somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলার ৭ বীরশ্রেষ্ঠ: স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁদের অবদান:

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি:-বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান(১৯৪১-১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসীকতার জন্য যে ৭ জন শহীদকে বাংলাদেশ সরকার বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করেছেন তাদের নিয়ে আমার ৭ পর্বের ধারাবাহিক পোষ্টের আজ প্রথম পর্ব বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে নিয়ে।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পরিচিতি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকাঃ-

১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন। মা সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা৷ বাবা মৌলবি আব্দুস সামাদ৷ তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকা কালেক্টর অফিসের সুপার৷ নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস৷ নয় ছেলে দুই মেয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মতিউর ছিলেন অষ্টম৷ ছেলেবেলা থেকেই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, দুরন্ত, ডানপিটে৷ ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ৷ ১৯৬০ সালের মে মাসে মতিউর কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করলেন ডিস্টিংশনসহ৷ এরপর ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে৷

মতিউর ছিলেন একজন চৌকস ক্যাডেট৷ তাঁর একাগ্রতা, ইচ্ছা আর মেধা দিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন ৷ ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়ে পদোন্নতি হয় মতিউর রহমানের৷ ১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল বিয়ে করেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মিলি খানকে৷ বিয়ের কয়েকদিন পরেই মতিউর চলে যান পাকিস্তানের চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে৷ ১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম হয় এ দম্পতির প্রথম কন্যা মাহিনের৷ শহীদ হওয়ার পর বিজয় দিবসের মাত্র ২ দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর,১৯৭১ জন্ম হয় মতিউরের দ্বিতীয় সস্তান তুহিনের৷
১৯৭১ সালের শুরুতে সারাদেশ যখন উত্তাল, তখন জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে আসেন ঢাকা৷ ২৫ মার্চের কালরাতে মতিউর ছিলেন রায়পুরের রামনগর গ্রামে৷ তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না৷ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন৷ যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন৷ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী৷ পরবর্তীতে মতিউর ১৯৭১ সালের ৯ মে স্বপরিবারে করাচি ফিরে যান৷ এদিকে দুই মাসের ছুটিতে এসে চারমাস পেরিয়ে গেছে ততদিনে৷ করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ্য করলেন বাঙালি অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে৷ তাঁকেও তাঁর নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব৷ মতিউরের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের৷ তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন৷ সহকর্মীদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ৷ পি. আই. এ-এর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি অফিসারদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়৷ বাঙালি পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়৷ মতিউর তখন করাচির মশরুর বিমান ঘাঁটির বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার৷ এর আগে মতিউর ছিলেন ফ্লাইট ইন্সট্রাকটর৷ ছাত্রদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি৷ তাঁর অনেক পাকিস্তানি ছাত্রের একজন রশিদ মিনহাজ৷ সে পুরাতন ছাত্র৷ মতিউর জানতেন, সে একা আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি পাবে৷ তাই তিনি তাকে টার্গেট করেন৷


ছবি:- বাংলাদেশের গৌরব ৭ বীরশ্রেষ্ঠ।

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার৷ ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী মিনহাজের উড্ডয়ন আজ৷ মতিউর পূর্ব পরিকল্পনা মতো অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে৷ সামনে পিছনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩, রশিদ মিনহাজ বিমানের সামনের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসছে৷ এবার মতিউরের পালা৷ মতিউর হাত তুলে বিমান থামালেন৷ হাতের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন, বিমানের পাখায় সমস্যা৷ রশিদ মিনহাজ বিমানের 'ক্যানোপি' খুলতেই মতিউর তাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন৷ কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন, 'আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাক্ড৷' ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে পেল তা৷ বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর বিমান নিয়ে ছুটে চললেন৷ রাডারকে ফাঁকি দেবার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি৷ যদিও ততক্ষণে এফ ৮৬ ও একটি হেলিকপ্টার তাঁকে ধাওয়া করা শুরু করে কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশে৷ বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তখন মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে বাধা দিতে চেষ্টা করে ৷ সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে বালির ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে ব্লুবার্ড-১৬৬ ৷ ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট দেশের জন্য শহীদ হন আমাদের এই বীর সন্তান মতিউর৷ মতিউরের বিমান হাইজ্যাকের স্বপ্ন সফল হলো না৷ এরপর মতিউর ও মিনহাজের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং কোন প্রকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মসরুর বিমান ঘাঁটিতে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে মতিউরের লাশ দাফন করা হয়৷ তাঁর কবরে লেখা হয় 'গাদ্দার' বা বিশ্বাসঘাতক৷ দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয়৷ ২৬ জুন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়৷ দীর্ঘ ৩৫ বছর অবহেলায় থাকলেও মতিউর ফিরে আসেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে৷ ঠাঁই পান এদেশের মাটিতে৷


ছবি:-মিরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে এই মহান বীরের সমাধী।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

নাম: মতিউর রহমান
জন্ম: ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর, বুধবার, মধ্যরাত্রি ঢাকা শহরের আগা সাদেক রোডের ১০৯ নম্বর বাড়িতে জন্ম নেন মতিউর রহমান৷
মা: সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা৷
বাবা: মৌলবি আব্দুস সামাদ৷
শিক্ষা ও কর্মজীবন: ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ৷ এরপর ১৯৫৬ সালের ৫ই এপ্রিল সারগোদা পি. এ. এফ একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন৷ ১৯৬০ সালের মে মাসে মতিউর কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করলেন ডিস্টিংশন সহ৷ ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে৷
মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার৷
সমাধিস্থল: মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান৷

ছবি ও তথ্য সূত্র:- মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।
বীরশ্রেষ্ঠদের প্রোট্রেট ছবি:- বিকাশ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: গবেষক এহসান হাবীবকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৪
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×