somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৮

২৩ শে মে, ২০১৬ সকাল ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ....যুধিষ্ঠির পরামর্শের জন্য কৃষ্ণকে আহ্বান জানালেন....কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ রওনা দেন .. তারা ছদ্মবেশে গিরিব্রজে প্রবেশ করে জরাসন্ধকে যুদ্ধে আহ্বান জানান.]



জরাসন্ধের সহিত ভীমের যুদ্ধঃ

মগধরাজ জরাসন্ধের সাথে ভীমসেনের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হল।
তাদের দেখে মনে হল যেন গজরাজ-নক্র(কুমীর) যুদ্ধ করছে।
বৃত্তাসুর-শক্রের(দেবরাজ ইন্দ্রের) যুদ্ধের কথা মনে পরে অথবা রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা।
প্রথমে তারা গদা যুদ্ধ শুরু করল। কর্কশ বচনে, ভৎসনা করতে করতে উভয়ে উভয়ের উপর রাগে মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জরাসন্ধ বলে –ওরে পান্ডব, কোন খান্ডব বন থেকে মগধে এসেছিস মৃত্যুর টানে! নিয়তিই তোকে টেনে এনেছে, দেখ তোর কি করি!

শুনে গর্জন করতে করতে ভীম বলেন –তোমাকেই শমনের(যমের) মনে পরেছে। তার দূত হয়ে আমি এলাম তোমায় হত্যা করতে।

ক্রোধে বৃকোদর কদলীপাতার মত থর থর করে কাঁপতে থাকেন। দুজনে দ্রুত পরস্পরকে ঘুরে নিয়ে করাঘাত শুরু করে।
তাদের সাংঘাতিক গর্জনে সকলের কানে তালা লেগে গেল। দাঁত কড়মড় করে, নিশ্বাসে ঝড় তুলে তারা লড়তে লাগল। করে কর, পায়ে পা জড়িয়ে তারা পরস্পরকে টানতে থাকে। কখনও বা দৌড়ে এসে মাথা দিয়ে গুঁতো মারে, বুকে আঘাত করে। তাদের লাল চোখ, সারা শরীর দিয়ে যেন আগুন ছুটছে, নয়নানলে যেন দুজনে দুজনকে দহন করে। কখনও বা বজ্রমুষ্টিতে, উরুতে, কোমড়ে আঘাত হেনে ভূমিতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি দেয়। তাদের শরীরের ঘর্মে রণাঙ্গন ভিজে যায়, তবু সেই ধুলোকাদা মেখে তারা মল্লযুদ্ধ করতে থাকে। দুজনেই আঘাত পায়, রক্তে দেহ ভেসে যেতে থাকে। রাগে লম্ফঝম্ফ করে কাঁপতে কাঁপতে তবু তারা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তাদের পায়ের চাপে ভূমি কাঁপতে থাকে।
পুনরায় গদাযুদ্ধ শুরু হয়। গদার প্রহার হৃদয়ে, শিরে, পিঠে, বাহুতে পরতে থাকে। সকলে দেখে গদার আঘাতে অগ্নি ঝরে, কেউ কারো চেয়ে যেন ঊন(কম) নয়। দুজনে দুজনকে মাটিতে আছড়ে ফেলে আবার লাফিয়ে ওঠে। যেন দুই বারণ(হাতি) বারুণী(মদ) পান করে পর্বত মাঝে যুঝছে। বা দুই বৃষভ(ষাঁড়) সুরভি(স্বর্গের কামধেনু) লোভে গোষ্ঠে যুদ্ধ করছে।
কার্তিক মাসের প্রথমদিন এ যুদ্ধ শুরু হয়। অহর্নিশি অবিরাম দুজনে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এভাবে চতুর্দশ দিন কেটে গেল।

কাশীদাস বলেন এভাবে তারা কেবল বায়ু পান করে অবিশ্রাম যুদ্ধ করতে থাকল।
....................................



জরাসন্ধ-বধ ও রাজগণের কারামোচনঃ

অহর্নিশি চোদ্দদিন ক্রমাগত একভাবে যুদ্ধ করে চললেন ভীমসেন ও মগধরাজ জরাসন্ধ। অনাহারে, বিশ্রামহীন অবস্থায় লড়তে লড়তে বৃহদ্রথ কুমার জরাসন্ধ দুর্বল হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। অঙ্গ অচল হল, ধিরে ধিরে তার জ্ঞান লোপ পেল। তবু সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
পবনপুত্র ভীম মহাপরাক্রমী। তিনি এত যুদ্ধ করেও কোন কষ্ট বোধ করলেন না।

কৃষ্ণ ভীমকে ডেকে বলেন –কি দেখছ! এই সুযোগে শত্রুকে সংহার কর!

কৃষ্ণের কথা শুনে বৃকোদর ভীম ক্রোধের সাথে জরাসন্ধকে দুই পায়ে ভূমিতে ফেললেন। তারপর দুহাতে জরাসন্ধের দুই পা ধরে চক্রাকারে চারদিকে ঘোরাতে থাকেন। শতবার এভাবে ঘুড়িয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলে তার বুকে মহাবলে চেপে বসেন। জরাসন্ধের কন্ঠ জানু দিয়ে চেপে বুকে বজ্রমুষ্টি মারতে থাকেন। সেই গুরু গর্জনে ধরা কাঁপতে শুরু করে। রাজ্যের লোক সেই কম্পনে মৃতপ্রায় বোধ করল, ভয়ে তারা এমন চিৎকার করে যে কেউ কারো কথা বোঝে না। ভয়ে গর্ভবতী নারীর গর্ভ খসে। হাতি, ঘোড়া প্রমুখ জীবজন্তু দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। বৃকোদর ভীম সর্বশক্তি দিয়ে জরাসন্ধকে হত্যার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু সফল হন না।

আশ্চর্য হয়ে তিনি কৃষ্ণকে বলেন –আমি সর্বশক্তি দিয়ে একে হত্যার চেষ্টা করছি, কিন্তু এর দেখছি মরণ নেই!

যদুরায় কৃষ্ণ ভীমকে কাছে ডেকে বলেন –পূর্বে জরা একে সন্ধি করেছিল। সেই পথেই একে হত্যা করতে হবে।

এই বলে শ্রীনাথ কৃষ্ণ একটি তৃণ দুই করে ধরে চিরে দেখালেন। সমগ্র বিষয়টি বুঝে কুন্তীপুত্র ভীম হৃষ্ট মনে পুনরায় গর্জন করতে করতে জরাসন্ধের দিকে ধেয়ে যান। সিংহ যেমন মৃগকে অবহেলায় মারে, তেমনি বজ্রমুষ্টির প্রহারে জরাসন্ধকে মাটিতে ফেলে। জরাসন্ধের এক পা নিজের একপায়ে চেপে ধরে অন্য পা হাত দিয়ে হুঙ্কার মেরে টান দেন বৃকোদর। মাঝখান থেকে চিরে জরাসন্ধকে দু’টুকরো করা হল। এভাবে জন্মকালের রূপ ফিরে পেয়ে জরাসন্ধ প্রাণ হারায়।

জরাসন্ধ নিহত হলে নারায়ণ কৃষ্ণ হরষিত হলেন। আনন্দে তিন বীর পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন। মগধরাজের মৃত্যু সংবাদে নগরবাসী ভয় পেল।
জরাসন্ধের পুত্র সহদেব প্রচন্ড ভয় পেয়ে পাত্রমিত্র নিয়ে কম্পিত কলেবরে গোবিন্দের চরণে এসে করজোড়ে স্তব করে বলে –হে প্রভু, আপনার মহিমা অপার। আপনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, আদ্যাশক্তি, বৈশ্বানর(অগ্নি)। আপনিই আমার কাছে চন্দ্র, সূর্য, জলেশ্বর, বায়ু, শক্তি-বল, চরাচর। আমি অতি মূঢমতি(নির্বোধ)। চারিবেদ আপনার সঠিক স্বরূপ বর্ণনায় অক্ষম, আমার সেখানে কি বা সাধ্য! আমায় রক্ষা করুন, আশ্রয় দিন।
এইভাবে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব শ্রীকৃষ্ণের বহু স্তুতি করলে গদাধর ঈষৎ হেসে অভয় আশ্বাস দেন। তিনি সহদেবকে মগধের সিংহাসনে বসিয়ে বন্দিশালা থেকে সকল রাজাকে মুক্ত করেন। সকল রাজাদের নানা রত্ন, বসনভূষণ দেওয়া হল।

বন্দিরাজারা মুক্ত হয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করে বলে –সদয় হৃদয় আপনার, আপনি সেবকরঞ্জন।
দুর্বলের বল, আপনি গৌরব ভঞ্জন।
অনাথের আপনি নাথ।
আপনিই হিংসকের অরি(শত্রু)। ধর্মের পালন হেতু আজ আপনি মর্তে অবতীর্ণ।
আপনার গুণ বেদেরও অগোচর। কে আপনাকে বর্ণনা করবে!
শিব শঙ্করও আপনাকে যোগধ্যানে সকল সময় ধরতে পারেন না।
জরাসন্ধ আমাদের যত দুঃখ দিয়েছিল সব তা দূর হল আপনাকে দর্শন করে। আপনার অভয় পঙ্কজপদ দর্শন করে আজ নয়ন সার্থক হল। তার উপর আপনার মুখ নিসৃত অমৃত ভাষ্য শ্রবণে কর্ণ ধন্য হল। জরাসন্ধ আজই আমাদের বলি দিত, আপনার কৃপায় আমরা উদ্ধার পেলাম। আমরা ধন্য, প্রভু! আপনি আজ্ঞা করুন আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি।

গোবিন্দ সহাস্যে বলেন –আপনারা সকলে নিজ নিজ রাজ্যে গমন করুন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেন, আপনারা দয়া করে তাকে সাহায্য করবেন।
একথা শুনে সকল রাজারা অঙ্গীকার করে কৃষ্ণকে প্রণাম করে যে যার দেশে ফিরে গেল।

কৃষ্ণ-নারায়ণ জরাসন্ধের দিব্যরথ এনে ভীমার্জুনের সাথে তাতে আরোহণ করলেন। অপূর্ব সুন্দর সে রথটি পূর্বে পুরন্দর ইন্দ্রের ছিল। তিনি এটিতে চড়ে ঊনশত বার দানব দলন করেন। এই রথের ধ্বজা যোজন দুর থেকেও দেখা যায়। ইন্দ্রের থেকে এই রথটি বৃহদ্রথের পিতা মগধরাজ উপরিচর বসু উপহার পান। পরে সেটি বৃহদ্রথ ও তারপর জরাসন্ধের হয়। সে রথে তিন বীর আরোহণ করেন।

গোবিন্দ গরুড়কে স্মরণ করেন। খগরাজ এসে সে রথের ধ্বজায় বসার অনুমতি নিলেন। কৃষ্ণ স্বয়ং সে রথের সারথী হয়ে শঙ্খনাদ করে শীঘ্র ইন্দপ্রস্থে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার করে গোবিন্দ সকল ঘটনা জানালেন।
আনন্দে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গোবিন্দের পুজা-স্তব করলেন।
জরাসন্ধের রথ ও আরো অনেক অমূল্য রত্ন রাজা যুধিষ্ঠির হৃষ্ট মনে কৃষ্ণকে উপহার দিলেন। সেই রথে আরোহণ করে দেব দামোদর সকলের মেলানি(বিদায়কালীন সম্ভাষণ) নিয়ে দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

মহাভারতের এই পবিত্র পুণ্যকথা-গোবিন্দের লীলা, রথ, পান্ডব কথা।
সভাপর্বের সুধারস জরাসন্ধ বধে, কাশীরাম দাস কহেন আশ্রয় নিয়ে গোবিন্দের পদে।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৭ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ সকাল ১১:২৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×