলজের চার পর্বের আর্টিক্যাল:
১ম পর্ব: Click This Link
২য় পর্ব: Click This Link
৩য় পর্ব: Click This Link
৪র্থ পর্ব: Click This Link)

৪) ক্রিস্টোফার হিচেনস এর "দ্য ট্রায়ালস অব হেনরি কিসিঞ্জার"(২০০১), অধ্যায় ৪, Click This Link

৫) পূর্বোক্ত

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ৮:৩৯
১৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×