somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম বড়দের ফিল্ম দেখা 8-|

০২ রা জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাকটিস শেষ করেই এক দৌড়ে হাউসে পৌছে গেলাম। উফফফ আজকে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে ফুটবল টুর্নামেন্ট...তাই আমাদের কোচ এই বারতি আর অমানুষিক প্রাকটিস করাচ্ছে। আজকের দিন টায় একটু তাড়াতাড়ি ছাড়লেই পারত। কোচের গুস্টি উদ্ধার করতে করতে দুধ খাওয়ার লাইনের দাঁড়ায় গেলাম...উফ এখন আবার এই পানি মারা দুধও খাওয়া লাগবে, এইদিকে সন্ধ্যা ও হয়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে ৭ টা বাজতে আর বেশী বাকি নাই। যেদিন কোন কাজ থাকবে সেদিন ই কোন না কোন কারনে দেরী হবেই হবে। এখন পর্যন্ত গোসল টাও করা বাকি। সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে চামের উপর দুধের কাপটা বাগানে উপুর করে দিয়েই টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে দৌড়। বাথরুমে ঢুকেও দমে গেলাম। প্রতিটা শাওয়ারের নিচেই ৪-৫ জন করে কুস্তি খেলতেসে। কে কার আগে গোসল করবে সেটা নিয়েই মারামারি। আমিও হেইইইইওওও...বলে কুস্তি খেলায় সামিল হয়ে গেলাম। চড়, চাপড়, কিল, ঘুসি ও লাথির সাথে কাউয়া গোসল শেষ করে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম তখন ঘড়িতে ৬:৪৫, মাত্র ১৫মিনিট বাকি। এইদিকে লাইনে দাড়ানোর জন্য ওয়ার্নিং বেল ও দিয়ে দিসে। তাড়াতাড়ি করে নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে ফেললাম। ভাইয়ার কাছ থেকে পাওয়া ব্রিল ক্রিম দিয়ে চুল গুলোকে আর একটু খাড়া করে দিলাম। ধুর মাথায় তো চুলই নাই, নাপিত ব্যাটা এইবার পুরো ন্যাড়া করে দিসে। কি যেন বাদ পরে গেছে...?? ওহ...সেন্ট ই তো মারি নাই এখনো। সারা গায়ে ফা স্প্রে করে, ফা এর সুগন্ধে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আহ...আমি রেডি।
পিছনে তাকায় দেখি পুরো হলে হুলস্থুল অবস্থা। সবাই দৌড়া-দৌড়ি করতেসে, কেউ হয়ত তার শার্ট পাচ্ছে না, কেউ কেউ তো এখন ও গোসল করতে পারে নাই। চতুর্দিকে চিল্লাচিল্লি। মনে হয় যেন ঈদ লেগে গেছে। ঈদ-ই তো। আজকে তো আমাদের খুশির দিন। স্বপ্ন পূরনের দিন। গত ৪ দিন থেকে পুরো কলেজ আজকের দিনের জন্য অপেক্ষা করছে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টা তো এটা নিয়েই আলোচনা, এটা নিয়েই কল্পনা, এটা নিয়েই স্বপ্ন দেখা। এই শেষ মুহুর্তে এসে সবাই উত্তেজনার শেষ সীমায় পৌছে গেছে ...
ঘটনার শুরু ৪ দিন আগে। সকাল থেকেই স্কুলে কানাঘুসা চলছিল। মুগনী স্যার সিনিয়রদের ক্লাসে নাকি বলেছেন আমাদের একটা ফিল্ম দেখানো হবে। ফিল্মটার নাম হল টাইটানিক। এক সিনিয়র ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাইটানিক দেখাবে...??? হুমমম...তাই তো বলল স্যার। ঘটনা টা ১৯৯৭ সালের, আমরা তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, এই বছরই রিলিজ পায় টাইটানিক। টাইটানিক নিয়ে তখন খুবই ক্রেজ ছিল, এর অনেক নাম ডাক, অনেক প্রাইজ পেয়েছে, প্রায় প্রতিদিন টাইটানিক নিয়ে পেপারে ফিচার থাকত। পেপারে কেট এর ছবি দেখে কল্পজনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে বেশী সময় লাগত না। পেপারে আর যা থাকত তা হল রগরগে কাহিনী। পেপার পড়েই জানতে পারলাম এটা বড়দের ছবি। এটায় অনেক ন্যুড সিন আছে। তো এমন একটি ফিল্মের জন্য আমারা ক্রেজি হব এটাই তো স্বাভাবিক।
গুজব যখন সত্যি প্রমানিত হল তখন শুরু হল আমাদের কল্পনা। কয়েকজন সিনিয়র ভাই তখন ফিল্ম ক্রিটিক হয়ে গেল (তারা নাকি টাইটানিক আগেই দেখে ফেলসে-এটা কতদূর সত্যি একমাত্র আল্লাহ আর তারাই জানে। সারা বছর হোস্টেলে পড়ে থাকে, দেখল টাই বা কবে?? আমরা তাদের মুখ নিঃসৃত প্রতিটা বাণী ই যে বিশ্বাস করতাম তা না, কিন্তু সেই রগরগে কাহিনী শুনতে ভালো লাগত। শরীরে অন্য রকম এক অচেনা শিহরণ জাগত। আমাদের সবার জন্যই এটা matured হওয়ার প্রথম ধাপ ছিল)। টাইটানিক এ হেন সিন, তেন সিন আছে, আরে কিসিং সিন ই তো আছে ২০-২৫টা। ২০-২৫টা??? আমরা অবাক হতাম (kissing কি সেটাই কি জানতাম তখন?? কিন্তু শুনতে ভালো লাগত)। কিসিং কোন ব্যাপার তাদের জন্যে?? এটা তো স্বাভাবিক একটা জিনিস। তোরা জিজ্ঞাস কর বেড সিন আছে কয়টা?? আমরা হতবিহ্বল...আবার বেকুবের মত প্রশ্ন করতাম, কয়টা?? (বেড সিন সম্পর্কেও কি তখন খুব বেশী কিছু জানতাম নাকি?? অবশ্যই না...কিন্তু সিনিয়রদের সামনে তো আর সেটা বলা যায় না। তখন যতটুকুই বুঝতাম তাতেই কান গরম হয়ে যাইত। শরীর শিরশির করে উঠত। এক নিষিদ্ধ উত্তেজনায় রক্ত টগবগ করে ফুটত। শুনতে ভালো লাগত...)
ঘুম থেকে উঠে টাইটানিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-কল্পনা শুরু হইত। পিটি করতে করতে কেট কে ভাবতাম। আহা...কত সুন্দর। অটোমেটিক শরীরের শক্তি বেড়ে যেত, উত্তেজনায় ৫-৬টা বেশী বুক-ডাউন দিয়ে দিতাম। হিরোর মত বডি বানাতে হবেই হবে...খাওয়ার টেবিলে, স্কুলে, খেলার মাঠে, পড়ার টেবিলে শুধু একই আলোচনা। টাইটানিক আর কেট...কেট আর টাইটানিক। ঘুমাতে যেতাম কেট কে ভাবতে ভাবতে...পেপারে কেট এর ছবি কে ট্রেস করে ডায়রিতে কেট কে ধরে রাখলাম। ঘুমাতে যাওয়ার সময় তাকে দেখে নিতাম, লুকিয়ে গভীর ভাবে চুমু দিয়ে নিতাম। এ এক নিষিদ্ধ উত্তেজনা তো ছিলই, কিন্তু আমার মনে হয় যে কারনে আমরা এতটা উত্তেজিত ছিলাম সেটা হল বড় হওয়ার আনন্দ।
হঠাৎ আমাদের স্বপ্নে কে যেন ঘি ঢেলে আগুন জ্বালায় দিল। আকাশে বাতাসে গুজব ছড়ায় পড়ল...টাইটানিক শুধু সিনিয়র রা দেখতে পারবে। জুনিয়রদের দেখতে দেয়া হবে না। ব্যাস...আর যায় কই?? বিদ্রোহ করে ঊঠলাম আমরা জুনিওয়র গ্রুপ...হইইইইই...করে পুরা হাউস গরম করে দিলাম। নজরুল স্যারের আশ্বাস পেয়ে তবেই চিল্লাচিল্লি থামেছিল।
যাই হোক, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দেখতে দেখতেই সেই মাহেন্দ্রক্ষন চলে আসল। সবাই মাঞ্জা মেরে রেডি। একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। সবাই উত্তেজিত। এতদিন যা আমাদের কল্পনায় ছিল, আজ আমরা সেটা বড় পর্দায় চাক্ষুস দেখতে পারব। আমি ডাবল উত্তেজিত ছিলাম, এক কেট কে দেখব বলে, আর দুই সেটা বড় পর্দায় দেখব বলে। এর আগে আমি কোন দিন বড় পর্দায় সিনেমা দেখি নাই।
টাইটানিক দেখতে যাব তাও যেতে হবে মার্চ-পাস্ট করে, এটা কোন কথা?? দুই হাউস থেকে আমরা মার্চ করে অডিটোরিয়ামে পৌছে গেলাম। কলেজে সব কিছুই চলে নিয়মের মধ্যে, কে কোন সিটে বসবে সেটাও নির্দিষ্ট থাকত। কিছুক্ষনের মধ্যেই কর্নেল কায়সার সাহেব চলে আসলেন। এখন হবে ছোটখাট একটা ভাষন- “...আমরা চাই আধুনিক শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। আশা করি তোমরা এর থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে যা তোমাদের পরবর্তী জীবন গঠনে অনেক বলিষ্ঠ অবদান রাখবে...”
আসছি সিনেমা দেখতে শুনতে হচ্ছে ভাষন, বল কেমন লাগে? পুরো অডিটোরিয়াম একসাথে হো...শব্দে গমগম করে উঠল। কর্নেল এইবার তুমি অফ যাও...লাইট নিভাও...সিনেমা চালাও। ছাত্রদের অস্থিরতা দেখে মাঝ পথেই ভাষন থেমে গেল, লাইট নিভে গেল। শুরু হইল শো...
সুবিশাল জাহাজ, মহা সাগর আর বিলাসিতা দেখে আমরা হতবাক। মন্ত্রমুগ্ধের মত ২ ঘন্টা সিনেমা দেখার পর সিনিয়র কয়েক জনের মনে হল তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তারা হইচই শুরু করে দিল। প্রতিটা মসলাদার সিন সেন্সরড করা ছিল। পুরো সিনেমায় মাত্র ২টা কিসিং সিন ছিল। তার পরেও যখনই নায়ক কেট কে কিস দিত পুরো অডিটোরিয়াম কিস দেয়ার শব্দে কেঁপে উঠল। এইদিকে লাইট নিভানো, কে কি করতেসে কিছু দেখা যায় না। এই সুযোগে সবাই কমেন্ট পাস, গালাগালি, কেট কে আদর করার অভিলাষ ব্যক্ত করতে লাগল। ওহহ...একটা সিন তারা সেন্সর করতে ভুলে গেছিলেন মনে হয়...গ্যারাজের সেই গাড়ীর সিন। যেখানে নায়িকার হাতের ছাপ পড়ে যায় গাড়ীর গ্লাসে...আমরা চরম ভাবে বঞ্চিত হবার পর এই সিন টা দেখে যে কলরব করে উঠলাম সেটা আর বলার মত না।
সব শেষে সেই বিখ্যাত গান...
Every night in my dreams…
I see you, I feel you…
যত ক্ষোভ ছিল, এই একটা গান তা পানি করে আমাদের আবেশের মধ্যে নিয়ে নিলো। সবাই এক ঘোরের মধ্যে অডিটোরিয়াম থেকে বের হলাম। এখন মার্চ করার প্রশ্নই উঠে না…আমরা তখন স্বপ্নের আবেশে ছিলাম…কেট এর স্বপ্ন, জাহাজ দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার স্বপ্ন।
টাইটানিক censored ছিল কিন্তু আমাদের কল্পনা কে censor করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। সেদিন এক নতুন অনুভূতি নিয়ে আমরা ঘুমাতে গিয়েছিলাম। বড় হবার অনুভূতি। টাইটানিক নিয়ে আমাদের যেই কল্পনা, যেই শিহরণ সেটা আমাদের maturityর প্রথম ধাপ ছিল। unrated টাইটানিক দেখতে খুব বেশী দিন অপেক্ষ করতে হয় নি, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষনই তো কৈশোরের ধর্ম। ;)
৬০টি মন্তব্য ৫৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×