somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প:- জীবন দর্শন

৩০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূর্যের আলোতে চিক চিক করছে
মোস্তফা আনোয়ার এর চোখে জমে
থাকা জল গুলি। এ জলে মিশে আছে
অনেক কষ্ট, অনেক স্মৃতি। যে কষ্ট
বা স্মৃতি, কোনোটাই ভুলতে পারে না
সে। স্মৃতি গুলি প্রতিনিয়ত শুধু তার
চোখের অশ্রু ঝড়িয়ে যায়। অনেক
কষ্ট মাখানো সে অশ্রু।
লঞ্চের রেলিং ধরে বিশাল নদীর বুকে
তাকিয়ে আছে মোস্তফা আনোয়ার।
পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের আলোটা তার
মুখে এসে পড়ছে। সে আলোই তার
লুকায়িত কষ্ট গুলির বেরিয়ে আসার
পায়তারা কে, সবার সামনে তুলে ধরতে
চায়। কিন্তু মোস্তফা সাহেব তা হতে
দিতে চান না। চোখের টল টলায়ো মান
অশ্রু গুলি মুছে ঘুরে দাঁড়ান পিছনে।
পিছনে ঘুরতেই চমকে উঠেন তিনি। তার
ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন তার
স্ত্রী মেঘনা।
মেঘনার নামটা পূর্বে ছিল নিলুফা।
কিন্তু মেঘনার তীর ঘেঁষা চাঁদপুরে বড়
হওয়া মেয়েটা সবসময়ের জন্যই ছিল
নদী পাগল। বিশেষ করে যে নদীর কোল
ঘেঁষে তার বড় হওয়া, সেই মেঘনা নদীর
প্রতি ছিল তার অপরিসীম প্রেম।
মোস্তফা সাহেবের মনে হত, তার স্ত্রী
বোধহয় মেঘনা কে তার থেকে বেশি
ভালোবাসে। সেই ভালোবাসাকে কেন্দ্র
করেই তিনি স্ত্রীর নামটা পরিবর্তন
করে মেঘনা রাখেন।
মেঘনা কে দেখে মুখে এক চিলতে হাসি
ফুটিয়ে মোস্তফা সাহেব বলেন- তুমি
এখানে? ছেলে মেয়েরা কোথায়?
স্বামীর কথায় মনোযোগ নেই মেঘনার।
তার মুখটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। চুপ করে
থাকেন তিনি। স্ত্রীর এ নীরবতার
অর্থ বুঝেন মোস্তফা সাহেব। স্ত্রীকে
কিছুটা কাছে টেনে তিনি বলেন- কি হল,
হঠাত্ মন খারাপ হল কেন?
: চোখর জল মুছে দিলেও, তোমার মনে
জমে থাকা কষ্ট গুলি এখনো তোমার
চোখে ভাসছে।
বিমর্ষ মুখে, নিচু কন্ঠে, স্বামীর চোখে
চোখ রেখে কথা গুলি বলছিলেন মেঘনা।
স্ত্রীর কথা শুনে আনমনে তার দিকেই
তাকিয়ে থাকেন মোস্তফা সাহেব।
নিজের অজান্তেই তার চোখ থেকে ঝড়ে
পড়ে কয়েক ফোঁটা জল।
: তুমি কখনোই তোমার কষ্ট গুলির
কথা আমাদের কাউকে বলনি। সবসময়
শুধু আমাদের কষ্ট গুলি নিয়ে ব্যস্ত
থেকেছো। আমরা কি তোমার কেউ নই?
তোমার সুখটার সাথে সাথে কি তোমার
কষ্টটাও আমাদের সাথে ভাগ করতে
পারোনা?
মেঘনার মনে চাপা একটা কষ্ট কাজ
করছে। সে কষ্ট নিজের জন্য নয়, তার
সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির জন্য। যে
মানুষটি কিনা সারাটা জীবন নিজের
কষ্ট টাকে গোপন করে, সবাইকে
আনন্দে রাখতে চেয়েছেন।
মেঘনার চোখেও জল। মোস্তফা সাহেব
স্ত্রীকে আরও কাছে টেনে চোখের জল
মুছে দিয়ে বুকে টেনে নেন। বিশাল নদীর
কোল ঘেঁসে সূর্যটা তখন ডুব ডুব
করছিল। মাঝ বয়সী দম্পতির এমন
ভালোবাসা দেখে ডুবতে যাওয়া সূর্যটাও
যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
.
রাতের খাবার শেষ করে, দু ছেলে আর
এক মেয়েকে নিয়ে বসে চা খাচ্ছিলেন
মোস্তফা আনোয়ার। ৪৪ বছর বয়স্ক
এই মানুষটি তখন তার স্ত্রী-
সন্তানদের হাসিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ
বছরের ছোট ছেলেটা মায়ের কোলে মাথা
রেখে শুয়ে আছে। মোস্তফা সাহেব তার
সন্তানদের উদ্দেশ্যে কথা বলছিল-
তোমরা কি জানো জীবন মানে কি?
১২ বছরের ছেলে শাওন ও ১০
বছরের মেয়ে তিন্নি, দু'জনেই নিশ্চুপ।
মেঘনা তখন ছোট ছেলের মাথায় হাত
বুলিয়ে দিতে দিতে এক দৃষ্টিতে চেয়ে
আছে স্বামীর দিকে। কিছুটা সময় চুপ
থেকে মোস্তফা সাহেবই আবার বলেন-
জীবন মানে একটা পরীক্ষা, একটা
যুদ্ধ। পরীক্ষা হচ্ছে সৃষ্টি কর্তার
দেয়া বিধান অনুযায়ী সঠিক ভাবে চলার
চেষ্টা। আর যুদ্ধ হচ্ছে কঠিন
বাস্তবতার মাঝে নিজেকে সঠিক পথে
পরিচালনা। অর্থাত্, জীবনের মানে
একটাই, জীবনকে সুন্দর করা। আর
সময়ের সাথে সাথে তোমরা অবশ্যই
বুঝতে পারছো, সুন্দর জীবন কোনটা।
জীবনে অনেক কঠিন সময় আসে, যে
সময় গুলিকে কঠিন ভাবে জয় করে
নিতে হয়।
কথা গুলি বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস
ছেড়ে চুপ করে থাকেন মোস্তফা সাহেব।
শাওন আর তিন্নির পূর্ণ মনযোগ
বাবার দিকে। তারা জানে, তাদের বাবা
সত্যিই অসাধারণ এক মানুষ। যে কিনা
অযথা কথা বলে না। তার কথা হয়তবা
কাউকে আনন্দ দেয় নয়ত কিছু শিক্ষা
দেয়। এমন বাবা পেয়ে খুব গর্বিত
তিন্নি আর শাওন।
দীর্ঘ সময় চুপ থেকে মুখ খুলেন
মোস্তফা আনোয়ার- একটা গল্প শুনবে
তোমরা?
দু'জনেই এক সাথে বলে উঠে, হুম।
সামান্য বিরতি নিয়েই বলতে থাকেন
মোস্তফা সাহেব, "সময়টা আজ থেকে
৩২ বছর পূর্বে। বাবা -মা হীন ১২
বছরের অনাথ একটা ছেলে শহরের
খোলা রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে। পরনে
তার পুরাতন একটা হ্যাফপ্যান্ট, আর
বগলের কাছে ছেঁড়া একটা টি শ্যার্ট
ছেলেটার গায়ে। চেহারাটা রোদে পোড়া,
ক্ষুধার্ত ভাব। দু দিন থেকে ডাস্টবিনে
পরে থাকা ময়লা বাসি খাবার ছাড়া আর
কিছুই ভাগ্যে জুটেনি ছেলেটার। জীবনের
তাগিদে সেসব খেয়েই নিজেকে টিকিয়ে
রাখার কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে
ছেলেটা। একটা কাজের জন্য এখান
থেকে ওখানে ছুটে চলছিল সে। চৈত্রের
খর তাপে উত্তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তায়
খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে পা জোড়া যেন
ঝলসে যাচ্ছে ছেলেটার। তবুও সে
থামতে পারে না। ক্ষুধার যন্ত্রনায়
আর সব যন্ত্রনাকে তুচ্ছ লাগে।
একটা সময় ছেলেটার কঠিন এ
যন্ত্রনার অবসান হয়। এক বৃদ্ধ রুটি
দোকানদার এর দোকানে ছেলেটা কাজ
পায়। ভালোবাসা কাকে বলে সেটা সেই
ছেলেটা শিখে মূর্খ, গ্রাম্য সেই
বৃদ্ধটির কাছ থেকেই। আসলে গ্রাম্য,
সহজ-সরল, দরিদ্র মানুষ গুলির
ভালোবাসাই প্রকৃত ভালোবাসা। যে
ভালোবাসায় কোনো খাঁদ থাকে না।
কৃত্তিমতা থাকেনা। তারা যাকে
ভালোবাসবে, শুধু মনের তাড়নায়
ভালোবাসে। একটু প্রশান্তির আশায়
ভালোবাসে।
যাইহোক, সেই রুটির দোকানই ছেলেটির
আবাস হয়ে উঠে। কিন্তু ছেলেটির
ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন ছিল। বাবা মা
মারা যাওয়ার পর, শিক্ষিত আর চতুর
চাচা দের অত্যাচার সইতে না পেরে
গ্রাম ছাড়া ছেলেটা অসহায় ছিল না।
সৃষ্টি কর্তা তো তার সাথেই আছে।
প্রতিটা মানুষের সাথেই সৃষ্টিকর্তা
থাকে। শুধু আমাদের বিশ্বাসের অভাব
থাকায় আমরা তাকে অনুভব করতে
পারি না। তবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি
ছেলেটির ছিল অগাধ বিশ্বাস। প্রতি
রাতে, নির্জনে সে সৃষ্টিকর্তার সাথে
কথা বলত। রুটি দোকান দার সেই
বৃদ্ধটিই ছেলেটির লেখপড়ার ব্যাবস্থা
করে দেয়। গভীরে সমুদ্রে নিশ্চিত ডুবে
যাওয়ার পথে, ভাঙ্গা স্বপ্ন গুলিকে
পূরণ এর তরে বৃদ্ধটিকে অবলম্বন
রূপে পায় ছেলেটি। সেই সময়টাতেই
একদিন ছেলেটা স্কুল
থেকে ফিরে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বৃদ্ধর দোকানের নিয়মিত এক
কাস্টমার বৃদ্ধর সাথে কথা বলছিল,
: চাচা, শুনলাম নতুন ছেলেটাকে নাকি
স্কুলে ভর্তি করাই দিছো?
লোকটির কথায় ছিল কিছুটা উপহাসের
সুর। তবে তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত
হয়নি বৃদ্ধ। শান্ত কন্ঠে বৃদ্ধ জবাব
দেয়ে, "হুম বাজান। পোলাডার মাথাডা
খুব ভালা।"
: লাভ কি চাচা, দু কলম পইড়া কয় দিন
পর তোমারে ফালাইয়া চইলা যাইব।
: গেলে যাইব। পোলাডাত সুন্দর একটা
জীবন পাইব।
বৃদ্ধর এমন আবেগময় কথায় যেন
লোকটির খুব হাসি পাচ্ছিল। তিনি
কিছুটা তিরস্কার করেই বলেছিলেন-
চাচা, তোমার নিজেরই নুন আনতে
পান্তা ফুরায়, তোমার ক্যা এত
চিন্তা?
কিছুটা সময় চুপ করে থাকে বৃদ্ধ,
তারপর বলে- বাপরে, দুনিয়ায় আর কয়
দিন থাকমু? মরলেত সব শেষ। এই
পোলাডারে শিক্ষিত করলে আমার
কোনো লাভ নাই, তয় পোলাডা যদি
আমার অছিলায় নিজের জীবনডারে
সুন্দর করতে পারে, আমি মরার পর
একদিন হইলেওতো আমার লাগি দোয়া
করব। আর কি দরকার কও বাজান?
জীবনেত অনেক কিছুই করলা বাজান,
কওত এমন কি করছ যে তুমি মরার
পরও তোমার লাগি কেউ দোয়া করব?
আর এই অসহায় মানুষ গুলারে একটু
সাহায্য কইরা দেখ, মনটা শান্তিতে
ভইরা যাইব। আমার টেকা পয়সা নাই,
তাই বড় কিছু করবার পারিনা। তয়
যেইটা করনের ক্ষেমতা আছে, ঐটাত
করতে সমস্যা নাই? আর যাগর টেকা
আছে তাগর কয় জনেই কি করে? ভালা
কিছু করতে টেকা লাগে না বাজান।
ইচ্ছে থাকলে নিজের জায়গায় থাইকাই
অনেক ভালা কাম করন যায়।
কথা গুলি বলে চুপ করেন বৃদ্ধ।
লোকটিও নিশ্চুপ। বৃদ্ধর দিকে অপলক
তাকিয়ে ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে
গিয়েছিলেন তিনি। চোখে তার ফোঁটা
ফোঁটা জল জমে উঠেছে । বসা থেকে
উঠে লোকটি চলে যান। পাশ থেকেই
বৃদ্ধ আর লোকটির সব কথা শুনছিল
ছেলেটি। তার চোখেও জল। সেই জলটা
যে কিসের, তা জানা হয়ে উঠেনি।"
.
গল্পের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরতেই
সবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকান
মোস্তফা আনোয়ার। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে
সবার চোখে জল। তিনি নিজে যে কখন
থেকে কেঁদে চলছেন, তা হয়ত তিনি
নিজেই জানেন না। মেঘনার চোখ থেকে
ক'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার কোলে
শুয়ে থাকা বাচ্চাটির মুখের উপর।
কিছুটা সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে,
চোখ মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে
রুমের বাহিরে চলে যায় মোস্তফা
আনোয়ার।
.
আকাশে নবমির চাঁদ। সে চাঁদের আলোয়
জ্বল জ্বল করছে নদীর ছোট ছোট ঢেউ
খেলানো জল। সেদিকে তাকিয়েই,
লঞ্চের রেলিং ধরে আনমনে দাঁড়িয়ে
আছে মোস্তফা সাহেব। চাঁদের আলোতে
তার চোখের জল গুলিও চিক চিক
করছে। কিছুটা সময় পর বাস্তবে
ফিরতেই তার হাতের উপর কারো
স্পর্শ অনুভব করেন। স্বামীর হাতে
হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘনার
চোখেও ফোঁটা ফোঁটা জল এর
আনাগোনা। মোস্তফা আনোয়ারের চোখ
জোড়া স্ত্রীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে
চেয়ে আছে। সেই সময় টাতেই পিছন
থেকে শাওন ডেকে উঠে, 'বাবা, সেই
ছেলেটা কে?'
শাওনের কন্ঠে যেন কেমন উত্কন্ঠা।
একটা চাপা কষ্ট যেন তাকে ঘিরে
আছে। অনেক কৌতুহল থেকেই হয়ত
বাবা কে এভাবে প্রশ্নটা করতে বাধ্য
হয় শাওন।
ছেলের এমন প্রশ্নে বেশ কিছুটা
সময়ের জন্য একদম নিশ্চুপ হয়ে যান
মোস্তফা সাহেব। চোখ জোড়া তার চলে
যায় দূর আকাশ পানে। যে আকাশ
আপন করে রেখেছে সবাই কে। এভাবেই
কেটে যায় অনেকটা সময়। অতঃপর
মাথাটা অবনত করে মুখ খুলেন তিনি-
মহান সেই বৃদ্ধ সুলাইমান শেখ আর
নেই। আজই তিনি বিদায় জানিয়েছেন
এই নশ্বর পৃথিবীকে। আর বৃদ্ধর রুটি
দোকানের সেই ছেলেটি আর কেউ নয়,
তোমারই বাবা, এই মোস্তফা
আনোয়ার।
কথা গুলি বলতে বলতে মোস্তফা
আনোয়ারের কন্ঠটা ভার হয়ে
আসছিল। মনে হচ্ছে যেন তার কলিজা
চিড়ে বেড়িয়ে এসেছে কথা গুলি।
শাওনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এ
অশ্রু কিসের তা বুঝা বড়ই কষ্টকর।
হতে পারে কৃতজ্ঞতার, হতে পারে
কষ্টের, আবার গর্বিত বাবা কে নিয়ে
আনন্দেরও হতে পারে। তবে যাইহোক
না কেন, এই অশ্রুতে মিশে আছে বৃদ্ধর
প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা। যেই
সম্মান আর ভালোবাসায় কোনো
কৃত্তিমতা নেই। নিজের অজান্তেই
মনের গভীর থেকে চলে আসে এটা।
এটাইত চেয়েছিল বৃদ্ধ সুলাইমান শেখ।
.
সকালের দিকেই দাফন কার্য সমাপ্ত
হয় সুলাইমান শেখ এর। ধীরে ধীরে
কবরস্থান থেকে সবাই চলে যায়।
এখনো দাঁড়িয়ে আছে শুধু দু'জন।
মোস্তফা আনোয়ার, আর তার কিশোর
ছেলে শাওন। দু'জনের চারটি হাত উঠে
যায় মহান রবের উদ্দেশ্যে। মনের
সকল আকুতি আর ভালোবাসা দিয়ে,
বৃদ্ধর জন্য দোয়া শেষ করে সামনে
কয়েক কদম আগায় মোস্তফা
আনোয়ার। সেই সময়ই পিছন থেকে
পরিচিত একটা কন্ঠ ভেসে আসে,
'মোস্তফা?'
কিছুটা চমকে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়
মোস্তফা সাহেব। এতো বৃদ্ধর
দোকানের সেই নিয়মিত কাস্টমার
শফিক চাচা। আজ তিনিও বৃদ্ধ। মুখ
ভর্তি সাদা দাড়ি তার সুন্দর
চেহারাটাকে আরো উজ্জ্বল করে
রেখেছে। ক্ষাণিকটা সময় শফিক
সাহেবের
দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে, তার
দিকে এগিয়ে যায় মোস্তফা সাহেব।
তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায়
ভেঙ্গে পড়ে তিনি। বাচ্চা ছেলেদের মত
হাউ মাউ করে কাদতে থাকেন তিনি।
তার মনের সব কষ্ট যেন কান্না হয়ে
বেড়িয়ে আসতে চাইছে। নিজের চোখ
ভরে আসা জল গুলি মুছে, মোস্তফা
সাহেবের পিঠে হাত বুলিয়ে দেন শফিক
সাহেব। শাওনের চোখ থেকে টপ টপ
করে গড়িয়ে পড়ছে জল। বিষাদময় এ
পরিবেশ যেন শেষ হতে চায় না। অনেক
টা সময় পর স্বাভাবিক হয়ে সামনের
দিকে পা বাড়ায় সবাই। পিছনে
অন্ধকার কবরে একাকি শুয়ে থাকেন
সেই বৃদ্ধ সুলাইমান শেখ।
.
হাঁটছিল শফিক চাচা আর মোস্তফা
আনোয়ার। নিশ্চুপতার মধ্য দিয়েই
এভাবে হেঁটে চলছেন তারা অনেক টা
সময়।
: চাচা, আপনিত গত পঁচিশ বছর
আমাকে দেখেন নি। তাহলে চিনলেন কি
করে?
অনেকটা সময় পর, কিছুটা বিস্ময়
নিয়েই বললেন মোস্তফা আনোয়ার।
প্রশ্নটা শোনার পর কিছুটা সময়
নিশ্চুপ ভাবেই হাঁটতে থাকেন শফিক
সাহেব। তারপর বলেন- সুলাইমান চাচার
কথাটা আমার আজও মনে আছে। তিনি
বলেছিলেন, তোমাকে লেখা পড়া করিয়ে
তার হয়ত কোনো লাভ হবে না। তবে
তার মৃত্যুর পর কোনো একদিন তুমি
তার জন্য হাত তুলে দোয়া করবে, এটাই
বা কম কিসের?
আজ যখন কবরস্থান থেকে সবাই চলে
যাবার পরও তুমি রয়ে গেলে, তখন মনে
হল তুমিই সেই। আসলেই চাচা খুব
বুদ্ধিমান ছিলেন। জীবনে তিনি এমন
কিছু করে গেছেন, যার ফলাফল অনন্ত
কাল পাবেন তিনি।
কথা গুলি বলে শফিক সাহেব একটা
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে থাকেন-
সুলাইমান চাচার সেদিনের কথা
আমাকেও পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
চাচা আমাকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে,
শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার নাম
জীবন নয়। জীবন মানে সবাই কে নিয়ে
ভালো থাকার চেষ্টা করা। সবার মাঝে
নিজেকে বিলিয়ে দেয়া।
দুজনের মাঝে আরও অনেকটা সময়
কথা হয়। কথা হয় জীবন আর জীবনের
কর্ম নিয়ে।
সময়ের বিবর্তন মানুষ কে অনেক
পরিবর্তন করে দেয়। কেউ বা বেছে
নেয় ভালো পথ টাকে, কেউ বা সুখের
আশায় ছুটে মিথ্যে নামের মরীচিকার
পিছনে। কেউ বা ভোগে সুখ খুঁজে পায়,
কেউ বা ত্যাগে। তবে একটা সময়
দু'প্রকৃতির মানুষেরই জীবন অবসান
ঘটে। কিন্তু ভোগ বিলাসে মগ্ন মানুষ
গুলির মৃত্যুই জীবন এর সমাপ্তি। আর
তাদের প্রতি রয়ে যায় মানুষের ক্ষোভ
আর ঘৃণা। তবে ত্যাগের মহিমায়
উদ্ভাসিত মানুষরা মৃত্যুর পরও বেঁচে
থাকে সবার মনে। সবার মনে তাদের
জন্য থাকে অপরিসীম ভালোবাসা,
শ্রদ্ধা আর সম্মান।
জীবনের সুন্দর পথ টা নিজের চোখে
দেখে, সুলাইমান শেখ এর মতই সেই
ভালোবাসার পথে চলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা
করে শাওন। তার ছোট্ট মনটাতেই ফুটে
উঠে আগামির জন্য সুন্দর একটা
স্বপ্ন। যে স্বপ্ন হয়ত, স্বপ্ন পূরণ
করবে স্বপ্ন ভাঙ্গা কিছু মানুষের।
আর স্বপ্ন ভাঙ্গা কিছু মানুষের সেই
স্বপ্ন পূরণই হোক প্রতিটা মানুষের
স্বপ্ন। এসব ভাবতে ভাবতেই হাঁটার
পথে বাবা আর শফিক মিয়ার থেকে
কিছুটা পিছিয়ে পড়া শাওন দৌঁড়ে তাদের
সঙ্গী হয়। তার সাথে সাথে চলছে
আগামির স্বপ্ন।
.
¤¤¤ সমাপ্ত ¤¤¤
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×