চিন্তক লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে জেতে তখন একাই জেতে। যখন হারে তখন গোটা বাংলাদেশ হারে। আহমদ ছফা আওয়ামী লীগ রাজনীতির ভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন না। আরো বড় অর্থে বলা যায় তিনি কখনই কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নিয়ে দাঁড়াতেন না। তিনি দাঁড়াতেন মানুষের পক্ষে। সেই পক্ষপাত যে কোনো সময় যেকোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বা পক্ষে চলে যেতে পারে। তার এই বিচক্ষণতা জানান দেয়, বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগকেই নীতির মানদণ্ডে বিশ্লেষণ করা যায়। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের সামনে সমমানের রাজনৈতিক দল নেই বলেই নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করার মানসিকতা দলটির ভেতর নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগের ভেতর বহুমতের মানুষজন আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু দলীয়ভাবে দলটি বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক-অনুশীলন করা থেকে বিরত থাকতেই পছন্দ করে বেশি। একইভাবে বিএনপিকেও বলা যায়, বহুমতের পথ এসে ক্ষমতারকেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়েছে - যেখানে কেবল ক্ষমতায়ন হওয়াই লক্ষ্য। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি হলো, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা। বিএনপি’র সূচনাকাল যেমনই হোক বড় দল বলতে এই দুটি দলকেই বোঝায়। বাকীরা এদের ঘাড়ে সোয়ার হয়ে ক্ষমতায় যেতে চান বা ক্ষমতার সিড়ি হিসেবে দলদুটোকে ব্যবহার করেন।
প্রসঙ্গ ছিল আওয়ামী ঘরানার রাজনীতি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন হলো অসম্প্রদায়িক চেতনা (এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হয়নি)। কাগজে-কলমে এসব বিষয় খুব চাউর হলেও ব্যক্তিগজীবনে এই দলের নেতাকর্মীরাই সবচে বেশি ভিন্নধর্মাবম্বিদের সম্পত্তি (স্বাধীনতার পর) দখল করেছেন। কেবল একটি স্নোগান ‘অসম্প্রদায়িক’ শব্দ কত শক্তিশালী হতে পারে সেটা আওয়ামী লীগ বুঝলেও এর অনুশীলন (ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে) কত বেগবান হতে পারে তা তারা কোনোদিন উপলব্ধি করেননি। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই একটি মাত্র সেøাগান ‘অসম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির জন্য আওয়ামী লীগকে এখনও বিশ্বাস করেন যে দলটি সর্বমতের এবং সর্বধর্মের দেখভাল করার জন্য একমাত্র উপায়।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বলেই সবধরণের মিডিয়া কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগেরই পক্ষপাত হয়ে কথা বলে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে দলটি এই সুবিধাকে ইতিবাচকভাবে কোনো দিনই ব্যবহার বা কাজে লাগাতে পারেনি। এটি আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একইভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-নাট্যকার-শিল্পী-গীতিকাররা কখনও সরাসরি কখনও পরোক্ষভাবে দলটিকে সমর্থন করে যান। আওয়ামী লীগ এটিকেও রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করলেও এসব ব্যক্তি বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা এমন একটি ভাব করে থাকেন যেনো তাদের আর কোথাও যাবারও জায়গা নেই। এটি আওয়ামী লীগও বুঝে। এ ধরণের রাজনৈতিক আচরণের ফলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট ন্যুব্জ হয়ে যায়। দুই পক্ষেরই এতে ক্ষতি সাধিত হয়। দুপক্ষই এক সময় গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। কারণ সময় তো সব সময় একই স্রোতে প্রবাহিত হয় না।
আমাদের মূল সমস্যা রাজনৈতিক আচরণ। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কোনো সমস্যার মোকাবেলা করতে আমরা প্রায়ই অপারগ হয়ে পড়ি। আমরা জানি আমাদের প্রত্যেক দলের ভেতর প্রচুর ভুলত্রুটির মিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু একে পরিষ্কার করার মানসিকতাই বলে দেবে আমি বা আমরা ভবিষ্যত নিয়ে অনুকম্পিত কি না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা, এই রাজনৈতিক আচরণ, মিডিয়া আচরণ, লেখক গোষ্ঠীর পৈরবি আচরণ জাতি হিসেবে আমাদের ক্রমশই ক্ষুদ্র করে তুলছে। আমরা জেনেও না জানার ভান করে বসে থাকি। প্রতিটি মূল্যবান সময় আমাদের এ্যনার্জেটিক মানসকিতাকে ক্ষুন্ন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাঙালি জাতি বলে আমাদের শব্দভান্ডার থেকে প্রচুর সাহসী শব্দ উচ্চারণ করতে পারি কিন্তু অনুশীলনে আমরা খুবই পিছিয়ে পড়া এক জাতি - নৃ-ইতিহাস অনেক কিছু বললেও সমসামিয়ককালের পথচলা আমাদের অনেক ভঙুরভাবে অগ্রসর হতে হচ্ছে। ‘অগ্রস’র শব্দ এক্ষেত্রেও খুবই বেমানান। তবু উচ্চারণ করতে হলো। যেভাবে আমরা পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে আত্মসম্মানের খাতিরে অনুন্নত না বলে উন্নয়নশীল দেশ বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি।
আপাতত আমরা এধরণের তৃপ্তিতেই ভাসমান।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১:২৪