গত ৩ আগষ্ট অধ্যাপক আনু মুহম্মদ প্রথম আলো প্রত্রিকায় “উন্মুক্ত না, বিদেশী না, রপ্তানি না: কেন? ” শীর্ষক প্রবন্ধটিতে বলেছিলেন কোম্পানির হয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা আর বিশেষজ্ঞ থাকেন না, তারা হয়ে উঠেন প্রচারক। এই কথাটির প্রমাণ দিতেই বোধ হয় ভূতাত্ত্বিক জোবায়ের জামান সাহেব আনু মুহম্মদের সেই লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় গত ২০ আগষ্ট প্রথম আলোয় একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছেন যেখানে তিনি দাবী করেছেন, দেশের স্বার্থেই নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রয়োজন। তার এই অবস্থানের পেছনে যুক্তি দেখাতে গিয়ে যেভাবে তার "বিশেষজ্ঞ" জ্ঞানের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে আনু মহম্মদের কথারই সত্যতা ফুটে উঠে। আনু মুহম্মদের তোলা প্রসঙ্গগুলো থেকে বেছে বেছে যে চারটি প্রসঙ্গ নিয়ে জোবায়ের জামান তার “বিশেষজ্ঞ জ্ঞান” জাহির করেছেন সেই চারটি প্রসঙ্গ অর্থাত পানিসম্পদ, আবাদি জমি, প্রাণ বৈচিত্র ও কয়লার দেশীয় চাহিদা/রপ্তানি ইস্যু ধরেই আমরা সেই “বিশেষজ্ঞ জ্ঞান” এর বিচার করতে চাই, দেখতে চাই তিনি কতটা “বিশেষজ্ঞ” আর কতটা কোম্পানির প্রচারক।
পানিসম্পদ বিষয়ে
ভূ-তত্ত্ববিদ মানেই বোঝার কথা কোন অঞ্চলের মানুষ কর্তৃক সেই অঞ্চলেই ব্যাবহারের জন্য পানি উত্তোলন আর উন্মুক্ত খননের পরিবেশ তৈরীর জন্য কোন অঞ্চল থেকে পানি উত্তোলণ এই দুটি বিষয় একেবারেই ভিন্ন। কেননা,প্রথম ক্ষেত্রে উত্তোলিত পানি পানি-চক্রের মাধ্যমে আবারও ভূ-গর্ভেই ফিরে আসে যদিও এ ক্ষেত্রে নানান অপচয়,পানি চক্রের মাধ্যমেই উত্তোলিত পানি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তিরত হওয়া, পানি দূষণ ইত্যাদি কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ধীরে ধীরে নামতে থাকে এবং দূষিত হতে থাকে। জোবায়ের জামানের দেয়া তথ্য অনুসারে ঢাকার ভূ-গর্ভ থেকে প্রতিদিন ২২০ কোটি লিটার পানি উত্তোলণের ফলেও একই ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি করে ভূ-গর্ভের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কিন্তু এইভাবে পানির ব্যাবহার আর তার ফলে পানির স্তর নেমে যাওয়ার সাথে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণের জন্য পাম্প করে ভূগর্ভকে একেবারে পানিশূণ্য করে ফেলার ঘটনাটির কোন তুলনাই হতে পারে না। কেননা এ ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য "মরু করণ" অর্থাত পানি সরিয়ে ফেলা যেন পানি বহনকারী শিলা স্তরের নীচের কয়লাটুকু উত্তোলন করা সম্ভবপর হয়ে উঠে। এ উদ্দেশ্যে কয়লা উত্তোলনকালীন সময়টুকুতে পানি পাম্প করে তুলে কিছু পানি খনির নানান কাজে ব্যবহার করার পর ব্যাবহ্রত ও অব্যবহ্রত পানির পুরোটাই নিকটস্থ নদীর মাধ্যমে দূরে প্রবাহিত করে দেয়া হয়। অথচ জোবায়ের জামান সাহেব কোম্পানির পক্ষে প্রচারণা করতে গিয়ে এই ভূ-তাত্ত্বিক জ্ঞানটুকু শিকেয় তুলে রেখে প্রয়োগ করেছেন "বহুজাতিক জ্ঞান" যেন তার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করা করা যায়। তিনি বলেছেন: "ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২২০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে, যার বেশির ভাগই আসে ভূগর্ভস্থ উত্স থেকে।... ... তাতে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলেও ভূপৃষ্ঠে গাছপালা এবং শস্য উত্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ছে না,মরুকরণও হচ্ছে না।"
চলুন দেখি "অ-বহুজাতিক" বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এ বিষয়ে কি বলে। পেট্রোবাংলার অধিনস্ত পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলি এ.কে.এম শামসুদ্দিন ২৯-০৯-২০০৭ এর ডেইলি স্টার পত্রিকায় ফুলবাড়ি এলাকায় উন্মুক্ত খনন বিষয়ে এক প্রবন্ধে পরিস্কার বলেছেন:"Extraction of Phulbari coal adopting open-pit mining method can be disastrous for the north-western region in particular and Bangladesh in general due to dewatering of arsenic contamination free source of drinking and irrigation groundwater from DupiTila formation from a depth of 250 to 300 meters to the tune of 800 million liters per day over a period of 38-years. Dewatering in the Phulbari mining area may not only disturb but also damage the aquifer, making the area a desert like place."
অর্থাত “ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণ করা হলে বিশেষ করে পুরো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং সাধারণ ভাবে গোটা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে টানা ৩৮ বছর ধরে প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন লিটার করে আর্সেনিক মুক্ত পানি মাটির ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার গভীরের ডুপি টিলা শিলা-স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে, ফলে খাওয়ার পানি ও সেচের পানি হারিয়ে পুরো এলাকায় মরুকরণ ঘটবে। এর ফলে শুধু ফূলবাড়ি এলাকা নয়, মাটির নীচের পানির স্তর বা একুইফার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে গোটা এলাকাই এভাবে মুরুকরণের শিকার হবে।“
আবাদি জমি প্রসঙ্গে
উন্মুক্ত খননের ফলে কৃষি জমি বিনষ্ট হওয়ার কথা লিখেছিলেন আনু মুহাম্মদ। জোবায়ের জামান তার বিরোধীতা করে উল্টো বলেছেন:"বিশ্বে শত শত উন্মুক্ত খনি কীভাবে পরিচালত হচ্ছে?উন্মুক্ত খনিতে তুলনামূলকভাবে অধিক জমির প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেটি পর্যায়ক্রমিক ও সাময়িক। কয়লা বা অন্য খনিজ উত্তোলনের পর পর্যায়ক্রমিক পুনর্ভরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে জমি আগের উত্পাদনশীলতায় ফিরিয়ে আনা যায়।" আবারও পরিবেশ-পরিস্থিতি-জনসংখ্যা ইত্যাদির কোন বিবেচনা না করে স্রেফ বিশ্বের অন্য দেশের শত শত উন্মুক্ত খনির উদাহরণ টেনে বাঙলাদেশের মতো ঘনবসতি পূর্ণ দেশে উন্মুক্ত খনি জায়েজ করার চেষ্টা! বিশ্বের অন্যান্য দেশের শত শত উন্মুক্ত খনিতে আসলে কি ঘটছে সেটা নিয়ে আলোচনা করার প্রকৃত জায়গা এটা নয়,সেটা আমরা অন্যত্র করেছি। এখানে এইটুকু বলাই যথেষ্ট, প্রতি বর্গ কিমি এ ২০০-২৫০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট জার্মানি-অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের পরিস্থিতির সাথে বাঙলাদেশের মতো প্রতি বর্গ কিমি এ ১০০০ এর বেশি জনসংখ্যা ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি দেশের পরিস্থিতির তুলনা করার বদমাইশি কেবল বিক্রিত বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব!
উন্মুক্ত খনিতে তূলনামূলক ভাবে বেশী জমি লাগার বিষয়টা স্বীকার করার পর আবার জোবায়ের জামান সাহেব বলছেন এটা পর্যায়ক্রমিক ও সাময়িক। সাময়িক কি সাময়িক না, সে বিষয়ে না গিয়েও প্রশ্ন উঠে পর্যায় ক্রমিক ভাবেও যদি একেকবার ৫ বছরের জন্য একেকটা এলাকার লোকজনকে খনি অঞ্চল থেকে সরাতে হয়, তা হলে কোথায় সরানো হবে? নিজেদের ক্ষেত-খামার কৃষি জমি, ব্যবসা বাণিজ্য ফেলে কোথায় গিয়ে ৫ বছরের জন্য থিতু হতে পারবে হাজার হাজার মানুষ? সাময়িক স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় জমিও কি বাংলাদেশে অবশিষ্ট আছে?
এবার আসা যাক জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেয়ার প্রসঙ্গে। হাজার হাজার বছর ধরে যে জমির উর্বরতা তৈরী হয়, একবার সে জমি খনন করে ফেলার পর পর্যায়ক্রমিক পুনর্ভরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে কি সে উর্বরতা ও উতপাদনশীলতা ফিরে পাওয়া সম্ভব? জোবায়ের জামান সাহেব উদাহরণ দিলে দেখা যেত কোথায় কোন জমির উর্বরতা আগের মতো করে ফেলে হয়েছে কিংবা উতপাদনশীলতা আগের চেয়ে বেড়েছে! জার্মানি কিংবা অষ্ট্রেলিয়ার শত শত খনি এলাকায় যে তা হয় নি সে বিষয়টা আমরা জানি। Jeffrey H. Michel লিখিত গবেষণা প্রত্র “Status and Impacts of German Lignite Industry” থেকে দেখা যায় জার্মানির উন্মুক্ত খনন এলাকাগুলোতে আবর্জনা ও কয়লাখনির অবশেষ ফেলে খনি এলাকা পুনরায় ভরাট করে সেখানে চাষাবাদ বা বসতি নির্মাণের চেষ্টা সফল হয়নি, যে কারণে ইদানিং অনেক পরিত্যাক্ত উন্মুক্ত খনি এলাকায় সৌরবিদ্যুত উতপাদনের কাজ শুরু হয়েছে!
প্রকৌশলি এ.কে.এম শামসুদ্দিন এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ি প্রকল্পের সামালোচনা করে এ বিষয়ে বলেছেন:"According to Asia Energy, the top-soil will be removed and preserved once mining operation begins in a particular block. This top-soil will be brought back and spread on the top of the area after completion of mining at the particular block which may take 3-5 years. It will be very difficult to preserve top-soil for such a long time. Top-soil may be washed away during monsoon. At least 3-5 monsoons will be there before top-soil is used at the top of the filled out mining block. And the fertility of the top-soil will also be lost during these 3-5 rainy seasons."
অর্থাত “এশিয়ার এনার্জির মতে, কোন নির্দিষ্ট ব্লকে উন্মুক্ত কয়লা খনন শুরু হলে সে এলাকার মাটির উপরের স্তরটিকে() অন্যত্র সরিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হবে। ৩-৫ বছর পর ঐ ব্লকের কয়লা উত্তোলণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সেই মাটিকে আবারও সেই এলাকায় মিশিয়ে দেয়া হবে। বস্তুত, এত বেশি সময় ধরে মাটির উপরের স্তর সঞ্চয় করে রাখা খুব কঠিন। বর্ষায় সে মাটি ধুয়ে যেতে পারে। জমিতে পুনরায় ব্যাবহার আগ পর্যন্ত সংরক্ষিত মাটিকে অন্তত ৩-৫টি বর্ষাকাল অতিক্রম করতে হবে। আর সেই ৩-৫টি বর্ষাকালে সংরক্ষিত মাটির সমস্ত উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাবে।“
জোবায়ের জামান মনে করেন:"নির্বিচারে কৃষিজমি এবং জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প (পূর্বাচলে জমির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার হেক্টর) বা অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য যেখানে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়লা সম্পদ আহরণে কয়েক হাজার হেক্টর জমি ব্যবহারের পর উত্পাদনশীল ব্যবহারে ফিরিয়ে নেওয়া গেলে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।" অর্থাত হাউজিং সেক্টর যখন লুটপাট চালাচ্ছে, কৃষি জমি ধ্বংস করছে, তখন জ্বালানী সেক্টরের বহুজাতিক কোম্পানিকে কেন বঞ্চণা করা হচ্ছে! চলুন দেখি এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনা অনুসারেই ফুলবাড়ির উন্মুক্ত খনন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কি ঘটতো। এই প্রজেক্টের জন্য ৫৯৩৩ হেক্টর(৬০ বর্গ কিমি) জমি প্রয়োজন হবে যার ৮০% ই হলো কৃষি জমি। সরাসরি খনন করা হবে ৫১৯২ হেক্টর জমি। বাকি জমিতে খনির জন্য নানান স্থাপনা তৈরী করা হবে। এর ফলে ১৫৭৭ টি পুকুর, ৮০,০০০ গাছ, ৯৮২ টি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, ৩৬,০৫২ টি ঘরবাড়ি, ১০৬ টি স্কুল, ৪৮ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১৩৮ টি মসজিদ,মন্দির, চার্চ, ৬৯২ টি কবরস্থান এবং ২ টি পুরকীর্তিস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হতো! (সূত্র: এশিয়া এনার্জির পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব যাচাই রিপোর্ট, ESIA vol3, chapter 3, page 132)। এশিয়া এনার্জির এই হিসাবে বাস্তবের চেয়ে অনেক কম করে দেখানো হয়েছে- এই অভিযোগ আমলে না নিলেও, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পরিমাণ ধ্বংস যজ্ঞ বিষয়ে জোবায়ের জামানের বলা "কারো আপত্তি থাকার কথা নয়" কথাটি আমাদেরকে ভীষণ বিষ্মিত করে, "কারো" বলতে আসলে তিনি কাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন!
প্রাণবৈচিত্র্য
প্রাণবৈচিত্র বিষয়েও জোবায়ের জামান সাহেবের বক্তব্য জমি কিংবা পানি নিয়ে দেয়া বক্তব্যের মতই, একজন কোম্পানির বিশেষজ্ঞের মতই তিনি উন্মুক্ত খননের দ্বারা পরিবেশ দূষণের সাথে টেক্সটাইলস, চামড়া কিংবা অন্যান্য শিল্প দূষণের সাথে তুলনা করে তিনি তার বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন! টেক্সটাইল কিংবা চামড়া শিল্প নি:সন্দেহে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ করছে এবং আমরা মনে করি প্রতিবেশের উপর এর প্রভাব ভয়াবহ। আবার শিল্প মালিকরা পরিবেশ দূষণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে এখন বহুজাতিকেও সেই সুযোগ করে দিতে হবে!
আনু মুহাম্মদের তোলা এসিড মাইন দূষণ (এসিড মাইন ড্রেনেজ বা এএমডি) প্রসঙ্গে জোবায়ের জামান বলেছেন: “খনি উন্নয়নের কারণে কী পরিমাণে ‘এএমডি’ সৃষ্টি হবে বা আদৌ হবে কিনা তা কয়লা বা অন্য খনিজ এবং উপরিস্থিত ভূগর্ভস্থ শিলার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিস্তারিত সমীক্ষা ব্যতীত তা নিশ্চিত করে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।“ তো সেই বিস্তারিত সমীক্ষা না থাকা কিন্তু তাকে আশান্বিত হতে বিরত রাখতে পারেনি: “এটা অত্যন্ত আশার কথা, বাংলাদেশের কয়লা উন্নত মানের, এতে পরিবেশদূষণকারী সালফারের পরিমাণ অনেক কম। বড়পুকুরিয়ার বিপুল পরিমাণ স্তূপীকৃত কয়লা থেকে অথবা খনি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তোলিত ভূগর্ভস্থ শিলা থেকে ‘এএমডি’ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।”
প্রথমত, এসিড মাইন ড্রেনেজ এর একমাত্র কিংবা মূল উতস কিন্তু উত্তোলিত কয়লা না যে কয়লায় সালফার কম থাকলেই এসিড মাইন ড্রেনেজ ঘটবে না। এএমডি’র মূল উতস হলো বিভিন্ন সালফার যৌগ যার মধ্যে আয়রণ পাইরাটস(FeS2)ই প্রধান। কয়লায় সালফার থাকল কি থাকলো না তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কয়লা উত্তোলন করতে গিয়ে কয়লা স্তরের উপরের যে বিপুল পরিমাণ মাটি/শিলা উত্তোলিত করতে হবে, তার মাঝে সালফার যৌগের পরিমাণ কতটুকু। ফুলবাড়ি অঞ্চলে এশিয়া এনার্জির হয়ে ২০০৫ সালে যে জিএইচডি কোম্পানি মাটির গুণাগুন পরখ করেছে, তারা বলেছে: "ওভার বার্ডেন মেটেরিয়ালের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশেই এসিড মাইন ড্রেনেজের উচ্চ ঝুকি পাওয়া গেছে.... সালফারের উচু মাত্রা বেশ বড় একটা সমস্যা, এখানে সাধারণত এর পরিমাণ ২% থেকে ৮% তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ২০% এর বেশি পাওয়া গেছে।" (সূত্র: Phulbari coal: a Parlous Project by Roger Moody) কাজেই জোবায়ের জামান সাহেব বড়পুকুরিয়া থেকে উত্তোলিত শিলা থেকে এসিড মাইন ড্রেনেজ না হওয়ার ব্যাপারে যেরকম নিশ্চিত আমরা কিন্তু সেরকম নিশ্চিত হতে পারছি না কারণ একদিকে বড়পুকুরিয়া অঞ্চলের পানি দূষিত হওয়ার অভিযোগ আছে এবং সেখানে এসিড মাইন ড্রেনেজ নিয়ে কোন সমীক্ষা চালানোও হয় নি অন্যদিকে বড় পুকুরিয়ার মত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড মাইন থেকে যে পরিমাণ মাটি/শিলা উত্তোলিত হয়, উন্মুক্ত খনন প্রকৃয়ায় উত্তোলিত হয় তার চেয়ে কয়েক লক্ষকোটি গুণ বেশি! বিস্তারিত সমীক্ষা না করে জোবায়ের জামান সাহেবের পক্ষে উন্মুক্ত খননে এসিড মাইন ড্রেনেজ এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কোন কথা বলা “সম্ভব না” কিন্তু বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়াই তিনি নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারেন: “বড়পুকুরিয়ার বিপুল পরিমাণ স্তূপীকৃত কয়লা থেকে অথবা খনি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তোলিত ভূগর্ভস্থ শিলা থেকে ‘এএমডি’ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি”!
দ্বিতীয়ত, এসিড মাইন ড্রেনেজ ব্যাবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আমাদের আশ্বাস্ত করেছেন: ”আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণে তৈরি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে খনি উন্নয়নে সৃষ্ট প্রভাব যথাযথভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।”
অথচ আন্তর্জাতিক এসব দিক নির্দেশনার আন্তর্জাতিক সাফল্যের যেসব চিত্র আমাদের সামনে আছে তাতে কিন্তু নিম্চিন্ত হওয়ার কোন সুযোগই নেই। এসব আন্তর্জাতিক দিক নির্দেশনা স্বত্ত্বেও জার্মানির লুসিটিনিয়া কিংবা অষ্ট্রেলিয়ার হান্টার ভ্যালি এলাকায় এসিড মাইন ড্রেনেজ এর ফলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে-সালফিউরিক এসিড এবং এর প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভের পানির অম্লত্ব বেড়েছে, নদীতে সল্ট ব্যাংক সৃষ্টি হয়েছে এমনকি হান্টার ভ্যালী এলাকায় এসিড বৃষ্টি পর্যন্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে অপারেশনাল একটি খনি ওকে টেডি(OTML) কপার-গোল্ড মাইনের কথা বলা যেতে পারে। পাপুয়া নিউগিনি'র এই খনিটিতে মাইনিং কর্তৃপক্ষ বর্তমানে প্রচলিত সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি ব্যাবহার করেও এএমডি বন্ধ করতে পারে নি। আগামি ১০০ বছর ধরে খনিটি নিকটস্থ ফ্লাই নদীতে এসিড ঢেলে যাবে। এ বিষয়ে লন্ডনের নস্ট্রোমো রিসার্চের পরিচালক রজার মুডি বলেছেন: "যদি এসিড মাইন ড্রেনেজের উতস সঠিক ভাবে সনাক্ত করাও সম্ভব হয়, তবুও বর্তমানে প্রচলিত কোন পদ্ধতি ব্যাবহার করেই এসিড মাইন ড্রেনেজের সর্ম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।"(সূত্র: Phulbari coal: a Parlous Project by Roger Moody)
কয়লার চাহিদা ও রপ্তানি ইস্যু
উন্মুক্ত খননের মাধ্যমে একবারে বিপুল পরিমাণে কয়লা উত্তোলন করে রপ্তানি পরিস্থিতি সৃষ্টি সম্পর্কে আনু মুহম্মদ বলেছিলেন: “উন্মুক্ত খনির অপরিহার্য পরিণতি বিপুল অংশের রপ্তানি।” জোবায়ের জামানের মতে আনু মুহম্মদ নাকি “কয়লার প্রকৃত চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।” চলুন দেখি ফুলবাড়ির উন্মুক্ত খনি বিষয়ে এশিয়া এনার্জি বক্তব্য কি। এশিয়া এনার্জির সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট, ২০০৫ এর মূল মন্ত্রই ছিল:" রপ্তানির সুযোগ ছাড়া এই খনি একেবারেই লাভ জনক হবে না।" বছরে মোট ৮ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলিত করে মাত্র ৩ মিলিয়ন টন দেশে রেখে বাকিটা বিদেশে রপ্তানির করার পরিকল্পনা করছিল এশিয়া এনার্জি।(সূত্র: এশিয়া এনার্জির SEIA, প্যারাগ্রাফ ৭)
আবার সাম্প্রতিক কালে জার্মানির আরডব্লিউএজি কোম্পানির মাধ্যমে উন্মুক্ত খননের যে পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে সেখানেও কিন্তু রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। গত ১৩ ই এপ্রিল ঐ কোম্পানির প্রধান ভূ-তত্ত্ববিদ থমাস ভন সোয়ার্জেন বার্গ দ্যা ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে সেই প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছেন। ফূলবাড়ি ও বড়পুকুরিয়াকে একত্রে উন্মুক্ত খননের প্রস্তাবে তিনি "সীমিত পরিমাণ" কয়লা রপ্তানির প্রস্তাব তুলে বলেছেন: “এই উচ্চমূল্যের কয়লা সীমিত পরিমাণে রপ্তানি করলে বাংলাদেশের ঋনাত্মক বাণিজ্য ভারসাম্যের উন্নতি ঘটবে, ট্যাক্স ও রয়্যালিটি বেশি পাওয়া যাবে এবং শুধু মাত্র বিদ্যুত কেন্দ্র ভিত্তিক কয়লা উতপাদন থেকে বেরিয়ে আসা যাবে”। এরপর তিনি কয়লা ব্যাবহার ও রপ্তানির একটা চিত্রও তুলে ধরেছেন: “যদি বছরে ১১.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয় তাহলে ১০ মিলিয়ন টন ব্যাবহার করা যাবে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদনের কাজে আর বাকি ১.৫ মিলিয়নটন রপ্তানি করা হবে। এ ক্ষেত্রে কয়লা খনির আয়ু হবে ৭০ বছর।” তিনি আরো বলেছেন যদি বছরে ১৬ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয় তবে খনির আয়ু হবে ৫০ বছর। সেক্ষেত্রে বছরে এই ১৬ মিলিয়ন টন কয়লা থেকে কি পরিমাণ কয়লা দেশে ব্যবহার করা সম্ভব হবে আর কি পরিমাণ বিদেশে রপ্তানি করলে “বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের উন্নতি ঘটবে” সে বিষয়ে অবশ্য তিনি কোন কথা বলেন নি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, জোবায়ের জামান সাহেব যতই দেশে কয়লার ক্রম বর্ধমান চাহিদার কথা বলে রপ্তানি সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরীর চেষ্টা করুক, আনু মুহম্মদের তোলা রপ্তানির আশংকাটি মোটেই অমূলক নয়।
সবশেষে জোবায়ের জামান “দেশের কয়লা কী পদ্ধতিতে উত্তোলিত হবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ধারিত হতে পারে না ” জাতীয় কথাবার্তা বললেও তার লেখা এবং আমাদের আলোচনা থেকে বোঝা শক্ত নয় যে, তিনি নিজেই বহুজাতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমরা মনে করি, কয়লা উত্তোলিত হবে কি হবেনা, কি ভাবে হবে, কি পরিমাণে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো আর যাই হোক জোবায়ের জামানের মতো বহুজাতিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার মতো নয়, এগুলো নির্ধারিত হতে হবে দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট এলাকার জন-গোষ্ঠী ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তির মাধ্যমে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



