যেমন: ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আওতায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার একটি কোর কমিটি গঠন করে। কোর কমিটি স্বল্পতম সময়ে ট্রানজিট বিষয়ে একটি অবস্থান পত্রের খসড়া দাড় করায়। এই খসড়ায় অবকাঠামোগত অপ্রতুলতায় আগামী তিন বছরের মধ্যে রেল ও সড়ক পথে ট্রানজিট দেয়া সম্ভব নয় বলে উল্ল্যেখ করে। বিকল্প হিসেবে এই সময় ট্রানসিপমেন্ট চালু করা এবং অবকাঠামো উন্নয়ণের পদক্ষেপ নিতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ট্রানজিটের ফলে বছরে এক কোটি ৭৪ লক্ষ মেট্রিকটন পণ্যের যান চলাচল করতে পারে। এটি সম্ভাব্য কিছু অনুমানের হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। নানান কারণে এই অনুমান সঠিক নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ট্রানজিট মাসুল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের পণ্য বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে চলাচলের ফলে কত অর্থ বেচে যাবে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশকে কত অর্থ ভারতকে মাসুল হিসেবে প্রদান করতে হবে তার তুলনা না করে বলা সম্ভব নয় বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে কত পরিমাণ পণ্য চলাচল করবে , তার জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খরচ কত হবে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশের লাভই বা কত হবে। কিন্তু এসব বিষয় নিশ্চিত না করে বিভিন্ন সময় হাজার হাজার কোটি টাকা লাভালাভের খোয়াব দেখানো হচ্ছে জনগণকে।
ট্রানজিটের লাভ-ক্ষতির হিসাব:
ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ভারত তার মূলভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্রুততর সময়ে এবং স্বল্পতম খরচে মালামাল আনা-নেয়া করতে পারবে। বর্তমানে ১৫ টনি ট্রাক-লোড মালামাল আগরতলা থেকে কলকাতায় পরিবহনের খরচ ভারতীয় মুদ্রায় ৫০,০০০-৬০,০০০ রুপী (দূরত্ব ১৫০০ কিমি) আর ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহন করলে দূরত্ব কমে প্রায় ৫০০-৬০০ কিমি এ নেমে আসবে এবং ফলে প্রতি টনের খরত ২০০০ রুপী করে কমে যাবে। এক হিসেবে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রতি বছর ১ কোটি ৭ লক্ষ টন পণ্য পরিবহন করে এবং সেখান থেকে বছরে ২৩ লক্ষ টন পণ্য নিয়ে আসে। ফলে ট্রানজিট হলে পরিবহনের সময় এবং খরচ কম হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভারতের কেন্দ্রে আরো প্রতিযোগীতা মূল্যে তাদের পণ্য ও কাচামাল সরবরাহ করতে পারবে এবং কেন্দ্র থেকেও কমখরচে এবং কম সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্যসরবরাহ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া বিদ্রোহ প্রবণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ দমণের জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্য ও সমরাস্ত্রও সরবরাহ করতে পারবে দ্রুত।
কিন্তু বাংলাদেশের কি লাভ? বলা হচ্ছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে নিয়ে আসার সুযোগ পাওয়া যাবে এবং শুল্ক বাবদ বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব হবে। দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ ৩০০কোটি ডলারের বেশী। আর সীমান্ত পথে চোরাচালানী হিসাবে নিলে সেখানেও বাণিজ্য ঘাটতি সমপরিমাণের। এখন ট্রানজিটের মাধ্যমে এই বাণিজ্য ঘাটতি কিভাবে কমবে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। বরং ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে আমাদের যে রপ্তানি বাণিজ্য আছে সেটাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেননা যোগাযোগ সহজ হয়ে যাওয়ায় তখন ভারত-ই আমাদের চেয়ে বেশী প্রতিযোগীতা মূল্যে তাদেরকে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে!
আর এই সমস্তের বিনিময়ে আমরা কি পাবো? এত দিন ঘটা করে বলা হতো শুল্ক বা বিভিন্ন ধরনের লেভি/চার্জ ইত্যাদির কথা। এখন কিন্তু সে আশাতেও গুড়ে বালি। ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে বিদ্যমান নৌপথে ট্রানজিট সুবিধার বিপরীতে ভারতীয় জাহাজ থেকে মাশুল আদায় নিয়ে বিপত্তি ঘটে। সরকারের একটি অংশ কোনোরকম মাশুল বা ফি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দিতে সচেষ্ট হয়। একপর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জারি করা ট্রানজিট বিষয়ক বিধিমালাও স্থগিত করা হয়। ২০১০ এর জুনে এনবিআর এ বিধিমালা জারি করে স্থল ও রেলপথে ট্রানজিটের আওতায় প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ১ হাজার টাকা মাশুল নির্ধারণ করেছিল। ভারত দাবি করে আসছে, প্রচলিত টোল ছাড়া ট্রানজিটের জন্য কোনো প্রকার ফি তারা দেবে না। শাসক শ্রেণী এতদিন হাজার হাজার কোটি টাকার স্বপন দেখালেও বাস্তবে ভারতের এই আব্দার নতুন নয়। ট্রানজিট বিষয়ক ভারতের খসড়া প্রস্তাবেই বিষয়টি আছে। গত ২০০৮ এ ভারতের প্রস্তাবিত "বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে যানবাহন এবং কার্গো পরিবহনে নিয়মনীতির খসড়া" অবলম্বন করে ১ অক্টোবর ২০০৯ তারিখের ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকাটি জানাচ্ছে:
“ভারতীয় প্রস্তাবটিতে উভয় দেশের স্থল পথ ব্যাবহারের জন্য পরস্পরের যানবাহনের উপর অতিরিক্ত কর বা লেভি আরোপের বিরোধীতা করা হয়েছে।”
প্রস্তাবনা অনুসারে, এমনকি ভারতীয় যানবাহন চলাচলে রাস্তাঘাট সহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরী ও রক্ষানাবেক্ষণও করতে হবে বাংলাদেশকে নিজ অর্থে!
তার পরেও যদি ধরে নেই, দর কষাকষি করে বাংলাদেশ শুল্ক-টুল্ক পাওয়ার একটা ব্যাবস্থা করে ফেলল- কিন্তু তাতেই কি ট্রানজিট-বন্দর দেয়া জায়েজ হয়ে যাবে? এই শুল্ক তো আর এমনি এমনি আসবে না, রস্তাঘাট, হাইওয়ে, রেলযোগাযোগ, বন্দর, শুল্ক কাঠামো ইত্যাদির পেছনে নিয়মিত যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হবে বাংলাদেশকে। এই সব বাদ দিয়ে হাতে কিছু থাকবে কিনা তার হিসেব কি করা হয়েছে? আর যদি কিছু থাকেও, তা কি ট্রানজিটের বিনিময়ে যে ব্যাপক রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামরিক নানা ঝুকির মধ্যে আমরা পড়ব,তার ক্ষতিপূরণের জন্য যথেষ্ট?
অধ্যাপক আনুমুহম্মদ তাই সঠিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন:
শুধু গাড়িভাড়া হিসাব করলেও তো হবে না। বাংলাদেশের জন্য আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জমি সীমিত, আবাদি জমি নষ্ট করা তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের ক্রমবর্ধমান পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে যে সড়ক সম্প্রসারণ ও সংযোজন করতে হবে, তা কত কৃষিজমি-জলাভূমি বিনাশ করবে? এর ফলে খাদ্যসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন, জীববৈচিত্র্য কত বিনষ্ট হবে? কত পরিবেশ দূষণ হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজের পণ্য পরিবহন ভবিষ্যতে অনেক বাড়বে। এখনই বিভিন্ন রাস্তায় জটের কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, পচনশীল দ্রব্য বিনষ্ট হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়ে। ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমাদের পণ্যপ্রবাহে কী রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে? তৃতীয়ত, যে রাজ্যগুলোতে ভারত পণ্য নিয়ে যাবে, সেসব রাজ্য এত দিন ছিল বাংলাদেশের বহু শিল্পপণ্যের বাজার। সেই বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে, সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। এর ক্ষতি কত? চতুর্থত, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে তিন দিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে রাখে, সেখানে বাংলাদেশ ভেদ করে তার পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তাব্যবস্থা কে করবে? কী পণ্য ভারত নিয়ে যাচ্ছে, এর তদারকির ব্যবস্থা কী থাকবে? পঞ্চমত, নদী, কাঁটাতার, অসম প্রবেশাধিকার, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আগে সমাধান কেন নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ভারতের কাছ থেকে কঠোর শর্তযুক্ত ঋণ নেওয়ার চুক্তি হয়েছে তাদেরই কাঙ্ক্ষিত পণ্য পরিবহনব্যবস্থা দাঁড় করার জন্য!
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি :
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানায় খনিজ উত্তোলণের বেলায় বরাবরই পুজি না থাকার যুক্তি দেয়া হয় কিন্তু বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে সেই খনিজ কেনার সময় কিন্তু পুজির ঘাটতি পড়েনা। একই ভাবে রাষ্ট্রীয় খাতে বিদ্যুত উতপাদনের পুজি না থাকার কথা বলা হলেও আমরা দেখছি ভারত থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার বা ১,৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ১০০ কি.মি দীর্ঘ হাইভোল্টেজ ট্রান্সমিশান লাইন বসিয়ে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বেলায় পুজির কোন অভাব নাই। অর্থাৎ আমাদানি কিংবা ভর্তুকীর ক্ষেত্রে পুঁজির অভাব পড়েনা, অভাব পড়ে কেবল রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগের বেলাতে।
পিডিবির ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় খাতে সিদ্ধিরগঞ্জে ২৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের খরচ ধরা হয়েছে ৬৮৫ কোটি টাকা। কাজেই যে টাকা খরচ করে ভারত থেকে ১০০ কি.মি ট্রান্সমিশান লাইনে ৭-৮% ট্রান্সমিশান লস দিয়ে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে সে টাকায় রাষ্ট্রীয় খাতে এর দ্বিগুণ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বলা হচ্ছে দ্রুত বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলার জন্যই লস দিয়ে হলেও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন। অথচ বাস্তবতা হলো ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমাদানীর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে কম করে হলেও দুই বছর সময় লাগবে। এই সময়ে তো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব! তাছাড়া ভারত নিজেও তীব্র বিদ্যূৎ সংকটে ভোগা একটি দেশ যেখানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যূৎ উৎপাদনের ঘাটতি থাকে ৭-১১%। ফলে সেই ভারত থেকে সারাবছর ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির আশা করাও ভুল কারণ ভারত ও বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রায় একই ধরণের হওয়ায় বাংলাদেশে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ হবে ভারতেও তখন সর্বোচ্চ চাহিদার কারণে বিদ্যুৎ সংকট থাকবে ফলে ভারত কেবল তার উদ্বৃত্ত মৌসুমেই বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে রাজি হবে যখন বাংলাদেশেরও বিদ্যুতের চাহিদা সর্বনিম্ন থাকবে। আবার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর জন্য প্রতি ইউনিট কত খরচ পড়বে সেটাও পরিস্কার করে বলা হচ্ছে না। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারতের ১৬ তম সংলাপের সময় ভারতীয় প্রতিনিধি দল প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ রুপি( ১১/১২ টাকা) করে প্রস্তাব করেছিল। বর্তমানে ২০১০ সালে এসে ভারত যদি দাম নাও বাড়ায়, তাহলেও বাংলাদেশকে যদি ১১/১২ টাকা করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানী করতে হয়, তাহলে পাবলিক সেক্টরের খরচের( প্রতি ইউনিট ২/৩ টাকা) তুলনায় বাংলাদেশকে প্রতি ইউনিটে বেশি দিতে হবে ৯ টাকা করে। ৬০% লোড ফ্যাক্টরে প্রতিদিন ১৭ ঘন্টা করে বিদ্যুৎ আমদানি করলে বছরে মোট আমদানি হবে ৯১.৮ কোটি ইউনিট। ফলে বছরে বাংলাদেশের গচ্চা যাবে মোট ৮২৬.২০ কোটি টাকা।
এই ক্ষেত্রে তথাকথিত দাতা সংস্থাগুলোর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইড ইত্যাদি সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জ্বালানী, বিদ্যুৎ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় খাতকে বেসরকারী করণ এবং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর এই সিদ্ধান্তের পেছনেও এসব সংস্থা এবং তাদের লালিত পালিত কনসালটেন্টদের ভূমিকা রয়েছে। ইউএসএইড ২০০৬ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে একটি প্রাক-সম্ভাব্যতার স্টাডি পরিচালনা করে। সেই স্টাডিতে স্বল্প মেয়াদে(২০০৯-২০১০) ২৫০ মেগাওয়াট, মধ্যমেয়াদে (২০১১-২০১২) ৫০০ মেগাওয়াট এবং দীর্ঘমেয়াদে( ২০১৫-২০১৬) ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির প্রস্তাবনা দেয়া হয়। প্রস্তাবনায় দেখানো হয় বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৯ টাকা এবং ভারতের খরচ প্রতি ইউনিট ২ রুপি। এভাবে বাংলাদেশের খরচ তিনগুণ বাড়িয়ে হিসেব করে দেখানো হয় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ৬০% লোড ফ্যাক্টরে দৈনিক ১৭ ঘন্টা করে ব্যাবহার করলে বছরে ৯১.৮ কোটি ইউনিট করে বাংলাদেশ নাকি বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে বছরে ৭৮ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে! সেই প্রস্তাবনায় ভারতের বহরমপুর থেকে ঈশ্বরদি অব্দি মোট ১০০ কি.মি ৪০০ ভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইন করার কথা বলা হয়েছিল।
ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির যে ঘোষণা বাংলাদেশ দিয়েছে সেটা কিন্তু ইউএসএইড নির্দেশিত বহরুমপুর-ঈশ্বরদি রুটেই!
ভারত কে বন্দর ব্যাবহার করতে দেয়াটা কতটা লাভজনক?
ভারতকে চট্রগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যাবহার করতে দেয়ার পক্ষের যুক্তি হিসেবে বলা হয় বর্তমানে এই দুটি বন্দরের ক্ষমতার যথাক্রমে ৪০% এবং ৯০% অব্যাবহ্রত আছে ফলে বন্দর ব্যাবহার করতে দেয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই। অথচ এতদিন আমরা জানতাম বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের জন্যই চট্টগ্রাম বন্দরের য়থেষ্ট ক্ষমতা নেই, প্রয়োজনীয় জায়গা ও যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে প্রায়ই কন্টেইনার জট লেগে থাকে- যেকারণে গত সরকারের সময় বসুন্ধরা গ্র“প বর্তমান বন্দরের ভাটিতে একটি বেসরকারি বন্দর স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করেছিল কিন্তু বেসরকারি বন্দর স্থাপনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়ায় সে প্রচেষ্টা সেখানেই থেমে যায়। অথচ এখন ভারতকে ব্যাবহার করতে দেয়ার বেলায় আমাদেরকে বলা হচ্ছে বন্দরের ৪০%/৯০% ক্ষমতাই নাকি অব্যবহ্রত! এ প্রসঙ্গে আমরা একটু যাচাই বাছাই করে দেখতে চাই আসলে এই দাবীটুকু কতটুকু সত্য এবং সেই সাথে আরেকটা প্রশ্নও তুলতে চাই- যদি বর্তমানে বন্দরের একটা অংশ অব্যাবহ্রত থাকেও, তাহলেও সেটুকু ভবিষ্যতের বিবেচনা না করেই ভারতের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে বছরে ১১ লাখ কন্টেইনার উঠানামা হয়। ৪০% ক্ষমতা যদি অব্যবহ্রত থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে বর্তমানে বন্দরে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়ে আরো বাড়তি ৭.৩৩ লক্ষ কন্টেইনার উঠানামা করার মতো যন্ত্রপাতি অলস পড়ে রয়েছে। বাস্তব চিত্র কি? চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে ১৯৯৫ সালে প্রণীত সর্বশেষ মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছিল, বছরে ১১ লাখ কন্টেইনার ওঠানামার কাজ করতে হলে কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার টায়ার্ড, গ্যান্ট্রি ক্রেন, রিচ স্ট্রেকার, কন্টেইনার মুভার, ট্রাক্টর, ট্রেইলর ও ফর্ক লিফটের মতো অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি লাগবে ৬৫১টি। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে এ মুহূর্তে এমন যন্ত্রপাতি আছে মাত্র ১৯৫টি অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৩০% যন্ত্রপাতি আছে চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আবার ৬০ শতাংশেরও মেয়াদকাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তাই প্রতি বছর ওয়ার্কশপে নিতে হচ্ছে গড়ে ৯০ থেকে ৯৫টি যন্ত্রপাতি। ১৯৫টি যন্ত্রপাতির মধ্যে বর্তমানে ওয়ার্কশপে আছে ৭৩ টি। আর এভাবে কার্যত ৭০% এরও বেশি ঘাটতি নিয়ে চলছে বলেই বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান কাল আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার বদলে ৬০ ঘন্টা।( সূত্র:দৈনিক সমকাল, ২৭ জানুয়ারি, ২০১০)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাই বর্তমানে বন্দরের নেই! তাহলে কোন যুক্তিতে ভারতকে বন্দর ব্যাবহার করতে দেয়া হচ্ছে? আরেকটা বিষয় হলো, বন্দরের ক্ষমতা কেবল বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত নয়- এর সাথে বন্দরে আসা যাওয়ার প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট, যানবাহন, টোল, চেকিং ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় ব্যাবস্থাপনার বিষয়টিও যুক্ত। আমাদের রাস্তাঘাট অবকাঠামো ইত্যাদি কি এসবের জন্য উপযুক্ত?
আবার তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে সরকারি বক্তব্য অনুসারে আসলেই বন্দরের ৪০% ক্ষমতা অব্যবহ্রত। তাহলে সে ক্ষেত্রেও কি কিছু ভাড়ার বিনিময়ে ভারতকে বন্দর ব্যাবহার করতে দেয়াটা একটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত? বন্দরের সামর্থ্য যদি অব্যবহ্রত থাকে তাহলে তার কারণ কি? বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও কৃষির উন্নয়ন পরিপূর্ণ হয়েগেছে, আমদানি রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার আর কোন সুযোগ নেই- ব্যাপারটাকি এরকম নাকি বাংলাদেশের শিল্প কৃষি এখনও অবিকশিত বলেই এমনটি রয়ে গেছে? এখন আমরা যদি আমাদের শিল্প-কৃষির বিকাশ ঘটাই তাহলে অচিরেই এ ক্ষমতার পুরোটাই লাগবে। কিন্তু যদি চিরকাল পরনির্ভরশীল ও কমিশন ভোগি ভাড়াজীবি অর্থনীতির দেশ হিসেবে টিকতে চাই তাহলে হয়তো এই সাময়িক অব্যবহ্রত ক্যাপাসিটিকে ভারতের কাছে ভাড়া দেয়ার প্রশ্ন আসে। কারণ একবার ভারতকে এই সুবিধা দিয়ে দেয়ার পর আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে যখন বন্দরের পুরো ক্ষমতাই আমাদের লাগবে তখন কিন্তু চাইলেই আমরা ভারতের কাছ থেকে এই সুবিধা ফিরিয়ে নিতে পারবো না কারণ ততদিনে ভারতের অর্থনীতি এর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে, ভারত বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করে হলেও এই সুবিধা বজায় রাখতে চাইবে।
তাছাড়া ভারতীয় যানবাহন আমাদের রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্টের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগের বিষয়টির পাশাপাশি আমাদের অভ্যান্তরীণ রাজনীতিতেও বাড়তি চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্তিতিশীলতা বা অস্থিতিশীলতা এখন ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠবে কারণ এখানে একদিন হরতাল থাকলে এখন ভারতের আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ হতে থাকবে। তাছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান যে বাণিজ্য সেটা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেননা ট্রানজিটের ফলে ভারতের কেন্দ্র থেকে এখন সহজেই বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশের চেয়ে সস্তায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সর্বরাহ করা যাবে ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আর বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, খাদ্য-দ্রব্য, টেক্সটাইল, কসমেটিকস, টয়লেট্রিজ, সিমেন্ট ইত্যাদি পণ্যের ৩০ মিলিয়ন ডলারের বর্তমান বাজার হারাবে বাংলাদেশ। আর এত কিছু ক্ষতির বিনিময়ে কি পাবে বাংলাদেশ?
সিঙ্গাপুরের খোয়াব
এ প্রসঙ্গে অনেকেই সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলার চেষ্টা করছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে এই সামান্য বাণিজ্য হারালেও বন্দরকে ভারতের কাছে ভাড়া দিলে সিঙ্গাপুরের মতই আমরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল হয়ে উঠতে পারব। এর উত্তরে বলা দরকার, আন্তর্জাতিক সি লেন এ সিঙ্গাপুরের ষ্ট্রাটেজিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের বন্দর এখন দুনিয়ার ব্যাস্ততম বন্দর এবং এ বন্দরের ৭০ ভাগ কন্টেইনার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের হলেও তার মানে কিন্তু এই না যে শিল্পায়ন না ঘটিয়ে, নিজস্ব চাহিদাকে উপেক্ষা করে স্রেফ বন্দর ভাড়া দিয়ে তার মাধ্যমেই সিঙ্গাপুর উন্নতি করেছে! সিঙ্গাপুরের বন্দর ব্যাস্ততম হয়ে উঠতে থাকে ১৯৮৬ সাল থেকে কিন্তু সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির উন্নয়ন শুরু হয় ১৯৬০ সালের দিকে। সে সময়ে সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের সুফল স্বরূপ বছরে ৮% হারে প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। এখনও সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির ৬০ ভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং জিডিপির ২৬ ভাগ আসে ইলেক্টনিক্সসহ ম্যানুফ্যাকচারিং খাত থেকে এবং জিডিপির ২২ ভাগ আসে বিভিন্ন ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস থেকে। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের শিল্পায়ন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় শক্তিশালী হওয়ার পরই সিঙ্গাপুর প্রথমে তার নিজস্ব প্রয়োজনে বন্দরের বিকাশ ঘটায় এবং পরে তার বাড়তি ক্ষমতাটুকু ভাড়া দেয়। কিন্তু আমাদের অবস্থা হলো উল্টো- আমাদের নিজস্ব শিল্প-কৃষির কোন খবর নাই, ভারতের শিল্প-কৃষির বিকাশের সুবিধা করে দেয়ার জন্য আমাদের নিজেস্ব শিল্প-কৃষির ক্ষতি করে হলেও বন্দর ভাড়া দিয়ে আমাদেরকে সিঙ্গাপুর হওয়ার ভ্রান্ত স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১১:২৫