চিন্তা করুনতো এমন একটি দৃশ্যের কথা যে দৃশ্যে আপনার মা যিনি আপনাকে তাঁর জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসেন, যিনি আপনার সুখের জন্য সমস্ত দুঃখকে অমৃত ভেবে পান করেন তিনিই আপনার সঙ্গে সকল সম্পর্ককে অস্বীকার করে আপনাকে কোন অপরিচিত গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। না, এ দৃশ্য আপনি কল্পনা করতে পারছেন না। কারণ নিশ্চিতভাবেই আপনার জীবনে এমন দুঃসহ মুহুর্ত আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে না। চিন্তা করুনতো এমন একটি দৃশ্যের কথা যে দৃশ্যে আপনার বাবা যিনি আপনার একটি উদ্বিগ্নহীন ভবিষ্যতের জন্য সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেন, আপনার সামান্য হাসিতে যিনি সমস্ত না পাওয়ার কষ্টকে ভুলেন তিনিই আপনাকে অস্বীকার করছেন। না, এবারও আপনি এ দৃশ্য কল্পনা করতে পারছেন না। কারণ নিশ্চিতভাবেই আপনি এমন দুঃসহ ঘটনার সম্মুখীন হননি, ভবিষ্যতেও হবেন না। চিন্তা করুনতো এমন একটি মুহুর্তের কথা যে মুহুর্তে আপনার ভাই, বোন ও বন্ধুরা যাদেরকে আপনি আপনার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের ভাগীদার বলে মনে করেন তাঁরাই আপনার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন। না, এবারও আপনি এ মুহুর্তটি আপনার স্মৃতিভান্ডার থেকে বের করে আনতে পারছেন না। কারণ নিশ্চিতভাবেই আপনি এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি, ভবিষ্যতেও হবেন না।
তবে এ সমাজে সবাই আপনার মতো ভাগ্যবান নন। প্রকৃতির খেয়ালে আপনার মায়ের মতোই কোন মায়ের গর্ভে, আপনার পিতার মতোই কোন পিতার ঔরসে, আপনার ভাই-বোনদের মতোই কারো সহোদর হয়ে শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে জন্ম নেন কিছু হতভাগা মানুষ। যাদেরকে কোন একটা পর্যায়ে স্নেহময়ী মা, দায়িত্ববান পিতা, আদরের ভাই-বোনেরা অস্বীকার করেন। ভদ্রমহোদয়গণ! আপনারা হয়তো ইতোমধ্যেই বুঝে গেছেন আমি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই চিরবঞ্চিত হিজড়া সম্প্রদায়ের কথাই উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। হিজড়া শব্দটির অন্য কোন সিনোনেম আমার জানা নেই। তাই বাধ্য হয়েই এবং ক্ষমা চেয়ে এই শব্দটি ব্যবহার করছি। ক্ষমা চাইছি এ কারণে যে সামাজিক অনাচারের ফলে সম্প্রদায়টির মতোই অভিধানে স্বীকৃত এ শব্দটিও অনেকটা ব্যাঙ্গাত্মক ও শ্লেষাত্মক রূপ নিয়েছে।
আমার লেখার শুরুর বক্তব্যের কারণে হয়তো অনেকে তাঁদের এ বঞ্চনার আমি তাঁদের পরিবারকে দায়ী করছি বলে মনে করতে পারেন। না, অবশ্যই তা নয়। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই বিশ্বাস, "কুসন্তান হয়তো অনেকেই, কুমাতা কেউ নয়"।একজন মা কখনই তাঁর সন্তানকে ত্যাগ করতে পারেন না। কিন্তু সামাজিক অনাচারের কারণে কিংবা সমাজে চলার বাধ্যবাদকতার কারণে অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের সমাজের বিদ্রুপের হাত হতে রক্ষা করতে মা তার প্রিয় সন্তানটিকে ত্যাগে বাধ্য হন। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন যে সামাজিক অনাচারটা কি পর্যায়ে পৌছলে একজন মা তাঁর সন্তানকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন? সামাজিক অনাচার বলতে আমি অবশ্যই এখানে সমাজ কর্তৃক হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি প্রদর্শিত নেতিবাচক আচরণকে বুঝিয়েছি।
অন্য সবার মতোই একজন হিজড়া কোন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। তবে সমাজের বাকি অংশের মতো সে বাড়ার সুযোগ পায় না। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তাঁর হয় না। সমাজের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক সময়ে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে রেখে আসেন তাঁরই মতো হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে। তারপর পেটের দায় মেটাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, পতিতাবৃত্তি, নতুন কোন শিশুর জন্ম হলে নাচগানের মাধ্যমে উপার্জন করতে হয় তাদের। আর এ উপার্জনের পথে তাঁদের সহ্য করতে হয় নানা দুঃসহ অভিজ্ঞতা। রাস্তাঘাটে কটুক্তি আর উপহাস তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। স্বস্তিতে কোথায়ও বসবাস করবেন এ উপায়ও নেই। স্বাভাবিক পরিবেশ বলতে যা বোঝায় সেখানে কেউ তাঁদের থাকতে দিতে চায় না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ হিজড়াই বস্তিতে বসবাস করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারার 'ক' উপধারা মোতাবেক রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হচ্ছে নিজের পছন্দানুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচন। কিন্তু একজন হিজড়া রাষ্ট্রের ভোটার নন। এ মৌলিক অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করাটা রাষ্ট্রের সংবিধান লংঘনেরই শামিল। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকারের লংঘন হলে আমাদের সচেতন সমাজ হৈচৈ করলেও হিজড়াদের বিষয়ে তাঁরা একেবারেই নীরব। কেন তাঁদের প্রতি এই অনুদারতা?
ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ। ধর্মকর্মের সঙ্গে বহুদিন কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক সে কারণেই ধর্মে এদের অবস্থান কোথায় তা আমার জানা নেই। এদের জামাতে নামাজ পড়ার অধিকার আছে কিনা কিংবা মারা গেলে জানাজা দেয়ার বিধান আছে কিনা তাও জানিনা। অথবা ধর্ম তাদের ধর্মকর্ম করার স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কতটুকু সে বিষয়েও আমি অজ্ঞ। তবে ব্যক্তির সবচেয়ে বড় যে অভিভাবক, যার কাছ থেকে তাঁর সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা পাওয়ার কথা সেই রাষ্ট্রই যখন তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেখানে অর্ধশিক্ষিত, সংকীর্ণমনা মোল্লাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ধর্ম তাঁদের প্রতি সহানভুতি দেখাবে সে ভরসা মোটেও করিনা।
অথচ সমাজের স্বাভাবিক আচরণ পেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা বলে পরিচিত এই হিজড়ারাই হতে পারতেন একেকজন স্বাবলম্বী মানুষ। এদের মাঝ থেকেই সৃষ্টি হত প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ কিংবা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষ। হিজড়াদের বিষয়ে কোন গবেষণালব্ধ আমার নেই। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণের আলোকে সাহস করে এদেরকে স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনার নিমিত্ত নিম্নে কিছু প্রস্তাব পেশ করছিঃ
১) পাশ্চাত্য দেশে যেমন বর্ণবাদী মন্তব্য/আচরণকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ঠিক তেমনি হিজড়াদের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গাত্মক/উপহাসমুলক আচরণকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা এবং দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে;
২) আমাদের মিডিয়া/নাটক/চলচিত্রে হিজড়া সম্প্রদায়কে সবসময়ই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর ফলে তাদের সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাগুলো আরো পোক্ত হয়। অথচ মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের প্রতি যে সামাজিক অনাচার সংঘটিত হচ্ছে, রাষ্ট্র যে তাদের প্রতি অবহেলা করছে তা জনসমক্ষে তুলে ধরা। আমার মনে হয় আমাদের সচেতন মিডিয়া এ বিষয়টির প্রতি নজর দিলে হিজড়াদের স্বভাবিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনার প্রয়াসটি সহজতর হবে;
৩) প্রাইমারী পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হিজড়া সম্প্রদায়ের লেখাপড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার নিমিত্ত নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করা যেতে পারে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের ক,খ,গ ধারার নির্দেশনা অনুসারে);
৪) সকল সরকারি ও বেসরকারি চাকুরীতে অত্যাবশ্যকভাবে হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোটা প্রবর্তন করা যেতে পারে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের ৩ ধারার 'ক' উপধারার নির্দেশনা অনুসারে);
৫) দেশের সার্বিক কর্মকান্ড এবং নিজেদের বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়াসে তাদেরকে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টে অন্তত একটি আসন হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে;
৬) হিজড়া সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা যেতে পারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের সার্বিক উন্নয়নের নিমিত্ত অধিকমাত্রায় সক্রিয়তা প্রদর্শণপূর্বক বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।
মানবীয় আচরণ ও রাষ্ট্র প্রদত্ত নিরাপত্তার দ্বারা আমরা অবশ্যই সমাজের চির অবহেলিত এ সম্প্রদায়টিকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে পারি এবং তা করণে আমাদের সাংবিধানীক বাধ্যবাদকতাও রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা আছে, " মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন"। সংবিধানের এ নির্দেশনা অনুযায়ী অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে হিজড়া সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচি নেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও বাধ্যবাদকতার মধ্যে পড়ে (সংবিধানের এ নির্দেশনা মোতাবেকই মহিলা, উপজাতি, অনগ্রসর জেলাসমূহের অধিবাসীদের জন্য সরকার বিশেষ কোটা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে)।
আমরা জানি যে, একটি দেশের উন্নতি মানে দেশের সকল শ্রেণীর সকল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর উন্নতি। তাই দেশের সকল পর্যায়ের সুষম অর্থাৎ দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য আমাদের অবশ্যই এ অবহেলিত হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোতে আনতে হবে। বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে একটি সভ্যজাতি হিসেবে পরিচিত করতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





