যারা এই বিষয়ে বিতর্ক সুষ্টির প্রয়াস নেয় তাদেরকে দুই শ্রেনীতে বিভক্ত করা যেতে পারে।
এক নাম্বার শ্রেনীতে আছে - ৭১এর পরাজিত রাজাকার-আলবদর এবং দালালরা - যারা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশে জন্মের বিরোধীতা করেছিলো এবং আজও তার বিরুদ্ধে কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৫ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর পরিকল্পিত ভাবে “প্রপাগান্ডা”র মাধ্যমে। এরই অংশ হিসাবে বাংলাদেশের একমাত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভিকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করা হয়। ১৯৭৫ সালের পর বিটিভি এবং বাংলাদেশ রেডিওতে “পাকিস্থানী সেনাবাহিনী” এর পরিবর্তে “হানাদার বাহিনী” শব্দগুচ্ছ ব্যবহারসহ রাজাকার এবং দালালদের দৃশ্যের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ যেমন শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপটেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহম্মদকে দৃশ্যপট থেকে আড়ালে সড়িয়ে রাখা হয়। সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা যেমন জেনারেল ওসমানী, আব্দুর রব, কে এম শফিউল্লাহ, এ কে খন্দকার, খালেদ মোশাররফের মতো নেতাদের পর্দার অন্তরালে পাঠিয়ে একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে শীর্ষস্থানে উপস্থানের প্রয়াসে ইতিহাসের একটা শর্টকার্ট তৈরী করা হয়। এগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতদের “প্রপাগান্ডা ওয়ারের” অংশ বিশেষ। বিশেষ বিশেষ দিবসে দেখানো হতো এক অদ্ভুদ ধরনের নাটক। সেখানে দেখানো হতো হয়তো ১৯৭১ সালের একটা দৃশ্য যেখানে কিছু মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে অভিনয়কারী মানুষ বর্তমানে প্রচলিত “সবুজ জমিনে লাল সূর্য” পতাকাটি নিয়ে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিচ্ছে। যেখানে প্রকৃত ঘটনা ছিল ১৯৭১ সালের পতাকা ছিল “সবুজ জমিনের ভিতরে লাল সূর্য্য এবং তার ভিতরে হলুদ রংগের বাংলাদেশের মানচিত্র” এবং শ্লোগান ছিল “জয় বাংলা”। এখন হয়তো আমাদের অনেকের “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে দ্বিধা হয় - এটাকে একটা দলীয় শ্লোগান হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। যদি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন ঘটনা দেখানো হয় এবং সেখানে জয় বাংলা শ্লোগানটা না থাকে তবে সেটা হবে সত্যের অপলাপ এবং সুস্পস্ট ইতিহাস বিকৃতি। অন্যদিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি - তারা “জয় বাংলা” শ্লোগানটার বিষয়ে একটু ভেবে দেখতে পারেন। ৭১ এর হাজার হাজার মুক্তিসেনা “জয় বাংলা” উচ্চারন করেই উদ্দীপ্ত হয়েছে এবং জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। সুতরাং সেই আত্নদানকারী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যেই আমাদের এই শ্লোগানটাকে উচ্চারন করা উচিৎ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং মানুষকে - বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এই দালালরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো যথাযথ উপাত্ত না থাকায় সহজেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে মিথ্যাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
দ্বিতীয় যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তারা হলো প্রথম দলের প্রপাগান্ডার ফলে সৃষ্ট একটা বিভ্রান্ত প্রজস্ম - যাদের জন্ম যুদ্ধের পর। ফলে তারা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নির্মমতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি। এদের জন্ম একটা স্বাধীন দেশে - সুতরাং তাদের জন্যে যুদ্ধটা হলো একটা ইতিহাস। আর ১৯৭৫ এরপর এই প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস থেকে দূরে রাখার কারনেই এদের পক্ষে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী এবং দোসর রাজাকার, আলবদর- আলশামস এবং শান্তিকমিটির নির্মম হত্যাকান্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী ধর্ষনের ব্যপকতা উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। আর পরাজিত শক্তির সহজ টার্গেট হিসাবে এরা যা জেনেছে তা হলো - মুক্তিযোদ্ধা মানেই হলো একজন ব্যর্থ মানুষ - যাকে মানুষ সন্মান করবে কিংন্তু প্রকৃত সামাজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে না। আবারো টিভি প্রসংগে আসা যাক। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত বিটিভিতে যত নাটক স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে প্রচারিত হয়েছে তার অধিকাংশতেই দেখা যাবে একজন পংগু এবং রাগী মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুমিকায় অভিনয় করছে। এতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, পংগু এবং মুক্তিযোদ্ধা সমার্থক শব্দ হয়ে “পংগু মুক্তিযুদ্ধা” হিসাবে পরিচিত হয়েছে। অন্যদিকে দেখানো হচ্ছে রাজাকাররা বেশ ভাল অবস্থানে গিয়ে পৌছেছে। আর নাটকের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতিতো ছিল একটা স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে এই নতুন প্রজন্মের কাছে আদমশুমারী এরং যুদ্ধের নিহত আর নির্যাতিতাদের গননা প্রায় একই রকমের সহজ কাজ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। দেখছি কেহ কেহ স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারকে এই বলে দায়ী করছে যে, তারা যুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারন করতে ব্যর্থ হয়েছে - এটা তাদের করা উচিত ছিল। অনেকে এটা শেখ মুজিবুর রহমানের আবেগী সংখ্যা হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছ। অনেকে প্রকৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারন করার জন্যে দাবী জানাচ্ছে।
( পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ৮:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




