আমরা সবাই শিয়ালের স্কুলের গল্প শুনেছি। বনে বনে ঘুরে ঘুরে যখন সে শিকারে অসমর্থ হয়ে পড়লো,তখন শিকার ধরার এক অভিনব কৌশল হিসেবে পাঠশালা সৃষ্টি করলো। বনের প্রাণীদের শিক্ষিত করার জন্য পাঠশালায় আনে এবং দিনে দিনে তার পেট পুরা করে। কুমির মামা তার সাত সন্তানকে শিক্ষিত করতে এসে সাত সন্তানকেই চিরতরে হারায়।
এই পুরানো গল্প মনে করিয়ে দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। আমার মনে হয়, বর্তমান শিক্ষার ক্ষেত্রে সেই শিয়ালের পাঠশালায় আমাদের কচি কচি ভাইদের তুলে দিচ্ছি। শিক্ষা নামক শিয়ালটি কুমিরের বাচ্চার মতো গিলে খাচ্ছে,আমাদের কচি কাচাদের। বিনিময়ে কুমিরের মতো আমরাও হারাচ্ছি আমাদের কলিজার টুকরোদের প্রিয় সম্পদ।
শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার আদায়ে সকলকেই এগিয়ে আসতে হয়। সাধারণত আমাদের আগের সমাজে পাঁচ বছরের কম হলে স্কুলে দিতো না। তারও আগে শুনেছি এক খতম কুরআন না দিলে কাউকে স্কুলে দিতো না। যুক্তি ছিলা,সেখানে গেলে তো আর কুরআন পড়ার সুযোগ হবে না। তাই আগে সালাত-কুরআন শিখা উচিত।
কিন্ত আজকের সমাজের চিন্তাধারা পুরাই ভিন্ন। এখন তিন বছর হলেই, স্কুলে ভর্তির জন্য মা-বাবার দৌড়াদুড়ি শুরু হয়। নামি-দামি স্কুলে ভর্তির জন্য ফরম কিনে আনে। প্রার্থী বেশি থাকার কারণে এই সব কচি কাচাকে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। মুখে কথা ফুটার আগেই তাকে স্কুলের ব্যাগ কাধে নিতে হয়।
শুধু কি তাই? পরীক্ষায় ভালো করার জন্য রাখা হয় টিউটর। স্কুলে ফাস্ট হওয়ার জন্য বাবা-মা প্রেশার দিতে থাকে এই নিস্পাপ সন্তানের উপর। জীবনে যখন খেলা করে সময় কাটানোর সময়,তখন তাকে শিক্ষা নামক যাতাকলে পিষ্ট হতে হয়। এমন অনেক ছোট ভাই বোন আছে,যারা সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়,আর বিকেলে আসে। অথচ সে মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সকালে স্কুল, এরপর স্কুল কোচিং,দুপুরে খাওয়ার পর টিউটর,বিকেল থেকে রাতেও টিউটর,এভাবেই চলে তার জীবন।
অন্যদিকে পড়াগুলোও এত কঠিন যে,আমরা অনার্সে যে সব ইংরেজি শব্দ পড়ছি তার অনেকগুলো এখন ক্লাস থ্রির বইতে পাওয়া যায়।….মা স্কুলে গেলে তার সন্তানের রেজাল্ট নিয়ে বান্ধবীদের সাথে গর্ব করেন। প্রাইভেট কিন্ডার গার্ডেন গুলোয় বইয়ের অভাব নেই। আমার ছোট বোনের ফাইভের সময়,তার বই ছিলো ১৪ টি। টিচারদের বললাম, পি এস সিতে ও তো এতগুলো সাবজেক্ট নেই। কেন ওদের এতগুলো পড়ান? স্যার বললেন,এখন প্রতিযোগিতার যুগ। কেবল সরকারি বইতে সীমাবদ্ধ থাকলে তো চলবে না।
এদিকে এক বিষয়ে মার্কস কম পেলে গার্ডিয়ানরা তার উপর প্রেশার দেন। টিউটর তার পেশা টিউশনি রক্ষার জন্য স্টুডেন্টকে চাপ দেন। এভাবে চাপে চাপিত হয়ে,কচি কাচাদের অবস্থা কী হয়??….আসলেই কি তারা অনেক এগিযে যাচ্ছে।আসলেই কি তাদের মেধার বিকাশ ঘটেছে। নাকি শিক্ষার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আরেক জ্বালা। এসব কচি-কাচাদের বিনোদনের সময় নেই। শহরে মাঠ না থাকার কারণে,তারা খেলার সুযোগ পায় না। বিকেলে টিউটর থাকায় খেলাধুলা বন্ধ।..তাদের বিনোদন কেবল কম্পিউটার গেমের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আমাকে একটু বলুনতো, খেলাধুলা ছাড়া কি শিশুর সুস্থ বিকাশ সম্ভব?
আবার অন্য সমস্যা। টিভিতে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু সন্তানদের দেখে মা-বাবা আশা করেন,তার সন্তান সেরকম হোক।এতে তিনি সন্তানকে পড়ালেখার পাশাপাশি নাচ-গান ইত্যাদির প্রতি জোর দেন। টিভিতে প্রতিযোগিতার জন্য তাদের চাপ দিতে থাকেন। এবার বলুন এরা যাবে কোথায়?
আবার আমার একজন শিক্ষক এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে একজন বললেন,ভাই এখন পিছিয়ে থাকলে হবে। দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে। আপনারা তো জানেন না।….
তখন আমার এক ভাই বললেন,একটা কাজ করেন। যে দশ মাস মায়ের গর্ভে থাকে এমন কোনো সিস্টেম চালু করেন,যাতে সেখানেও শিখানো যায়।
হুম, কথায় লোজিক আছে।
আসলেই আমরা তখনকার অবস্থায় কেন পিছিয়ে থাকবো??????