somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুহিন ও বৃষ্টির দিন

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সকাল থেকেই অনবরত বৃষ্টি। বৃষ্টি পড়লে রুহিনের মন ভালো হয়ে যায়। ওর খুব ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে। ওর মা-ও অন্যদের মতো না। একটু আধটু বৃষ্টিতে ভিজতে দিতে তার আপত্তি নেই কোনো। আর ছুটির দিন হলে তো কথাই নেই! কিন্তু আজ বড় অসময়ে বৃষ্টি নেমেছে। এখন স্কুলে যাওয়ার সময়। বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার আবেশ কাটতে না কাটতেই দাঁত মাজা, নাস্তা করা, তারপর ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া। ছাতা নিতে রুহিনের একদমই ভালো লাগে না। সে একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে মায়ের দিকে তাকায় সহানূভুতি আদায়ের জন্য।

-ও মা, এইটুকু বৃষ্টিতে ভিজলে কী হবে? ছাতাটা রেখে যাই?

-হু, তারপর সারাদিন ভেজা কাপড়ে থেকে জ্বর বাঁধিয়ে বাসায় ফের আর কী!

-একটু জ্বর হলে কিছু হবে না মা! প্লিজ!

-তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। তবে জ্বর হলে কিন্তু করলা ভাজা আর জাউভাত খেতে হবে। বৃষ্টি দিনের খিচুড়ি-গরুর মাংস দেব না তোমাকে। ছাতাটা দাও আমাকে। যাও এখন যত খুশি ভেজ।

এ তো বড় মুসিবতে পড়া গেল! করলা আর জাউ ভাতের মতো পচা খাবার পৃথিবীতে নেই। রুহিন সবগুলো খাবারের নাম্বার দেয়। খিচুড়ি-গরুর মাংস দশে দশ, আর জাউভাত করলা দশে এক! দশে এক পাওয়া খাদ্য গলা দিয়ে নামবে না তার। তাই রুহিন হেডস্যারের মতো গম্ভীর মুখ করে ছাতাটা নিয়ে ব্যাগ সাজিয়ে রওনা দিল স্কুলের পথে।

বৃষ্টিতে সবকিছুই কী সুন্দর দেখায়! ঘাসগুলো আরও সবুজ, গাছের পাতায় প্রাণের হিল্লোল, আর মাটি যেন হয়ে ওঠে আরও কোমল ও মমতাময়ী। বাসা থেকে বের হয়ে এসব দেখে রুহিনের মন খারাপ ভাব কেটে যায়। ইচ্ছে করে ছাতাটা নামিয়ে একটু ভিজতে। কিন্তু তখনই মনে হয় করলা ভাজি তার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে আর বলছে, আজকে বাসায় এসেই নাও না, তোমার পেটের ভেতর ঢুকে গ্রুম গ্রুম করব। গ্রুম গ্রুম কথাটি হঠাৎই মনে এল রুহিনের। এর মানে কী তা অবশ্য সে জানে না। তবে খুব ভালো কিছু হবে না এটা নিশ্চিত। তাই সে ভেজার চিন্তা বাদ দিয়ে মেঘের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে চলে গেল।

রুহিনের ইচ্ছে ছিল জানালার ধারের সিটে বসবে। সেই ইচ্ছেপূরণের আনন্দটা বহাল থাকতে না থাকতেই আবারও তার মনে মেঘ জমল। প্রথম পিরিয়ড ছিল হোসনে আরা ম্যাডামের। বাংলা ১ম পত্র। আজকে ‘বনভোজন’ ছড়াটি পড়ানোর কথা ছিল। রুহিনের খুব প্রিয় একটা ছড়া। আর ম্যাডাম পড়ানও ভারী সুন্দর করে। আজকে নাকি ম্যাডাম অসুস্থ। তাই প্রথম পিরিয়ড নিতে এসেছেন রাশভারী চেহারার গম্ভীর স্বভাবের কাদের স্যার। ইনি অংক পড়ান। অংক রুহিনের খারাপ লাগে না, কিন্তু কাদের স্যারকে তার ভয় লাগে কোন কারণ ছাড়াই। এমন না যে তিনি পিটুনি বা কানমলা দেন। তবুও তাকে দেখলেই রুহিনের এবং অন্য সবার আত্মা পানি হয়ে আসে। আর কখনও হঠাৎ রেগে গেল তো সর্বনাশ! তার ধমকে সবাই চুপসে যায়। একটা কথা প্রচলিত আছে, কাদের স্যার নাকি সিংহ পোষেন। আর সিংহটা তার ধমকের ভয়ে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিরামিষাসী হয়ে গিয়েছে। এই কথাটা কতটুকু সত্যি রুহিন জানে না। তবে সত্যি হলেও বিন্দুমাত্র অবাক হবে না। কাদের স্যারকে ভয় পাবে না এমন কেউ পৃথিবীতে আছে নাকি! জানালার ধারে বসে আনমনে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসবই ভাবছিল রুহিন। আচমকা তার পাশে বসা অন্তুর ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে এল সে।

-রোল নং ১৫! নেই? রোল নং ১৬।

হায় খোদা! স্যার আবার কখন নাম ডাকা শুরু করলেন? রুহিন খেয়ালই করেনি। আজকে তার কপালে খারাবি আছে! কোনোমতে দাঁড়িয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,

-স্ স্যার, আমি রোল নং ১৫। প্রেজেন্ট প্লিজ!

-মনোযোগ কোথায় থাকে, হ্যাঁ? কী করছিলে?

স্যারের কণ্ঠে যেন একশ’টা রাগী মেঘ ভর করেছে। ভয় পেয়ে সত্যি কথাটা বলেই দেয় রুহিন।

-বৃষ্টি দেখছিলাম স্যার। আর দেখব না।

-বৃষ্টি আবার দেখার কী আছে? জলের ছিটে আসছে জানালা দিয়ে। বন্ধ করে দাও!

মন খারাপ করে জানালাটা বন্ধ করে দিল সে। কখন যে এই ক্লাশটা শেষ হবে! স্যার পড়িয়ে চলেছেন সম্পাদ্য, উপপাদ্য। পুরো ক্লাশ কাঠ হয়ে বসে শুনছে। স্যার পড়ান বেশ ভালো। কিন্তু এই গাম্ভীর্য আর রাগী রাগী মুখটাই যত সমস্যা! কী হয় একটু হাসলে? পড়াশোনার বাইরে একটু গল্প করলে? হাশিখুশি হোসনে আরা ম্যাডাম যা করতেন। ম্যাডামের আবার কী যে অসুখ হল! রহিন মনে মনে আল্লাহর কাছে তার রোগমুক্তির জন্যে প্রার্থনা করে। ক্লাশ শেষ করে একগাদা ক্লাশ ওয়ার্ক দিয়ে চলে গেলেন কাদের স্যার। আজ শেষ ক্লাসটিও তার। এরই মধ্যে এগুলো করে রাখতে হবে। যাহ! আজকে এমন সুন্দর বৃষ্টির দিনটাই মাটি করে দিলেন স্যার! লাইব্রেরি ক্লাশে বসে ক্লাশ ওয়ার্ক করতে করতে রুহিন ভাবে, কখন যে ছুটির ঘন্টা বাজবে!

মাঝে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। তবে স্কুল ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবারও বৃষ্টি পড়া শুরু হল। মুষুলধারে বৃষ্টি। এটাকেই নাকি ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি বলে-- রুহিন কিছুদিন আগে শিখেছে। রুহিনের খুব ইচ্ছে করছে ভিজতে। কিন্তু জ্বর এসে গেলে তাকে তো তেতো করলা আর বিস্বাদ জাউভাত খেতে হবে। ওদিকে সবাই গাপুস গুপুস করে খিচুড়ি মাংস খাবে। এ যে সহ্য করার নয়! বড় রাস্তার মোড় পাড় হয়ে যখন অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং কিছুটা জংলি পথ ধরে হাঁটছিল সে, হঠাৎ দেখতে পেল কাদের স্যার গম্ভীর মুখে বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে চলছেন। ছাতা একখানা তারও আছে, কিন্তু সেটি তিনি কোমড়ের কাছে ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? ছাতাটা নিশ্চয়ই নষ্ট! নইলে কি স্যারের মতো এরকম একজন বদরাগী বড়মানুষ সাধ করে এই বৃষ্টিতে ভেজে? স্যারের সঙ্গে চোখাচোখি হল তার। তবে স্যারের চোখ এখন অনেক কোমল এবং উচ্ছল মনে হল রুহিনের কাছে। ও দৌড়ে স্যারের কাছে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

-স্যার, আপনার ছাতাটা কি নষ্ট হয়ে গেছে? আমার ছাতাটা নেবেন? এতে দুইজনের বেশ হয়ে যাবে।

স্যার তখন করলেন কী, আচমকা কোমড় থেকে ছাতাটা খুলে নিয়ে বারকয়েক সেটি ফোটালেন, বন্ধ করলেন।

-ছাতা আমার ঠিকই আছে। এমনি ভিজছি। ভালো লাগছে ভিজতে। তোমার খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে, না?

আশ্চর্য! এমন নরম গলায় কথা বলছেন স্যার! এভাবে তিনি বলতে পারেন! নাকি বৃষ্টির স্পর্শ পেলে সবাই বদলে যায়?

-হ্যাঁ স্যার, আমার খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভিজে গিয়ে জ্বর বাঁধালে মা আমাকে খিচুড়ি মাংস খেতে দেবেন না। করলা আর জাউভাত দেবেন। সপ্তাহের প্রথম দিন তো, তাই এত কড়াকড়ি। কারণ, এখন জ্বর এলে পুরো সপ্তাহ স্কুল মিস হয়ে যেতে পারে যে!

-তাই নাকি? তোমাদের বাসায় আজকে খিচুড়ি আর মাংস রান্না হচ্ছে? খিচুড়ি আর মাংসের স্বাদ কখন বেড়ে যায় জানো? বৃষ্টিতে ভিজলে! ছাতাটা ফেলে দাও, এসো বৃষ্টিতে ভিজি! তোমাদের বাসায় গিয়ে আজ না হয় দুজনেই করলা আর জাউভাত খাব!

ছাতাটা বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রুহিন ভাবে, এই ঘটনাটা কালকে স্কুলে বললে কী চাঞ্চল্যই না সৃষ্টি হবে! আর খিচুড়ি-মাংস নিয়ে চিন্তাও আপাতত বাদ। সব বৃষ্টিতে জ্বর আসে না। বিশেষ করে যদি কেউ স্নেহের পরশে হাত জড়িয়ে থাকে! দূরে একটা রঙধনু উঠেছে। আজকের দিনটার মতই বর্ণিল!

(প্রথম প্রকাশ বিডিনিউজ কিডস সেকশনে)
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×