somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতীক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস: একটি নিরপেক্ষধর্মী বিশ্লেষণ

১০ ই জুন, ২০১২ সকাল ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
বারট্রান্ড রাসেলের মতে মানুষ যেদিন পশুপাখিকে বশ মানাতে শিখল আসলে সেদিন থেকেই সে তার স্বজাতিকেও বশ মানাতে শিখল, আর তার দাস মনোবৃত্তির গোড়াপত্তন তখন থেকেই। শুধু জীবিকা নয়, আত্মরক্ষার তাগিদ, কর্তৃত্বের আকাঙ্খা, যুদ্ধের যতোসব নিয়ামক। যেকোন যুদ্ধেরই শেষ ফলাফল ধ্বংস। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যুদ্ধে আসলে কেউ জিতে না। কিন্তু তারপরও মানুষ যুদ্ধ করে, ধ্বংস করে, ধ্বংস হয়। এসব নিয়ে ইতিহাস রচনা হয়, আর তাতে বিজেতাই থাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভিলেন। তবে ব্যতিক্রমও হয়! ইতিহাসবিদ তার বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দৃষ্টির সীমাকে সবসময় অতিক্রম করতে পারে না। ফলে তার বর্ণনাকৃত কাহিনী অনেক সময় শুদ্ধতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হিমশিম খায়। তবে ইতিহাসের বর্ণনা একজায়গায় থেমেও থাকে না। বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের সুবিধার্থে একে পরিমার্জন করে উপস্থাপন করে, আবার আমজনতাও অনেক সময় গোগ্রাসে গিলেও ফেলে। তথ্যের এই অবাধ প্রবাহেও যাচাই-বাছাই এর কাজটা সবসময় করা হয়ে উঠে না।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা নিয়েও যেন একধরণের ধোয়াটে ভাব লক্ষ্য করা যায়। অন্তর্জালে অনেকেই এ নিয়ে লিখছে, যার যার অবস্থান থেকে। যারা লিখছে তাদের সবাইকে সেই পরিমার্জনের দোষে দুষ্ট বলাটা হয়ত ঠিক না, হয়ত পরিস্থিতির স্বীকার! কিন্তু কিছু সুযোগ-সন্ধানীর উদ্দেশ্যকে বুঝতে হলে নালন্দার ইতিহাসের দিকে আর একটু চোখ বুলাতে হবে। সেই আর একটু অনুসন্ধান করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

কথিত যে বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক খৃষ্টপূর্ব ৩০০তে নালন্দাতে প্রথম বৌদ্ধ উপাসনালয় গড়েন যা পরে বৌদ্ধ গবেষণার ভিত গড়ে, যদিও এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। তবে এব্যাপারে বেশীরভাগ ঐতিহাসিকই একমত যে রাজা কুমারগুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা মাগ্ধাতে ৪২৭ খৃষ্টাব্দে নালন্দা প্রতিষ্ঠা পায়। গুপ্ত রাজারা সবসময়ই বৌদ্ধদের প্রতি ছিলেন উদার ও এর পৃষ্ঠপোষক। গুপ্ত বংশের রাজা নরসীমাগুপ্ত একসময় রাজ্য ছেড়ে ভিক্ষুও হন।

নালন্দাকে নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই ছিল। সেই সময়ে ওখানে ছিল ছাত্রদের থাকার বন্দোবস্ত, শ্রেণীকক্ষ, নয়নাভিরাম খাল ও আরো অনেক সুবিধাদী। ২০০০ শিক্ষক ও ১০,০০০ এর মত ছাত্র ছিল। তবে এ সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ আছে। সারাবিশ্ব থেকেই ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত, তার মধ্যে ছিল কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পার্শিয়া এবং তুরস্ক। নালন্দা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের গবেষণা ও ধর্মচর্চার জন্য নির্মিত হলেও ওখানে পড়ানো হতো হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যকরণ, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের আরো অনেক বিষয়।



নালন্দা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। যতদূর জানা যায় সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। উল্লেখ্য মিহিরকুলার নেতৃত্ব হানরা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পূণর্গঠন করেন। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়'র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, তিনি সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। উল্লেখ্য রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরুক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড় একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মাগ্ধায় প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে । হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন (চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেন):

Sasanka-raja,being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka's hatred towards Buddhism. [6]


হর্ষবর্ধন পরে রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও শেষপর্যন্ত বাংলার কিয়দংশ করায়ত্ত করেন। তিনি নালন্দাকে পূনর্গঠনে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখেন।

তৃ্তীয়বার নালন্দা ধ্বংস হয় তূর্কী যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজী দ্বারা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে। বখতিয়ার খিলজীর সময়ে নালন্দার অনেক ক্ষতিসাধন হয়। অনেক ভিক্ষু নিহত হন, আর যারা বেঁচে থাকেন তাদের অধিকাংশই পালিয়ে যান। ক্ষয়ীষ্ণু বৌদ্ধধর্ম খিলজীদের কাছে কোন চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসেনি, তারপরও খিলজী নির্মমভাবে অনেক ভিক্ষুকে হত্যা ও নালন্দাকে ধ্বংস করেন!

(২)
বখতিয়ার খিলজির বিহার অভিযানের কাহিনী পাওয়ার একমাত্র উৎস হল ঐতিহাসিক মিনহাজ এর ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ বই। তৎকালীন আর কোন ঐতিহাসিকের লেখায় খিলজী দ্বারা নালন্দার ধ্বংসের কাহিনী স্থান পায়নি! খুব অবাক ব্যাপার বৈ কি! নালন্দার ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি তৎকালীন ঐতিহাসিকদের এ অবহেলা ঘটনাটিকে গুরুত্বহীন বলেই প্রতীয়মান করে। অবশ্য এর কারণও ছিল। রাজাদের মধ্যে অন্তর্কলহ, শত্রুতা, হত্যা ও উপসনালয় ধ্বংস সেসময় খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল না। মিনহাজের ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’র মতে নালন্দাতে কোন কার্যকর সামরিক শক্তির উপস্থিতি ছিল না। চারপাশ ঘেরা প্রাচীরের অভ্যন্তরেই বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল, আর এর প্রতিরক্ষায় যেসব অস্ত্রধারী ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল “মুন্ডিত-মস্তক” শ্রমন (বৌদ্ধ সন্ন্যাসী), কিন্তু খিলজীর সৈন্যরা তাদের হত্যা করেছিল ভুলবশতঃ, ব্রাহ্মণ রাজপূত মনে করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ৭০০ খৃষ্টাব্দের পরপরই ভারত ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়, আর এগুলোর নেতৃত্ব ধীরে চলে যায় ব্রাহ্মণ রাজপূতদের কাছে। রাজপূতদের এই শাসনকালকে অনেক ঐতিহাসিকই ভারতবর্ষের অন্ধকার যুগ বলেই অভিহিত করেন- সতীদাহ, বর্ণপ্রথা, অন্যান্য ধর্ম বিশেষ করে বৌদ্ধদের প্রতি নির্মম অত্যাচার ইত্যাদির যথেচ্ছাচার প্রয়োগের কারণে। খিলজীদের ভারত আক্রমণে এই রাজপূতরাই প্রতিরোধের ভূমিকা নেয়। আর ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে তূর্কী খিলজীদের অজ্ঞতা নিরপরাধ ভিক্ষু হত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। খিলজীরা আরেকটা ভুল করেছিল, তা হল, তারা ভেবেছিল চারপাশ দিয়ে ঘেরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি দূর্গ।

নালন্দার লাইব্রেরীটির ধ্বংস সভ্যতার জন্য ক্ষতিই বলতে হবে। তবে, পৃথিবীর ইতিহাসে লাইব্রেরী ধ্বংসের দিক থেকে নালন্দা প্রথম বা একমাত্র নয়। খৃষ্টের জন্মের আগে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী ধবংস হয় বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সীজার দ্বারা, মোঙ্গল দখলদারদের দ্বারা ধবংস হয় বাগদাদের বিখ্যাত সেই লাইব্রেরী ‘হাউস অব উইসডম’। মধ্যযুগে অন্ধকার ইউরোপে আলোকবর্তীতা হয়ে থাকা গ্রানাডার বিখ্যাত লাইব্রেরীটি ধ্বংস হয় কার্ডিন্যাল সিসনেরস এর নেতৃত্বাধীন স্প্যানিশ খৃষ্টান বাহিনী দ্বারা। এর বাইরেও আছে আরো অনেক উদাহরণ।

তবে নালন্দা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয় বলে যে দাবী করা হয় তা সঠিক নয়, নালন্দার একটি বড় অংশকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কারণ ১২৩৪ সালে তিব্বতীয় ভিক্ষু ধর্মাসভামিন নালন্দাতে যখন ভ্রমণ করেন তখন সেখানে কিছু পণ্ডিত ও ভিক্ষু মহাপাণ্ডিত রাহুলাস্রিভাদ্রার তত্ত্বাবধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। পনেরশ শতকের দিকে এটি প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দুইবার নালন্দাকে পুনরুদ্ধার করলেও তৃতীয়বার আর তাকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারণ গুপ্ত বা পাল রাজাদের মতো সেইরকম আর কোন শাসক অবশিষ্ট ছিল না যারা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবার পুনর্গঠন করবেন। তাছাড়া ছিল বর্ণহিন্দু (ব্রাহ্মণ) ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজাদের বৌদ্ধদের প্রতি নির্মম অত্যাচার ও এর ফলে ভারতবর্ষ থেকে তাদের ব্যাপক হারে দেশত্যাগ।

নালন্দার অধঃপতনে আরেকটি কারণ হল এর আমলাতান্ত্রিকতা, দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। ভারতীয় পার্লামেন্টের সংসদ শশী থারুর হিন্দু অনলাইনে লেখা তার আর্টিকলে সে সময়ের বাস্তব চিত্রই এঁকেছেন:

This time there was to be no reconstruction: not only were there no equivalent of the Gupta kings or Harsha to rebuild it, but the university had already been decayed from within by the cancer of corruption on the part of its administrators and by declining enthusiasm for Buddhist-led learning. If we are to rebuild it 800 years later, we will need not just money but the will to excellence, not just a physical plant but a determined spirit.


রাজাদের আনুকূল্যের অভাব, ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, দূর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা ও অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা খুব প্রতিকূল পরিবেশে ছিল বৌদ্ধরা। তাছাড়া বৌদ্ধরা জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে ধীরে ধীরে তান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকায়, তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল খুব কম। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতীতে নিজেদের রক্ষা করতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। হিন্দুদের মতো তাদের কোন যোদ্ধাদল ছিল না, ফলে শাসকশ্রেণীর কাছে তারা তাদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, নালন্দার আশেপাশের বাসিন্দারাও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল না। কিন্তু এর খরচ বহন করা হত আশেপাশের জনগণের খাজনা দ্বারা। যেমন, রাজা হর্ষবর্ধন সে সময়ে ১০০ গ্রাম থেকে যে খাজনা পেতেন তা নালন্দাতে দান করতেন। ফলে সাধারণ অধিবাসীদের এই নালন্দা থেকে উপকৃত হবারও কোন উপায় ছিল না।

হরপ্পান সভ্যতার সময় থেকেই খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ সাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সূচনা হয়। তবে খৃষ্টপূর্ব ৬০০ সাল থেকেই এর প্রসার ঘটতে থাকে বিশেষত ময়ূরা সাম্রাজ্যের সময় থেকেই। পশ্চিম ও দূরপ্রাচ্য থেকে ব্যাবসার নিমিত্তে বিভিন্ন দল আসতে থাকে। রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর খৃষ্টপূর্ব ৩১ সাল থেকে ভারত ও রোমের মাঝে ব্যবসার প্রসার ঘটে ব্যাপকভাবে। পৌত্তলিক আরবদের সাথে ভারতবর্ষের ব্যবসায়ীক যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। আরবদের সাথে ব্যবসার প্রসার ঘটে মূলত নৌপথে। ইসলাম পরবর্তী সময়েও আরবদের সাথে ভারতবর্ষের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের কথা জানা যায়। তবে আরবদের দ্বারা ভারতবর্ষে প্রথম অভিযান চালনা করা হয় সিন্ধে। রাজা দাহির মুসলিম মহিলা ও শিশুকে বন্দী করেন, যাদেরকে ছাড়ানোর অনুরোধ উপেক্ষা করায় মুহম্মদ বিন কাশিম রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযান চালান, তাকে পরাজিত ও নিহত করেন (৭১১-৭১২ খৃষ্টাব্দ)। দাহিরের মৃত্যুর পর তার বউ রাণী লাদীকে বিয়েও করেন। এরপর প্রথমবারের মতো সিন্ধ উমাইয়াদ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। আরব মুসলিমরা সিন্ধ দখল করার পর সে অঞ্চলে ইসলামেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। আরব মুসলিমদের অভিযানের পরও ১০০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিকই ছিল। তবে ১০০০ সালের পর যাযাবর তূর্ক-আফগানদের ভারতবর্ষ আক্রমণের সাথে সাথে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। আরবদের সাথে তুলনা করলে তূর্ক-আফগানদের ভারতবর্ষ আক্রমণ তুলনামূলকভাবে আক্রমণাত্নক বলেই মনে হবে। আরবরা যেখানে স্থানীয়দের প্রতি সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে তূর্ক-আফগানরা ছিল ব্যতিক্রম।

আরবরা ইরানের সাসানিয়ানদের পরাজিত করার পর মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মোঙ্গল ও অন্যান্য বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ইসলামী সাম্রাজ্যকে নিরাপত্তা দিতে তারা মধ্য এশিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়। নতুন এই ধর্মান্তরিত যোদ্ধারাই পরে ইসলামী সাম্রাজ্যকে আরো পূর্বে প্রসারিত করতে ভূমিকা রাখে। এমনই একজন তূর্ক আফগান সম্রাট হলেন গজনীর মাহমুদ। তিনি ভারতীয়দের বিশাল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে ঝটিকা আক্রমণ বেশী চালাতেন। তিনি রাজপূতদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেন যার প্রধান লক্ষ্য ছিল তার নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষা করা। তার শাসনামলে রাজ্যবিস্তারের প্রতি সামান্যই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, আর ধর্মবিস্তারকে উপলক্ষ্য ধরাটা যৌক্তিক মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক হবে। অবশ্য পরে গজনীর আরেক শাসক মাহমুদ ঘোরী তার রাজ্যের সীমানা বাড়াতে মনস্থ করেন ও পৃথ্বীরাজের রাজপূত সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেন। বখতিয়ার খিলজী ছিলেন সম্রাট মাহমুদ ঘোরীর একজন সেনাপতি।

ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে মুসলিমরা অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও সেসময় ভারতে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রায় সবই সিন্ধ এর, যার শাসক ছিল আরব মুসলিম। প্রথম দিকে তুর্ক-আফগানরা ধর্মান্তরিতকরণে কোন ভূমিকা রেখেছেন বলে জানা যায় না। তুর্ক-আফগানরা ইসলাম গ্রহণ করলেও নতুন এই ধর্মের ব্যাপারে তাদের বোঝার ক্ষমতা প্রথমদিকে ছিল সীমিত। আরবরা ধর্মীয় কারণে তুলনামূলকভাবে ছিল বেশী ন্যায়পরায়ণ, তাছাড়া ব্যবসায়িক যোগাযোগের কারণে এ উপমহাদেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল ও এক ধরণের সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতো। সেখানে তূর্ক-আফগানরা ছিল তুলনামূলকভাবে উদ্ধত ও ধ্বংসাত্নক। অবশ্য প্রথম দিকের এই বৈরী দৃষ্টিভংগী তারা অনেকটাই ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে ফেলে।

উপসংহারঃ
নালন্দার ধ্বংস হয় সর্বোমোট তিনবার, এর মধ্যে প্রথমবার মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী বাংলার শাসক শশাঙ্ক দ্বারা ও শেষবার তূর্কীযোদ্ধা বখতিয়ার খিলজী দ্বারা। নালন্দাকে প্রথম দুইবার ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড় করানো গেলেও তৃতীয়বার সম্ভব হয়নি গুপ্ত ও পাল রাজাদের মতো পৃষ্ঠপোষক না থাকায়। দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগ ও বৌদ্ধদের জ্ঞানার্জনের চেয়ে তান্ত্রিকতার প্রসারও এর জন্য দায়ী। তূর্কী সেনাপতি খিলজী ভারতবর্ষ আক্রমণের কারণ রাজ্য জয়, ধর্ম নয় এবং প্রথম দিকে ধর্মের প্রসারে তারা কোন ভূমিকাই রাখেনি। তাছাড়া, তূর্ক-আফগানরা যে কেবল হিন্দুদের সাথে যুদ্ধ করেছে তাই না, সে একই রকম ব্যবহার করেছে অন্যান্য মুসলিম শাসকদের সাথেও। খিলজীর নালন্দা আক্রমণের লক্ষ্য প্রতিরোধকারী ব্রাহ্মণ রাজপূতেরা, ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুরা নয়। কিন্তু খিলজী দূর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করেন ভুলবশতঃ, ব্রাহ্মণ মনে করে। মিনহাজের ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ ছাড়া, প্রথম দিকের তূর্ক-আফগানদের এই অভিযানকে সমালোচনা করে লেখা ভারতীয়দের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কারণ সেসময়ে হিন্দুদের নিজেদের বিভিন্ন গোত্র ও রাজাদের মধ্যে বিবাদেও হত্যা ও মন্দির ধ্বংস ছিল স্বাভাবিক ঘটনা, যেখানে খিলজীর নালন্দা ধ্বংস আলাদা গুরুত্ব বহন করেনি।

শেষ কথাঃ
মজার ব্যাপার হল তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসবিদদের কাছে নালন্দার ধ্বংস বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন না করলেও এখন তারা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে শেষ করে যাচ্ছে। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে নাস্তিকতার ভেক ধরে থাকা কিছু বর্ণহিন্দু ও মস্তক বিক্রি করে দেয়া কিছু মুসলিম নামধারী সুশীল। আর এর কল্যাণেই ব্লগে ব্লগে চলছে বিদ্বেষের বিষ। আজ যেন তাদের সব দরদ নালন্দা ও সেই সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি। ফলাও করেই তারা প্রচার করে থাকে নালন্দার ধ্বংস মানেই বখতিয়ার খিলজী নামের এক মুসলিম সেনাপতি, কিন্তু বেমালুম চেপে যায়, প্রথম দুইবারের ধ্বংসের কথা, যাদের মধ্যে একজন বাঙলার বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শাসক রাজা শশাঙ্ক। তারা চেপে যায়, সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রাহ্মণ রাজপূতদের ক্ষমতায় আসার পর বৌদ্ধদের প্রতি অবর্ণনীয় অত্যাচারের ফলে তাদের ঢালাওভাবে দেশত্যাগের কথা।

সূত্রঃ
[১] India Condensed, 5000 Years of History & Culture, Anjana Motihar Chandra
[২] Education in Ancient India, Scharfe, Hartmut; Publisher: Brill Academic Publishers
[৩] India: The Ancient Past, A history of the Indian sub-continent from 7000 BC to 1200 AD
[৪] Glimpses of World History: Jawaharlal Nehru, Oxford University Press
[৫] ভারতে মুসলিম শাসনের বুনিয়াদ; মূলঃ এবিএম হাবিবুল্লাহ, ভাষান্তরঃ লতিফুর রহমান, বাংলা একাডেমী ঢাকা,
[৬] Click This Link
[৭] Click This Link books/unpublished_manuscripts/historical_interaction/pt3/history_cultures_20.html
[৮] Click This Link
[৯] Click This Link
[১০] বাংলাপিডিয়া
[১১] Click This Link
[১২] Click This Link
[১৩] Click This Link
[১৪] Click This Link


নোটঃ লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি সেখানে 'শামস' নামে লিখে থাকি।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ দুপুর ১:০৭
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×