বেশ কয়েক বছর ধরে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করছি। আসলে আল্লাহ রব্বুল য়ালামীনের কাছ থেকে আমি যে ইতিকাফের সুযোগ পেয়েছি, এর জন্য আমি নিজেই মাঝে মাঝে হতভম্ব ও অস্থির হয়ে যাই। আমাদের মসজিদের খতিব সাহেব বলেন, আল্লাহর জন্য একটা সিজদাও যদি কেউ দেয়, তবে তার জন্যও মালিকের পূর্বানুমতি লাগে। দুনিয়াতেও এর মেছাল আছে। কেউ কি ইচ্ছে করলেই প্রসিডেণ্টের খাস কামরায় ঢুকতে পার? এমনকি প্রেসিডেণ্ট ভবনে ঢুকতেও অনুমতি লাগে। যদি গায়ের জোরেই আল্লাহর ঘর মসজিদে ঢুকা যেত. তবে সেখানে হয়তো গরীবদের কোনই স্থান হতো না। মসজিদের সামনের কাতারগুলো ভরা থাকত দেশের ক্ষমতাবান ও ধনাঢ্য লোক, এমনকি নাস্তিকদের দ্বারা। যদিও মুনাফিকরা সব যুগেই থাকে। আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লামের একজন বিশিষ্ট সাহাবী, ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জেন হযরত বেলাল (রা) এজন্য আল্লাহ রব্বুল য়ালামীনের প্রতি খুব খুশি ও সন্তুষ্ট থাকতেন যে হেদায়েত আল্লাহর হাতে। হেদায়েত আল্লাহর হাতে বলেই না তার মতো একজন কৃষ্ণবর্ণের গোলাম হেদায়েত পেয়েছে। হেদায়েত যদি আল্লাহতায়ালা মানুষের হাতে ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো দুনিয়ার লাইনে মালওয়ালা, জ্ঞানওয়ালা, প্রভাব-প্রতিপত্তিওয়ালা আবু জাহেল, আবু লাহাবরাই হেদায়েত পেত। দুনিয়ার সম্পদ যেমন তারা ক্ষমতার দাপটে হস্তগত করে, আখিরাতের সম্পদও তারা ক্ষমতার জোরে হস্তগত করত।
যাহোক আল্লাহর কাছে অনেক বেশি শুকরিয়া আদায় করতে চাই যে, তিনি আমার মতো একজন নাদান, নালায়েককে তাঁর ঘর মসজিদে ঢুকতে দেন। "এক গোলাম মসজিদে ঢুকেছে। মসজিদের জানালা দিয়ে তার মালিক তাকে ডাকছে এই বলে, কে তোমাকে এতক্ষন মসজিদে বসিয়ে রেখেছে? গোলাম উত্তর দেয়, যে মালিক তোমাকে মসজিদের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, ঐ মহামহিম বাদশাহ আমাকে ভিতরে বসিয়ে রেখেছেন।"
তো এবারও ইচ্ছা আছে ইতিকাফ করার। আলহামদুলিল্লাহ, নফল ইতিকাফতো প্রতিবার মসজিদে ঢুকার সময় নিয়্যত করলেই হয়। বছরের প্রতিদিনই করা যায়। যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ। কিন্তু রমজানের সুন্নত ইতিকাফের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বিশ রমজান শেষে ইফতারের আগে আগে মদজিদে ঢুকতে হয়। তখন থেকে শুরু। একেবারে সমস্ত রোযা শেষ হওয়ার পর মাগরিব নামাজ পড়ে বের হতে হয়। খাওয়া দাওয়া সব মসজিদে। পায়খানা প্রস্রাবের জরূরত ছাড়া বের হওয়া যায় না। শুধু ফরজ গোসল করা যায়। কেবলমাত্র জামে মসজিদ যেখানে জুমার নামাজ হয় সেখানে ইতিকাফ করতে হয়। মহিলারা ঘরের এক কোণে করবে। আরো নিয়মকানুন জানার জন্য য়ালেম উলামাদের সাথে যোগাযোগ করুন। নিজে নিজে কেবল বই পড়ে জানলে জানা অপূর্ণ থাকবে। বইও পড়তে হবে, য়ালেমদের থেকে জিজ্ঞাসার মাধ্যমেও জানতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ, প্রতিবছর ইতিকাফের জন্য এমন সব ঝামেলা থেকে আল্লাহ রব্বুল য়ালামীন আমাকে মুক্ত করেন, যা আমার কল্পনায় বা মেধায় ধরে না। প্রতিবারই আমি ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা থেকে আল্লাহ রব্বুল য়ালামীন আমাকে মুক্ত করেন। সেদিন স্যার বলছেন, জহির তোমার না রমজানের শেষ দশদিন ছুটি দরকার। আশরাফুলেরও সামনে পরীক্ষা আছে। ওরও ছুটি দরকার। তুমি ওর সাথে বসে ডিউটিগুলো ঠিক করে নিও। আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রব্বুল য়ালামীনকে বললাম, হে পরওয়ারদেগার, এজন্যইতো তোমাকে আমি এত ভালোবাসি। আসলে তা নয় বোধহয়। তুমিই আমাকে বেশি ভালোবাস হে রব।
সিয়াম শুরু হচ্ছে। একদিকে সাওমের আনন্দ, অন্যদিকে ইতিকাফের অপেক্ষার আনন্দ। সুবহানাল্লাহ। মসজিদে কাটাব সিয়ামের শেষ ১০ টা দিন। অন্তত চোখের হেফাজত হবে, কানের হেফাজত হবে। জাহান্নামের উপযুক্ত যে চোখ ও কান, জান্নাতের শান্তির পরশে তা হবে শীতল। মসজিদতো জান্নাতের বাগান। জান্নাতের বাগানে থাকেনা কোন পেরেশানী। হয় দিলের হেফাজত। এজন্য বন্ধুরা আপনারা হয়তো অনুভব করেছেন মসজিদে যে যতক্ষণ অবস্থান করেন হৃদয় থাকে শান্ত, চিন্তামুক্ত। কারণ জান্নাতের বাগানেতো উদ্বিগ্নতা নেই। একবার আবেগের আতিশয্যে এক বুযুর্গ ব্যক্তি বলছিলেন, কেউ যদি মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে, আমি জান্নাতে আছি, তাহলে সে ঠিকই বলেছে। এছাড়া আল্লাহর রসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লামের একটা হাদীসও আছে এরূপ যে, "তোমরা যখন জান্নাতের বাগানসমূহের নিকট দিয়ে যাও তখন সেখানে খুব বিচরণ কর। কেহ আরজ করিল, ইয়া রসূলুল্লাহ! জান্নাতের বাগানসমূহ কি? তিনি বললেন, যিকিরের হালকাসমূহ।" মসজিদগুলোতেইতো জিকিরের হালকাসমূহ কায়েম থাকে।
আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা যে আমরা যারা লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করি রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাত্রিগুলোতে। তারা যদি ঐ দিনগুলোতে ইতিকাফে থাকে তাহলে ইনশা'আল্লাহ মিরাজের ফযিলত সে পুরোপুরিই পাবে। কারণ ইতিকাফে কেউ ঘুমিয়ে থাকলেও সে ইবাদত থেকে খালি নয়। ২৪ ঘণ্টাই সে ইবাদতে থাকে। সুবহানাল্লাহ।
পরিশেষে, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যে আল্লাহ রব্বুল য়ালামীন আমাকে ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও অবসরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। হাদীস শরীফে আছে, হুযুর সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে আদম সন্তান, আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র ঘুচিয়ে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাতকে ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাবও দূর করব না।’ [তিরমিযী: ২৬৫৪; মুসনাদ আহমদ: ৮৬৮১; ইবন মাজা: ৪১০৭]
এক্ষেত্রে খুব খেয়াল করেন আমার ভাই, বোন, বন্ধুরা। একথা কে বলেছেন? বলেছেন আল্লাহ তায়ালা এবং আমাদের শুনিয়েছেন আল্লাহর রসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লাম। বের হওয়া গুলি আবার বন্দুকে ফিরে যাওয়া কখনো সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের কথা ব্যতিক্রম হওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই আমরা যারা দারিদ্র ঘুচাতে চাই ও পেরেশানীমুক্ত জীবন চাই আমাদের ওষুধ হলো আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঝামেলামুক্ত হওয়া। আর যদি তা না করি, আমরা হাজারো কাজে-অকাজে লিপ্ত থেকে পেরেশান হয়ে যাব, কিন্তু অভাব দূর হবে না।
সূরা ইনশিরাহ্-তে আল্লাহ রব্বুল য়ালামীন আমাদের হুকুম দিয়েছন,
فَإِذَا فَرَغۡتَ فَٱنصَبۡ
وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَٱرۡغَب
অর্থাৎ, "সুতরাং তুমি যখনই অবসর পাও, তখনই ইবাদতে নিজে পরিশ্রান্ত কর। এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোযোগী হও।"
অতএব, আমার জ্ঞানী-গুনী ভাই, বোন, দোস্ত ও মুরব্বীবৃন্দ। আসুন না আমরা এ বৎসর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করি। জীবনে কত কিছুর টেস্টইতো নিলাম। এবার নাহয় ইতিকাফের টেস্ট নেই। আল্লাহ রব্বুল য়ালামীন আমাদের কবুল করুন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




