গত রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১০, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক কেয়ার্ন এবং তার পার্টনার কোম্পানি অষ্ট্রেলিয়া ভিক্তিক সান্টোস ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলিবার্টনের সাথে এক সংশোধিত পিএসসি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৬ নম্বর ব্লকের নতুন আবিস্কৃত গ্যাস কেয়ার্ন কর্তৃক সরাসরি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হলো। এর আগে বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে কেয়ার্নের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে প্রাথমিক সম্মদি প্রদান করেছিলো। গত রবিবার পেট্রোবাংলার কার্যালয়ে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- পেট্রোবাংলার পক্ষে সংস্থার সচিব ইমাম হোসেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে উপসচিব(উন্নয়ণ) এ কে মহিউদ্দিন আহমেদ, কেয়ার্ন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফিল ডোলান, সান্টোস এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ব্যাবস্থাপক জন চেম্বার এবং হ্যালিবার্টনের বাংলাদেশের শওকত হোসেন। উল্ল্যেখ্য এই ব্লকে কেয়ার্ন ও সান্টোসের প্রত্যেকের ৩৭.৫% করে অংশীদ্বারিত্ব রয়েছে, বাকি ২৫% অংশীদ্বারিত্ব হ্যালিবার্টনের।
পেট্রাবাংলাকে পাশ কাটিয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির এই চুক্তি বাংলাদেশে এই প্রথম । তাছাড়া প্রথমবারের মতো কোন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কম্পানির সাথে জ্বালানী মন্ত্রণালয় নিজেই চুক্তি স্বাক্ষর করলো- এতদিন পর্যন্ত সমস্ত চুক্তি স্বাক্ষর করতো পেট্রোবাংলা। প্রডাকশান শেয়ারিং কণ্ট্রাক্ট(পিএসসি) বা উৎপাদন অংশীদ্বারিত্ব চুক্তিতে সাধারণত উত্তোলিত গ্যাসের ৮০ ভাগ মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হলেও শর্ত থাকে যে ঐ গ্যাস বহুাজাতিক কোম্পানি নির্ধারিত মূল্যে পেট্রোবাংলা ছাড়া আর কারও কাছে বিক্রি করতে পারবে না। শুধু মাত্র পেট্রবাংলা গ্যাস কিনতে অপারগতা প্রকাশ করলেই তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ বেসরকারি দেশি-বিদেশী কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এভাবে নির্ধারিত দামে বাপেক্সের কাছে গ্যাস বিক্রির মানে হলো বহুজাতিক কোম্পানির জন্য তুলনামূলক কম মুনাফা অর্থাৎ যা তাদের বিবেচনার্য় ”লস” বলেই গণ্য হয় কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে পারলে এর চেয়ে বহুগুণ দামে সে বিক্রি করে আরো দ্রুত আরো বেশি মুনাফা তুলে নিতে পারতো! ফলে এ দেশে গ্যাস উত্তোলণের শুরু থেকেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শুধু ৮০ ভাগ মালিকানা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল না, সেই সাথে বিদেশে রপ্তানির ধান্দাও তারা বারবার করেছে। কিন্তু জনগণের আন্দোলনের মুখে সেটা এখন পর্যন্ত করতে সক্ষম না হলেও এবার কৌশলে দেশের ভেতরেই রপ্তানি মূল্য হাসিল করার আয়োজন করে জনগণকে তার জ্বালানি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যাবহার থেকে বঞ্চিত করবার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হলো।
বাপেক্স বা পেট্রবাংলা গ্যাস উত্তোলন করলে তার খরচ প্রতি হাজার ঘন ফুট (এমসিএফ) এ ২৫ টাকার মতো পড়লেও বিদেশী কোম্পানির সাথে পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের দেশের গ্যাস সরকারকে এতদিন কিনতে হতো চুক্তি ভেদে প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ ডলার মূল্যে অর্থাৎ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মূল্যে। এভাবে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে বাড়তি মূল্যে গ্যাস কেনাটা বাপেক্স বা পেট্রবাংলা তথা দেশের জনগণের জন্য সুস্পষ্ট লস এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির চোখ দিয়ে দেখলে পেট্রবাংলার কাছে ৩/৪ ডলার মূল্যে গ্যাস বিক্রি করাটা এক অর্থে বহুজাতিক কোম্পানির জন্যও ”লস” কারণ রপ্তানি করতে পারলে তো সে অবলীলায় প্রতি ইউনিট ১০/১২ ডলারে বিক্রি করতে পারতো!! যেমন: কেয়ার্নের কাছ থেকে এতদিন পিএসসি চুক্তি অনুসারে সরকার প্রতি এমসিএফ গ্যাস কিনতো ২.৯ ডলার বা ২০৩ টাকা মূল্যে। এভাবে কেয়ার্ন সাংগু গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ৮০ ভাগ মালিকানায় গ্যাস উত্তোলণ করে এবং সেটা পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করে কম মুনাফা করেনি। কিন্তু তারপরও ছলে-বলে কৌশলে মুনাফা সর্বোচ্চ করণের চেষ্টার কোন কমতি ছিলনা কেয়ার্নের। বিডিং এর সময় প্রকল্প ব্যায় মাত্র ১০.৮১ মিলিয়ন ডলার দেখালেও গ্যাস কূপ খনন, সমুদ্রে প্লাটফর্ম তৈরী ইত্যাদি নানান খাতে বাড়তি খরচ দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রকল্প ব্যায় চার চারটি সংশোধিত বাজেটের মাধ্যমে ২৬৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে এবং কস্ট রিকভারী গ্যাসের মাধ্যমে তার চেয়ে আর অনেক বেশি উসুলও করে নেয়। আবার দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি অনুপাতে গ্যাস উত্তোলণ করে সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রকে সময়ের আগেই অনুত্তোলন যোগ্য করে তোলে। তারপরও খায়েশ মেটেনি। কোম্পানিটি ২০০৮ সালে ১৬ নং ব্লকের মগনামায় গ্যাস আবিস্কারের সম্ভাবনা আবিস্কারের পর মগনামা ও হাতিয়া স্ট্রাকচারের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। তারা যুক্তি দেয় পিএসসি চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত দামে যদি পেট্রবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে হয় তাহলে তাদের পোষাবেনা। তারা আবদার করে পিএসসি চুক্তি ভঙ্গ করে হলেও হয় তাদের বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করতে দিতে হবে নতুবা বেশি দামে দেশের ভেতরেই তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমোদন দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমে এ আবদার তোলা হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমালোচনার মুখে তখন সেটার অনুমোদন দিতে সাহস করেনি কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করেই কেয়ার্ন কর্তৃক তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যস বিক্রির জন্য প্রাথমিক সম্মতি প্রদান করে। এখনকার মতো তখনও যুক্তি দেখানো হয়েছিল এই গ্যাস সংকটের কালে কেয়ার্নকে যদি বেশি দামে গ্যাস বিক্রির সুযোগ দেয়া না হয় তাহলে তারা গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পরবর্তী যে কাজগুলো করা দরকার অর্থাৎ ৩ডি সিসমিক সার্ভে, কূপ খনন ইত্যাদি করতে উৎসাহ দেখাবে না ফলে গ্যাস সংকট সহসাই কাটবে না। কি হাস্যকর যুক্তি! কেয়ার্ন ততদিনে এই ক্ষেত্রটিতে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ফেলেছে এবং প্রাথমিক ভাবে গ্যাস প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিতও হয়েগিয়েছে। এরকম একটা অবস্থায় এতগুলো ডলার বিনিয়োগ করার পর এবং নিশ্চিত গ্যাসপ্রাপ্তি ও মুনাফার সুযোগ ফেলে দিয়ে কেয়ার্ন দেশ ছেড়ে চলে যাবে এটা কেবল বহুজাতিকের দালালি করলেই বিশ্বাস করা সম্ভব!
আরেকটা বিষয় হলো গ্যাসের সংকট লাঘবের কথা বলে তৃতীয়পক্ষের কাছে বিক্রি করার অনুমতি দেয়ার যুক্তি কি? আশা করা হচ্ছে এই মগনামা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উত্তোলণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস ঘাটতি দৈনিক ২৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট। অর্থাৎ এই ব্লক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান ঘাটতির প্রায় এক পঞ্চমাংশ মেটানো সম্ভব হতো যদি রাষ্ট্রীয় তদারকিতে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাতে গ্যাসটুকু বরাদ্দ করা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পেট্রবাংলা তথা জনগণ আর এই গ্যাসের ৮০% পাবে না কারণ এই চুক্তির ফলে কেয়ার্ন আর তার ভাগের অংশ ২.৯ ডলার মূল্যে পেট্রবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে বাধ্য নয়, সে বাজারের যেসব কোম্পানির কাছ থেকে বেশী দাম পাবে তাদের কাছেই গ্যাস বিক্রি করবে। ইতোমধ্যেই কাফকো, কোরিয় ইপিজেড ইত্যাদি বিদেশী মালিকানাধীন কোম্পানি ৭ ডলার এরও বেশি মূল্যে গ্যাস কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর আগে একসময় রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির কাছ থেকে কাফকো ১২ ডলার মূল্যেও প্রতি ইউনিট গ্যাস ক্রয় করেছে। এখন কাফকো কিংবা কেইপিজেড এর মতো বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বেশি দামে গ্যাস কিনে নিয়ে গেলে জ্বালানি খাতে জনগণের যে সংকট সেটা কিভাবে লাঘব হবে? জনগণ কি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাবে, রাষ্ট্রীয় সার বা বিদ্যূৎ কারখানা কি এর ফলে বাড়তি গ্যাস পাবে? ফলে এটা পরিস্কার এই চুক্তির ফলে কেয়ার্ন এবং তার বহুজাতিক পার্টনার সান্টোস ও হেলিবার্টন বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ গ্যাস বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করলেও বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় গ্যাসটুকু পাবে না। যখন গ্যাসের অভাবে সরকারি গ্যাস কারখানা কিংবা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকবে, তখনও অর্থের জোরে বেসরকারী কিংবা বিদেশী কোম্পানি কেয়ার্নের কাছ থেকে গ্যাস কিনে নেবে।
এভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে পেট্রবাংলা তথা সরকার শুধু নিজের পায়ে (এবং জনগণের গায়ে) কুড়ালই মারলো না সাথে সাথে বলা যায় খাল কেটে কুমিরও ডেকে আনল। কারণ একবার কেয়ার্নকে বেসরকারি দেশি-বিদেশী কোম্পানির কাছে বেশি মূল্যে গ্যাস বিক্রি করার অনুমতি দেয়ার পর শেভরন কিংবা নাইকোর মতো অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও পেট্রবাংলাকে পাশকাটিয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার আবদার শুরু করবে। ফলে দেখা যাচ্ছে জনগণের চাপে শাসক শ্রেণী বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে গ্যাস এখন পর্যন্ত বিদেশে রপ্তানির সাহস না পেলেও কৌশলে দেশের ভেতরেই বিদেশী কোম্পানির কাছে বিক্রির সুযোগ করে দিয়ে পরোক্ষভাবে রপ্তানী মূল্য হাসিল অর্থাৎ দুধের স্বাদ তাদেরকে ঘোলে মেটানোর ব্যাবস্থা করে দিলো যার ফলাফলস্বরূপ জনগণ তার সম্পদ তার নিজের প্রয়োজনে ব্যাবহার করা থেকে বঞ্চিত হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


