somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৭

০৩ রা আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
জন্মেজয়ের সর্প যজ্ঞের মন্ত্রণাঃ

মন্ত্রীরা রাজা জন্মেজয়কে বললেন –তোমার পিতা পরীক্ষিত পান্ডবদের সমান ছিলেন। তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে একটি হরিণকে বাণ মারেন, হরিণটি পালায়। তাকে খুঁজতে খুঁজতে গভীর বনে রাজা পরীক্ষিত ক্ষুদাতৃষ্ণায় কাতর হন। এক মৌণ মুনির কাছে হরিণ সম্পর্কে জানতেও চান। উত্তর না পেলে রাগে তার গলায় মৃত সাপ ঝুলিয়ে আসেন। মুনির পুত্র শৃঙ্গী সে কথা জানতে পেরে রাজাকে সাতদিনের মধ্যে তক্ষকের কামড়ে মৃত্যু হবে-এই শাপ দেন। পুত্রের শাপে দুঃখিত মুনি দূত পাঠান রাজার কাছে।

এরপর, পরবর্তী সাত দিনের কথা মন্ত্রীরা জন্মেজয়কে জানালেন। কাশ্যপ মানে এক মুনি সাপের কামড় থেকে রাজা পরীক্ষিতকে বাঁচাতে আসছিলেন। পথে তক্ষকের সাথে তার দেখা হয়। তক্ষকের কামড়ে মৃত বৃক্ষ কাশ্যপ জীবন্ত করে তোলেন। কিন্তু তক্ষকের চালাকিতে এবং তার মাথার মনি পেয়ে দরিদ্র কাশ্যপ গৃহে ফিরে যায়। শেষে কপট তক্ষক এসে রাজাকে দংশন করে।

এত শুনে জন্মেজয় বললেন –কাশ্যপমুনির সাথে যে তক্ষকের দেখা হল, সে কথা সবাই জানল কি ভাবে!


মন্ত্রী বলেন –যে বৃক্ষ তক্ষকের দংশনে ভস্ম হয়, সেই বৃক্ষে এক কাঠুরে কাঠ কাটার জন্য ওঠে। ফলে সেও ভস্ম হয়। পরে কাশ্যপ-মন্ত্রে সে বৃক্ষের সাথে প্রাণ ফিরে পায় এবং সকলকে ঘটনাটি জানায়।

সব শুনে জন্মেজয় উত্তেজিত হয়ে হাত কচলাতে থাকেন এবং পিতার জন্য দুঃখে কাঁদতে থাকেন।
রাজা বলেন –কাশ্যপ মুনির আশ্চর্য ক্ষমতা, তিনি অবশ্যই পিতাকে বাঁচাতে পারতেন। তক্ষক ব্রাহ্মণের কথায় পিতাকে দংশায়, এটা সত্য ধর্ম। কিন্তু কোন কারণে সে কাশ্যপকে ফেরায়! আজ থেকে সে আমার শত্রু। কারণ লোকে ধন দিয়ে পরের উপকার করে। কিন্তু সে ধন দিয়ে আমার পিতার হত্যা করেছে।

উতঙ্ক যে কাজ করতে চায় সে কাজে জন্মেজয়ও সাহায্য করবেন স্থির হয়।
জন্মেজয় প্রতিজ্ঞা করলেন তার শত্রু নাগকুলের তিনি ধ্বংস করবেন।
এরপর সব ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতদের ডেকে নাগবংশ ধ্বংসের উপায় স্থির হতে থাকে। শেষে ঠিক হয় যে ভাবে রাজা পরীক্ষিত বিষের আগুনে জ্বলে মারা গেছেন, তেমনি নাগদেরও অগ্নিতে পোড়ান হবে।

সকলে সম্মত হয়ে রাজাকে বললেন –তুমি চন্দ্রবংশীয় রাজা। তোমার নামে পুরাণে মন্ত্র আছে। তুমিই সর্পসংহার যজ্ঞ করতে পার।

রাজা আনন্দিত হয়ে যজ্ঞের অনুমতি দিলেন। মন্ত্রীরা যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগল। দেশ দেশান্তর থেকে যজ্ঞের সামগ্রী আনা হল। জোতিষী বিচক্ষণ ছিলেন।
তিনি রাজাকে বললেন –ভবিষ্যৎ দেখে বোঝা যাচ্ছে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। এক ব্রাহ্মণ এতে বাধা দেবে।

শুনে রাজা জন্মেজয় নির্দেশ দিলেন –যজ্ঞকালে যজ্ঞস্থানে বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
...........................

জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞঃ

যজ্ঞে অভিলাষে রাজা জন্মেজয় রাশি রাশি ঘি, বস্ত্র, যব, ধান, কাঠ আনালেন। যজ্ঞের হোতা হলেন চন্ডভার্গব নামে এক মুনি। এছাড়া, অনেক সদাচার ব্রাহ্মণও এলেন।
আলাদা ভাবে এলেন – নারদ, ব্যাস, মারকন্ড, পিঙ্গল, উদ্দালক, শৌনক প্রমুখ।

ব্রাহ্মণরা বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে যজ্ঞের আগুন জ্বাললেন এবং নাগদের নাম করে যজ্ঞাহুতি দিতে লাগলেন।
আগুনের শিখা লক্‌লক্‌ করে আরো উর্দ্ধে উঠতে লাগলো, পর্বত বলে ভ্রম হতে লাগলো।
আকাশে মেঘ যেন নাগবৃষ্টি শুরু করল।
নগরে নগরে হাহাকার শুরু হল। প্রলয় সমুদ্র শব্দে সকলে উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলো।

আপন ইচ্ছায় সকলে আকাশে উঠে নানা বর্ণের নাগ অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিতে লাগলো। কেউ অশ্বের মত, কেউ বা উট বা হাতির মত আকৃতি যুক্ত। কারো বর্ণ কালো, কারো বা হলুদ, কেউ আবার সাদা। সকলে জলের মধ্যে, কোঠরে বা গর্তে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু মন্ত্রের টানে যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডেই এসে পড়ে। কারো একশ, দু’শ, পাঁচশ মাথা। পর্বতের মত বিপুল শরীর। মাথায় কেউ বা ল্যাজ জড়িয়ে, কেউ বা জিভ নাচায়, কেউ আবার কাতর হয়ে গড়াগড়ি যায়। হতাশায় কেউ বা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করতে করতে সকলে যজ্ঞকুন্ডে এসে পড়ে। চারদিক দুর্গন্ধে ভরে যায়। সকলে সম্পূরণ ঘটনা দেখে শুনে অবাক হয়।

যখন জন্মেজয় নাগকুল ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা করলেন, তখন তক্ষক গিয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিল। সকল কথা সে ইন্দ্রকে জানিয়ে আশ্রয় প্রার্থণা করল। ইন্দ্র তাকে অভয় দিলেন। তক্ষক নির্ভয়ে ইন্দ্রের কাছে রয়ে গেলেন।
এদিকে সব নাগেরা যজ্ঞে ধ্বংস হতে লাগল। এত সর্প নিধনে সর্পরাজ বাসুকি চিন্তিত হলেন।

তিনি চিন্তিত মনে বোন জরৎকারীর কাছে এসে বললেন –মায়ের শাপ শেষ পর্যন্ত সত্যি হল। সকল নাগকুল উচ্ছন্নে গেল। তোমার পুত্র আস্তীককে বাকি নাগদের রক্ষা করতে বল। আমার মনে হচ্ছে আমিও হয়ত রক্ষা পাব না!

এত শুনে জরৎকারী দুঃখিত হলেন।
তিনি পুত্র আস্তীককে ডেকে বললেন –মায়ের শাপে আমার ভাইদের এই দুর্দশা। আর সে কারণেই তোমার পিতা আমায় পেলেন। আমার ভাইরা তোমার মাতুল হন। আজ তুমিই তাদের একমাত্র রক্ষা করতে পার।

আস্তীক বললেন –মাতা, তুমি কি কারণে কাঁদছ! তুমি যে আজ্ঞা দেবে, তাই আমি পালন করবো।

জরৎকারী তখন সকল ঘটনা আস্তীককে জানালেন।
শেষে অনুরোধ করে বললেন –জন্মেজয়ের যজ্ঞে সব ভাইরা মারা যাচ্ছেন। তুমি তাদের এক্ষুনি রক্ষা কর।

আস্তীক মাকে বললেন –তুমি চিন্তা কর না, আমি মাতুলকুলকে রক্ষা করবো। মাতুল বাসুকিকে তুমি নির্ভয় হতে বল। আমি এক্ষুনি তাদের রক্ষায় যাত্রা করছি।

আস্তীক জন্মেজয়ের যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হলেন। কিন্তু দ্বারী তাকে প্রবেশ করতে দিল না।
তখন ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে আস্তীক বললেন –ব্রাহ্মণের পথ তুমি কোন সাহসে রোধ কর!

তার তেজ দেখে দ্বারী ভয় পেয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে তাকে প্রণাম করল।

আস্তীক গিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তার উচ্চ বেদমন্ত্রে যজ্ঞস্থল ধ্বনিত হল। সভার সকল ব্রাহ্মণদের তিনি প্রণাম জানালেন এবং রাজাকে আশির্বাদ দিলেন।
..........................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
..........................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৬
Click This Link
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×