somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪১

২৬ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন.......দ্রুপদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য রাজারা আসতে লাগলেন... কৃষ্ণদর্শনে লঙ্কার রাজা বিভীষণ উপস্থিত হলেন....কৃষ্ণের শত অনুরোধেও রাজাজ্ঞা বিনা দক্ষিণ ও পূর্ব দ্বার দিয়ে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল না... ভীমের সাজাপ্রাপ্ত কিছু রাজাকে কৃষ্ণ প্রাণদান করেন....কৃষ্ণ বিভীষণকে নিয়ে উত্তর ও পশ্চিম দ্বারেও প্রবেশানুমতি পেলেন না ]



সর্বলোক মূর্ছাঃ

জন্মেজয় রাজা পুনরায় বৈশম্পায়ন মুনিকে তারপর কি হল জানতে চাইলেন।

মুনি বলেন – শুনুন পরীক্ষিতের নন্দন তারপর কি হল।
বিভীষণকে নিয়ে নারায়ণ বসলেন। পদব্রজে চলে অনেক পরিশ্রম হয়েছিল। তার উপর চারদিকে মানুষজনের ঠেলাঠেলি। চারটি দ্বার অযুত ক্রোশ দূরত্ব-ঘুরে ঘুরে দুজনেই ক্লান্ত শ্রান্ত হলেন।

সিংহাসনে বসে তারা যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন মাদ্রীপুত্র সহদেব উপস্থিত হলেন। গোবিন্দকে দেখে তিনি প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ তাকে ডেকে সকল সমাচার নিতে লাগলেন।

কৃষ্ণ বলেন – দুতিনদিন রাজার সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই। হে সহদেব, সভার সংবাদ কি বল।

সহদেব বলেন – হে দামোদর, আপনি যাওয়ার পর সকল অমর দেবতারা এসে রাজদর্শন করছেন। এখন সকলে আপনার অপেক্ষায় আছেন। দেবরাজ ইন্দ্র আপনার দর্শনে উদগ্রীব।

একথা শুনে শ্রীবৎসলঞ্ছন কৃষ্ণ উঠে পরলেন। তার সাথে নিকষা নন্দন বিভীষণ চললেন।
সভা মাঝে দেব-নারায়ণ প্রবেশ করতেই সর্বজন উঠে দাড়ালেন।
সকলে বেদীর উপর অবস্থান করছিলেন। কৃষ্ণকে দেখা মাত্র সকলে কৃতাঞ্জলী করে কদলীর মত তার পদ প্রান্তে পরলেন-দেবতা, গন্ধর্ব, অপ্সর, কিন্নর, দেবঋষি, ব্রহ্মঋষি, রক্ষ, ক্ষগবর।
শত সোপানের উপর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অবস্থান করছিলেন।

পঞ্চশত সোপানে উঠে নারায়ণ বিশ্বরূপ প্রকাশ করলেন। সে রূপ দেখে সকলে অভিভূত।

পদ্মাসন ব্রহ্মা মুগ্ধ নয়নে সে রূপ পান করতে থাকেন।

দেব জনার্দন কৃষ্ণের সহস্র মস্তকে শোভে সহস্র নয়ন, সহস্র মুকুট মণি, কিরীটে সজ্জিত।
সহস্র শ্রবণ কর্ণে শোভে সহস্র কুন্ডল।
সহস্র নয়নে রবি সহস্রমণ্ডল।
সহস্র করে(হাতে) শোভে বিবিধ আয়ুধ(অস্ত্র)।
সহস্র চরণে শোভে শত শশধর(চাঁদ)। তাকে ঘিরে যেন সহস্র সহস্র সূর্যের উদয় হয়েছে।
শ্রীবৎস কৌস্তভমণি হৃদয়ে শোভা পাচ্ছে। গলায় দোলে আজানুলম্বিত বনমালা।
পীতাম্বর শোভে যেন মেঘেতে চপলা।
শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম আর শার্ঙ্গ ধনুতে(বিষ্ণুর ধনুক) শোভিত নানাবর্ণ মণিময় বিভূষিত তনু।
সহস্র সহস্র শম্ভু আছেন করজোড়ে। শত শত মুখে তারা স্তুতি-বাণী পড়ে।

সকলে চক্ষু মুদে বুকে হাত দিয়ে প্রণিপাত(ভুমিতে লুটিয়ে প্রণাম) করেন। এভাবে হঠাৎ বিশ্বপতির বিশ্বরূপ দর্শন করে সকলে অচেতন হলেন।
অন্তরীক্ষ থেকে বিধাতা ব্রহ্মা বিশ্বরূপ দর্শন করে নিমেষে অষ্ট আঁখি মুদলেন এবং নিজেকে পাসরে(ভুলে) করজোড়ে অজ্ঞান হয়ে ভুমিতে লোটালেন।
শিব যোগিরূপ ধারণ করে লুকিয়ে ছিলেন। তিনিও বিশ্বরূপ দেখে লুটিয়ে পরলেন।
ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, হুতাশন-অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য, খগ, নাগ, গ্রহ, রাশিরা-যে যেখানে ছিলেন সকলে সেখানেই অচেতন হয়ে পরে গেলেন।

দেব ভগবান জগন্নাথ যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে বলেন – হে মহারাজ, দেখুন পূর্বদিকে চতুর্মুখ ব্রহ্মা অষ্টভুজ যুড়ে লুটিয়ে পরেছেন। তার পিছনে প্রজাপতিরা কর্দম, কশ্যপ, দক্ষ আদি সকলে প্রণত।
ব্রহ্মার দক্ষিণে যোগী বেশে ত্রিলোচন পঞ্চানন মহেশ প্রণাম জানাচ্ছেন। কার্তিক, গণেশ তার পিছনে আছেন।
নিজগুণে আপনি সকলের নমস্কার পাচ্ছেন।
দেখুন প্রণত সহস্রলোচন ইন্দ্রের সহস্র নয়নে বারিধারা বয়ে যাচ্ছে।
দ্বাদশ আদিত্য, দেব শশধর, কুজ(মঙ্গল), বুধ, গুরু শুক্র, শনৈশ্চর(শনি), রাহু, কেতু, অগ্নি, তারা, অষ্ট বসু, মেঘ, বার, তিথি, যোগ, নক্ষত্রমণ্ডলী, দেবঋষি, ব্রহ্মঋষি, রাজঋষিরা সকলে আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন।
যাম্যভিতে(দক্ষিণদিকে) দেখুন মহারাজ মৃত্যু অধিপতি যম আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন।
পশ্চিমদিকে দেখুন জলেশ্বর বরুণদেব করজোড়ে ভুমিষ্ঠ। সিন্ধু সহ যত নদ, নদী, যত দানব, দৈত্য, অমর-বিবাদী(রাক্ষস), সহস্র মস্তক ধরে শেষ বিষধর নাগ সম্রাট তার সহস্র সোদর(সহদর) নিয়ে ভূমিতে পরে প্রণাম করছেন।
উত্তরে দেখুন যক্ষপ্রধান প্রণত। চারশ ধবল গন্ধর্ব অশ্ব নিয়ে দেখুন চিত্ররথ প্রণাম করছেন। গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, অপ্সর, অপ্সরী সকলে ভূমিতে লুতিয়ে আপনাকেই প্রণাম করছেন।
এদের বামদিকে দেখুন রাক্ষস শ্রেষ্ঠ, শ্রীরামের মিত্র ও রাবণের কনিষ্ঠভাই বিভীষণ আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন।
আরো দেখুন মহারাজ, ছয় পুত্র নিয়ে খগেশ্বর গরুড়ও প্রণত।
ভীষ্ম, দ্রোণ, জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, উগ্রসেন, যজ্ঞসেন, শল্য, মদ্রনাথ, বসুদেব, বাসুদেব আদি সকলে আজ আপনাইয় প্রণাম জানাচ্ছেন।
এই পৃথিবীতে আপনার সমতুল্য রাজা আর কেউ নেই। কে আপনার গুণের বর্ণনা করতে পারে! আপনার কীর্তি ও যশে ব্রহ্মান্ড পূর্ণ হল। আপনার এই গুণে আমিও আপনার বশ হয়েছি।

কৃষ্ণের বচন শুনে রাজা যুধিষ্ঠির ভয়ে আকুল হয়ে কাঁপতে লাগলেন। দুনয়ন দিয়ে অবিরাম বারিধারা ঝরতে থাকে। মুহুর্মুহু তিনি অচেতন হয়ে পরেন।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে গদগদ হয়ে যুধিষ্ঠির বলেন –হে প্রভু! আমার মত অকিঞ্চিত জনের প্রতি আপনার একি করুণা! আপনার চরণে আমার অসংখ্য প্রণাম।
হে ঘনশ্যাম আমার নিবেদন শুনুন।
তড়িত জড়িত পীত কৌষবাস(রেশমিবাস) সাজে শ্রীবৎস কৌস্তভমণি তব অঙ্গ মাঝে, শ্রবণে(কানে) পরশে চক্ষু পুণ্ডরীকপাত(শ্বেতপদ্মের মত যে আঁখি কর্ণকে স্পর্শ করে)। বিষ্ণু বিশ্বরূপ প্রভু আপনিই সর্বলোকের নাথ। সংসারে যত পুণ্যাত্মা জন আছেন সকলে তারা সদা আপনার চরণ বন্দনা করেন। সকলেই আপনার চরণে বন্দি হওয়ার আশা রাখেন। তাদের সামনে আমি অতি ক্ষুদ্র, কিছু প্রার্থনার ভরসা পাই না। তবু যদি দয়া করে আমায় বর দিতে চান তবে এই নিবেদন করি-সদা যেন আপনার চরণে স্থান পাই। পৃথিবীতে সবই অনিত্য, যেন বেদের বাজি-আপনিই কেবল সত্য। আপনার মায়া, আমার কিবা শক্তি বুঝি!

গোবিন্দ বলেন –রাজা সব ক্ষম আপনি। ভক্তিমূল্যেই আপনার কাছে বিক্রীত হয়েছি আমি। আমার নিয়মে আমার মধ্যেই ভক্তের অবস্থান। বলিকে সে কারণে আমি বড় ভক্ত মানি। আমার কাছে ব্রহ্মা, ইন্দ্রাদিও তার সমান নন।
দেখুন দেন-দানব, রক্ষ, যক্ষ সকলে আপনার চরণে আজ প্রণাম জানাচ্ছেন।
আমিও আজ প্রণাম জানাই ভক্তের চরণে।
এই বলে জগন্নাথ যুধিষ্ঠিরের সামনে ভুমিষ্ঠ হয়ে লুটিয়ে রাজার অনেক স্তুতি করেন।

এভাবে নারায়ণ নিজের মায়া বশে সবাইকে মোহিত করলেন। যারা তার এরূপ দেখল, তারাই পাসরণ(বিস্মিত) হল।

মাতুলপুত্র অচ্যুত কৃষ্ণের এরূপ দেখে অভিভূত যুধিষ্ঠির সহদেবকে বলেন –ওনাকে বল আমার আজ্ঞা এবার দয়া করে উঠে পরুন।

সহদেব কৃষ্ণকে বলেন –হে প্রভু নারায়ণ, দয়া করে উঠে পরুন। রাজা আজ্ঞা দিচ্ছেন। আমাদের প্রার্থনা স্বীকার করুন।

আজ্ঞা পেয়ে গোবিন্দ মাথা তুলে উঠলেন। বুকে হাত দিয়ে কৃষ্ণ বলেন –হে রাজন, বহুদিন হয়ে গেল দেব, খগ, নাগ প্রমুখেরা এখানে অবস্থান করছেন। এবার তাদের আজ্ঞা দিন, তারা সকলে নিজেদের যজ্ঞভাগ নিয়ে নিজ নিজ স্থানে ফিরে যান। ভারতবর্ষে যত রাজারা বাস করেন সকলে বহুদিন ধরে আপনার দর্শনের জন্য দ্বারে দ্বারে অপেক্ষমান। দেবতারা বিদায় নিলে তবেই তারা রাজ দর্শনের সুযোগ পাবেন।
নাগরাজ বিষধর শেষরাজ সাতদিন ধরে যজ্ঞস্থানে আছেন। অন্ন-জলহীন হয়ে সখা অর্জুন ধরণীর ভার সামলাচ্ছে। তার উপর বড়ই অবিচার হচ্ছে।
একথা শুনে শেষনাগ লজ্জায় মলিন হলেন।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আজ্ঞা দিলেন সকলকে তাদের যজ্ঞভাগ দানের।
যে যার প্রসাদ গ্রহণ করে স্ব স্ব দেশে গমন করলেন।

কাশীরাম দাস পয়ার ছন্দে এই সকল কথা রচনা করলেন, যা শ্রবণে সকলের পাপ সংহার হয়।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪০ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৫৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×