খুব ছোটোবেলা একজন মাওলানা রেখে দেয়া হয়েছিলো আরবী আর কোরআন শিক্ষার জন্য। সুরা ফাতিহা আর বাকারা মুখস্থ করার পর সেই মাওলানা আর আসতেন না বলে থেমে গিয়েছিলো সেই পড়া। ছাত্রশিবিরে এসে ইসলামের সাথে যোগাযোগটা হলো গভীরভাবে। মাওলানা মওদূদীর ইসলাম পরিচিতি দিয়েই শুরু। মাওলানা আব্দুর রহিমের কালেমা তাইয়্যেবা। 'খুন রাঙা পথ' বলে একটি বইয়ের প্রচ্ছদ এখনও চোখে ভাসে। হলুদ জমিনের উপর লাল লাল রক্তমাখা পদচিহ্ন। দেশে পুরনো ট্রাংক খুললে বইয়ের তালিকাটা পাবো। এতসব বইয়ের ও লেখকের নাম এখন আর মনে নেই। তবে বইগুলো পড়ে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করছিলাম কোরান ও হাদিসের কথাগুলো। ধর্ম হিসেবে ইসলামের আধুনিক চিনত্দাভাবনা। তবে আমাদের পড়ার বইয়ের তালিকায় আধ্যাত্মিক কোনো বই ছিলো না। ধর্মের আধ্যাত্মিক বিষয়ে ছাত্রশিবির কখনও জোর দিতো না। তখন বরং জোর ছিলো জিহাদের দিকে। পরে তা পরিবর্তিত হয়, আনত্দর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে। আহলে হাদীসের জেহাদিদের মধ্যে তাই প্রাক্তন ছাত্রশিবির পাওয়া যায়, কিন্তু শিবিরের বর্তমান সদস্য পাওয়া যায় না।
বইপড়ার চর্চাটা এখন শিবিরে কমেছে বলেই ধারণা। অস্ত্রের চর্চা বেড়েছে। বই পড়লেই প্রশ্ন উঠে। বিতর্ক শুরম্ন হয়। বিরোধ দেখা দেয়। সুতরাং সৃষ্টি হয় বিভক্তি। ছাত্র ইউনিয়ন অনেকবার ভেঙেছে কমিউনিজম সংক্রানত্দ ব্যাখ্যা-বিরোধের কারণে। শিবিরের সেই অবস্থা হয়নি। তবে অনেকে শিবির ছেড়েছে এবং শিবির ত্যাগ করে অন্য সংগঠন করার পেছনে ইসলাম সংক্রানত্দ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিরোধই কারণ।
আমাদের সময়ে ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতো। সুতরাং টার্গেট ছিলো যত বেশি সংখ্যায় পারা যায় সেনাবাহিনীতে অনত্দর্ভুক্ত হওয়া। আমির গোলাম আযমের পুত্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সোর্ড অব অনার পাওয়ার গল্প তখন সকল ছাত্রশিবির কর্মীর অনুপ্রেরণা। আমাদের গাজীভাইও ঢুকে গেলেন সেনাবাহিনীতে। এবং তার দাঁড়িও কোনো অসুবিধা হয়ে দাড়ালো না এতে। সেই গল্পও তখন আমদের কাছে বেশ চটকদার। কিভাবে ইন্টারভিউতে গাজীভাই আর্মি অফিসারদের বোকা বানালেন দাঁড়ির প্রশ্নে তা নিয়ে প্রায়ই আমরা আলোচনা করতাম। সেনাবাহিনী আমার কাছে পছন্দের ছিলো না কখনও। সুতরাং আমি আগেই সিনিয়র ভাইদের জানিয়ে দিয়েছিলাম সে পথ আমি মাড়াচ্ছি না।
বছরখানেকের মধ্যে আমাদের এলাকার ছাত্রশিবিরের কাছে থাকা বইগুলো আমার পড়া হয়ে শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তখনও আমার অনেক প্রশ্ন। সিনিয়র ভাইরা তখন অন্যান্য বই পড়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু সেগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে বন্ধু রফিকের হাতে একদিন একটি নতুন ধরনের বই দেখলাম। রফিক ছাত্রশিবির করে না। ওর কাছে ইসলামী বই দেখে আমি অবাক। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোর হাতে ইসলামী বই, তোর তো এসব পড়ার কথা না। রফিক তার স্বভাবসুলভ সুফিমার্কা হাসি দিলো। বললো আমার কাছে আরো অনেক বই আছে।
বইগুলো পাবার ও পড়ার জন্য আমি রফিকের সাথে বন্ধুত্ব বাড়াতে বেশি করে সময় কাটাতে শুরু করলাম। রফিকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার কোনো কারণ ছিলোনা। সাধারণ মানের ছাত্র ছিল ও। ক্লাসে অমনোযোগী, খেলাধূলায়ও তাই। অন্য কোনোকিছুতেও তার তেমন পারঙ্গমতা চোখে পড়েনি। ও আসলে চোখের আড়ালেই থাকতো। ছাত্র হিসেবে খারাপ হলেও পরে জেনেছিলাম গৃহশিক্ষক হিসেবে এলাকায় তার খুব নাম-ডাক ছিলো। রফিক এসএসসিতে টেস্টে ফেল করে অন্য স্কুল থেকে পরীক্ষা দেয়। কিভাবে কায়দা করে যেন সিট আমার পাশে ফেলেছিল। সবক'টা পরীক্ষা আমার পাশে বসে দেখে দেখে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাশও করে ফেলেছিলো এসএসসি। পরে আর যোগযোগ হয়নি। তা রফিকের সাথে আমার এই অকস্মাৎ বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার কারণ ছিলো ইসলামী বই। একদিন দুপুরে ঘুম, খেলা বাদ দিয়ে রফিককে নানাভাবে পটিয়ে ওর বাসায় গিয়ে হাজির হই। বেশি নয় ছয়-সাতটা ইসলামী বই সে আমাকে দেখায়। সে ধরনের বই আমি কখনও দেখিনি। ইসলামী ছাত্রশিবিরের তালিকায় সেসব বই নেইও। কোনো এক প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা একটি বইয়ের কথা মনে আছে। সেসব বইয়ের বিষয় ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি রহস্য। এধরনের বই ছাত্রশিবিরে পড়তে দেয়ার কোনো কারণ নেই। আর আমার আগ্রহও তখন দুর্নিবার ইসলামী দর্শনচিন্তা জানার জন্য। কিন্তু রফিকের সেসব বইয়ের বেশিরভাগই নাকি আউট অব প্রিন্ট। যে বইয়ের কথাই জিজ্ঞেস করি সে জানায় যে, অমুকের কাছ থেকে এতদিনের কথা বলে সে এটি এনেছে। সুতরাং আমাকে দেয়া যাবে না। আমি রফিকের সাথে বিকালের পর বিকাল কাটাতে থাকি। ও আমাকে ওর জানা ইসলামের রহস্যময় গল্প শোনায়। মনসুর হাল্লাজ ও আনাল হকের কথা। ওয়াছ কুরনি'র কথা। হাদিসে কুদসি'র কথা। রাবেয়া বসরি আর বড় পীরের কথা। কিন্তু বই দেয় না।
সমরাস্ত্র কারখানাতে প্রতিবছর কবি গানের আসর বসে। মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ানের কবি গানের আসরে গিয়ে সারারাত আমি কাটিয়ে দেই রফিকের সাথে। শরীয়ত ও মারিফতের তর্ক আর তা নিয়ে এই ভীষণ প্রতিভাবান এই দুই কবির তাৎক্ষণিক গান তৈরি দেখে অভিভূত হয়ে যাই। জীবাত্মা ও পরমাত্মা নিয়ে তাদের পাল্টা পাল্টি পরিবেশনা সে যে শুনেছে সে জানে কতটা জ্ঞানী ছিলেন তারা। একজন আরেকজনকে এমন প্রশ্ন করে যে মনে হয় এর কোনো উত্তর নেই। আর এখনই অন্যজন এসে বলবে আমি হার স্বীকার করছি। কিন্তু কোনো পক্ষই হার স্বীকার করে না। রাত ভোর হয়ে যায় জ্ঞানের তর্কে আর গানে। মনে আছে একটি প্রশ্ন ছিলো, কী কারণে কোরানের চেয়ে মানুষ বড় এবং কোরানের উপর মানুষ দাড়ালে কোনো অসুবিধা নেই। মারিফতের সাথে পরিচয় ঘটে রফিকের কারণে, কিন্তু অল্প দুয়েকটা কথা ওর মুখে শুনে তার রহস্য-ভেদ করতে পারি না। ওর বলা বাতেনি জ্ঞানেরও কূল-কিনারা বুঝতে পারি না। আমি রফিকের পিছে পিছে ঘুরি। কিন্তু সে তার বই হাতছাড়া করে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০