সকালের রোদের নিচে হাটতে হাটতে ছেলেটা আনমনেই অনেক কিছু ভাবছিল। চোখেমুখে তন্ময়তা এতটুকুও আড়াল ছিল না। ভাবনাটুকু সঙ্গী করে হাটতে হাটতে পথের শেষ প্রান্তে চলে এল সে। সেখানে তার জন্য ওৎ পেতে ছিল গাঢ় অভিমানী ছায়ার দল। ছায়াগুলো তাকে গ্রাস করতে চাইল। ছেলেটা পিছন ফিরে চেয়েছিল। তার পদচিহ্ন গুলো রোদের আলোয় জ্বল জ্বল করছিল। ছেলেটা হেসে ফেলল আকাশের দিকে তাকিয়ে। এক খন্ড ধুসর মেঘ এসে যেন দাড়িয়েছে তার মাথার উপর। অথচ একটু আগেই তপ্ত রোদে পুড়ছিল সবটা রাস্তা। এইতো, একফোটা বৃষ্টিও কোথা থেকে এসে পড়ল তার গায়ে! বৃষ্টি ফোটার সন্ধানে আকাশের দিকে ফিরে চাইল ছেলেটা। এক খন্ড মেঘটা নেমে এল তার অনেক কাছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত ই মনে পড়ে গেল সব কথা... যে কথা গুলো প্রায় ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে গ্রীষ্মের প্রখর সুর্য্যালোক আর অপসারী রোদের রং। রোদের নিচে হাটতে হাটতে ছেলেটা ভুলেই গিয়েছিল, সে বৃষ্টির ছেলে...
- - - - - - - - - -
এক
"ছায়াগুলো আমাকে ঘিরে ধরে। ফিসফিসিয়ে কি যেন বলতে চায়। অনেক অভিমান ওদের চোখেমুখে..." ডেস্কের ওপারে চেয়ারে বসে কথা গুলো বলছিল ছেলেটি। লম্বা মুখ, ঝাকড়া চুল, কোকরানো। একহারা গড়ন। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার চোখে। দৃষ্টির ভেতরে কেমন একটা সম্মোহনী ভাব আছে। রুপক নাম ছেলেটার। আমার নতুন পেশেন্ট।
"আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না ডক্টর।" শান্ত অথচ গাঢ় স্বরে বলল রুপক। "করার কথাও না। বিশ্বাস হতে পারে এমন কিছুই বলছিনা আমি। চাইলেও বলতে পারবো না। কারণ আমি বানিয়ে বলছিনা কিছু। কিন্তু আপনাকে সত্যিটা বলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে আমার?..." আরও অনেক কিছু বলছিল রুপক, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি ওর হাত নেড়ে কথা বলাটা দেখতে পাচ্ছিলাম, মানে চোখে ভাসছিল। কিন্তু, ভাবছিলাম অন্য কথা। বয়স বেশি না ছেলেটার। মাত্র ২১। সিজোফ্রেনিয়াক* বলে আপাতত সন্দেহ করছি। কিন্তু ওর কথাবার্তায় কল্পনার লেশমাত্র নেই। চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, যতটুকুই ও বলছে, মিথ্যে নয়। আমার এখানে রুপককে নিয়ে এসেছেন ওর বাবা। খুব বেশি দিন হয়নি সাইকিয়েট্রি তে ঢুকেছি। এরকম কেস আগে দেখিনি।... আমার চিন্তার রাশ টেনে ধরল রুপক। "আজ তাহলে উঠি?" সেই শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠস্বর। "নিশ্চয়ই। ভাল থাকবেন।" উঠে দাড়াল রুপক। "আমার সমস্যাটা কি, ধরতে পেরেছেন?" মৃদু হাসল সে। আমাকে স্বীকার করতেই হল, দৃশ্যমান কোন অসুস্থতা আমার চোখে পড়েনি। রুপক চলে গেল। অদ্ভুত একটা ছেলে। চলা ফেরা কি আশ্চর্য রকম শান্ত! ওর ব্যপারে যতটুকু জানলাম, তাতে এই আচরণ, অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলার কোন কারণ খুজে পাওয়া যায় না। পড়ালেখার পাশাপাশি রুপক গান ভালোবাসে। ছবি আকতে আর টুকটাক লেখালেখির আগ্রহও আছে বলে শুনেছি। ওদের বাড়িতে একদিন যেতে পারলে হত। হয়ত কিছু জানতে পারতাম। এমন কিছু, যেটা আমাকে ওর চিকিৎসা করতে সাহায্য করবে।
দুই
সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ, তাই মুখটা কালো করে রেখছে সে। রোদ কে একবারের জন্যও নিজের আড়াল থেকে বেরোবার সুযোগ দেয়নি মেঘের দল। আমি এখন বসে আছি রুপকদের বাসায়, ওর বেডরুমে। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ঘর। ঘর লাগোয়া ছোট্ট একটা ঝুলবারান্দা। দোতালা বাসা রুপকদের। রুপকের বয়স যখন ৭ বছর, তখন একটা দুর্ঘটনায় ওর মা মারা যান। তার পর থেকেই বদলে গেছে রুপক। ভয়ঙ্কর রকমের শান্ত হয়ে গেছে। সবার সাথে ঠিকমত মিশতে চায় না। নিজের জগত টাকে আর সবার জগত থেকে আলাদা করে নিয়েছে। রুপকের বাবা বহু চেষ্টা করেছেন সন্তান কে বোঝার, কিন্তু কিছুই করতে পারেন নি।
আমি রুপকের কবিতার খাতা নাড়াচাড়া করছিলাম। রুপক এল বেশ কিছুক্ষন পর। "আপনার লেখার হাত কিন্তু দারূণ। বলিষ্ঠ লেখনী।" বললাম আমি। রুপক একটু লজ্জা পেল যেন। "এই একটু আধটু লেখার অভ্যেস আছে। স্মিতহাস্যে বলল।"
দেয়ালে বড় করে বাধানো রুপকের মা’র ছবি। খেয়াল করে দেখলাম, রুপকের দেখতে ওর মা’র মত। আমাকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুপক কিছু একটা বলতে মুখ খুলছিল, ঠিক তখনি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামন। রুপকের সাথে আমার চোখাচোখি হল। ওর চোখে আচমকা একটা আনন্দের শিহরণ বয়ে যেতে দেখলাম। আমাকে অবাক করে কিশোর ছেলেদের মত দৌড়ে রুপক বারান্দায় গিয়ে দাড়াল। বৃষ্টির রাজ্যে হারিয়ে গেল যেন সে! অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। বৃষ্টিফোটা গুলো যেন তাকে আড়াল করে ফেলছিল! তার তন্ময়তা ভাঙ্গল বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে। পুরোটা সময় আমি বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দরজার পাশে। আমারো যে একটু আধটু ভিজতে ইচ্ছা করছিল না তা কিন্তু নয়! কিন্তু আমার তো বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করেনা কখনো। আজ তবে কি হল?
রুপকের লজ্জিত কন্ঠস্বরে ভাবনার জাল ছিড়ে গেল। "এই যা! আপনাকে দাড় করিয়ে রেখেছি!" আমি বাধা দিয়ে বললাম, "না না, ঠিক আছে। আমি নিজেই এসেছি। আপনাকে দেখতে খুব ভাল লাগছিল। বৃষ্টি বুঝি খুব পছন্দ করেন আপনি?" রুপক হাসল। "হ্যা। অনেকে! ছোটবেলা থেকেই। আমার মা খুব ভালবাসতেন বৃষ্টি। আমাকে কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করেনি মা। বরং উতসাহ দিয়েছে। এজন্যই বোধহয় ছোটবেলা থেকে আমার কখনো জ্বর হয়নি। অসুখ খুব কম হয় আমার।"
কথা বলতে বলতে আমরা আবার ঘরে ঢুকে পড়েছি টের পাইনি। রুপক আমাকে বলল "বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি। দুধ ছাড়া, চিনি বেশি।" আমি চমকে উঠলাম। "আমি ব্ল্যাক কফি খাই, চিনি বেশি। একথা কি আপনাকে আগে কখনো বলেছি?" রুপক হাসল। "না বলেন নি।" "তাহলে আপনি কিভাবে জানলেন?" "মনে হল।" মৃদুহাস্যে বলল রুপক।
আমি রুপকের ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঘর বটে একখানা! এত সুন্দর গোছানো পরিপাটি ঘর আমি খুব কমই দেখেছি। দুদিকে দুটো জানালা, একটা ঝুলবারান্দা। প্রতিটি জিনিসে যত্নের ছাপ। স্টাডি টেবিলে একটা আধখোলা বই। খাটের পাশে একটা গীটার, আলো পরেছে ওটায়। বুকশেলফে থরে থরে সাজানো নানারকম বই। আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি। এমন সময় রুপক এল দুটো মগে কফি নিয়ে। "আর কিছু? না না! অত আপ্যায়ন করতে হবে না। চলুন বসি।"
আবার বারান্দায়। গার্ডেন চেয়ারে বসলাম আমরা। রুপক নিজে থেকেই বলতে শুরু করল, "মা মারা যাবার পর থেকে আমি অনেক বদলে গেছি। কারো সাথে সেভাবে মিশি না। ক্লাসের সময়টা বাদে ঘরেই থাকি। এ ঘরটাই আমার জগত। আসলে মাই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। ছোটবেলা থেকে মা খুবই আগলে রাখত। মাকে ছাড়া আমার একমূহুর্তও চলত না। মা যখন চলে গেল, সে শুন্যতাটা আমি আর কোন কিছু দিয়েই পুরণ করতে পারিনি। কখনো পারবোও না জানি।" রুপকের চোখে জল দেখলাম। একটু আগেই বৃষ্টি ধরে গিয়ে রোদ এসেছিল। কিন্তু আবার আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল। আমরা ভেতরে চলে এলাম। "ইয়ং ম্যান, ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। কিছু কিছু ক্ষতি এমনও থাকে যা কখনোই পুরণ করা যায় না। কিন্তু তারপর ও আমাদের বেচে থাকতে হয় সবকিছু মেনে নিয়েই। আপনাকেও পারতে হবে। আমরা আছি আপনার পাশে। আমরা সবাই আপনাকে সাহায্য করবো।"
রুপকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নামলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, খানিক আগেই মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল আকাশে। এখন কিছুই নেই। আমার রোদ উকি দিয়েছে। রুপক কে তো বলে এলাম সাহয্য করব। কিন্তু কি সাহায্য করব! আমি তো কোন ক্লুই পেলাম না। প্রথমদিন আমার চেম্বারে বসা রুপক আর এই রুপক পুরোপুরি আলাদা দুজন মানুষ মনে হচ্ছে আমার...
তিন
খুব ব্যাস্ত দিন যাচ্ছে। একসপ্তাহ মত কেটেছে রুপকদের বাড়ি যাবার পর। গতকাল রুপকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। রুপক আসেনি। ফোনও করেনি। যখন ভাবছিলাম আমিই ফোনটা করবো কিনা, তখনই রুপক এসে দাড়াল চেম্বারের দরজায়।
আসব?
-নিশ্চয়ই! কেমন আছেন বলুন?
ভাল। তবে
-তবে কি?
ছায়া গুলো আমাকে ডাকছে। ওরা আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। আমি ঠিক করেছি যাব।
-দেখুন রুপক আপনাকে এখনো মেডিকেট করিনি আমি। আমার মনে হয় মেডিকেশন পড়লেই আপনি সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। এগুলো আপনার ভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।
ডক্টর, আমার কোন রোগ হয়নি। আর সেজন্যই এর কোন চিকিতসা করাও সম্ভব না। আমাকে ওরা ডাকছে। এখনই সময়। আমাকে যেতে হবে। হয়ত আপনার সাথে আর কখনো দেখা হবে না। ভাল থাকবেন, ডক্টর!
কথাগুলো বলল রুপক তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তায়। তারপর আর এক মূহুর্ত দাড়াল না সে। বেরিয়ে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম...
- - - - - - - - - -
জলে ভেজা কাদা জড়ানো পায়ে সবুজে ছাওয়া পথে ছুটে... না, ছুটে বললে ভুল হবে, প্রায় উড়ে চলছিল একটা ছেলে। তার চোখের তারায় জোনাকের আলোর মত ঝিকমিক করছিল স্বাধীন আকাশের প্রতিচ্ছবি। মাঠ পেরিয়ে, ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে পথের আরো গভীরে ছুটে চলছিল সে। গন্তব্য জানা ছিলনা তার। জানতে চাওয়নি সে কখনো... শেষ বিকেলের এক মুঠো আলোকে সঙ্গী করে সে ছুটে চলছিল, আশ্চর্য, তার পথচলায় কোন ক্লান্তি ছিলনা! সূর্য্য হেলে পড়েছে। ছুটতে ছুটতে দিগন্তের দিকে ফিরে চাইল ছেলেটা, হঠাত থেমে দাঁড়াল। ঠোটের কোণে ফুটেছে এক টুকরো অপার্থিব হাসি... সে হাসির মানে কি কে জানে! শহুরে রোদের নিচে হাটতে হাটতে ছেলেটা ভুলেই গিয়েছিল, সে বৃষ্টির ছেলে...
* সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia): এক ধরনের মেন্টাল ডিজঅর্ডার, যাতে আক্রান্ত হলে রোগী বাস্তব আর কল্পনার জগত আলাদা করে চিনতে ব্যর্থ হয়।
০৩ মে, ২০১১
© দি ফ্লাইং ডাচম্যান
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



