২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোটের পক্ষে জাতীয় সংসদের শেরপুর-১ (সদর উপজেলা) আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন জামাতে ইসলামীর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামার"জ্জামান। এই কামার"জ্জামানের অতীত নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। জামাত নেতা কামার"জ্জামান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতন, তাদের সম্পদ লুণ্ঠনসহ ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ওপর পাকি¯Íানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন তিনি। শীর্ষ স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষকসহ বরণ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য গঠিত ‘আলবদর বাহিনী’ সংগঠিত করাসহ কামার"জ্জামানের দুষ্কর্মের বর্ণনা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট’-এ বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামার"জ্জামানের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণসমূহ তৎকালীন সংবাদপত্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ও নির্যাতিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে। ’৭১ সালে কামার"জ্জামান জামাতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি।
’৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাকি¯Íানের ২৫-তম আজাদী দিবস উপলক্ষে গত শনিবার মোমেনশাহী আলবদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এই সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামার"জ্জামান। সিম্পোজিয়ামে বিভিন্ন বক্তা ‘দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দুশমনদের’ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
‘জামালপুরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জামাত নেতৃত্ব হৃদয়াঙ্গম করতে পারে যে, ছাত্রসংঘকে তারা সশস্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাধারণ তৎপরতা চালানো ছাড়াও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বিশেষ স্কোয়াড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
প্রথমত, পরীক্ষামূলকভাবে গোটা ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের আলবদর বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই সাংগঠনিক কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন কামার"জ্জামান। কামার"জ্জামানের নেতৃত্বে মাসখানেকের মধ্যেই ময়মনসিংহ জেলার সব ইসলামী ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (তথ্য সূত্র : একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ঢাকা ১৯৮৭, পৃষ্ঠা : ১১১-১১২)
শেরপুরের একজন শহীদের পিতা ফজলুল হক গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তার ছেলে শহীদ বদিউজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের একদিন তার বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে কামার"জ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জন লোকের একটি দল ধরে নিয়ে যায়। বদিউজ্জামানকে ধরে আহমদনগর পাকি¯Íানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর শহীদের বড়ো ভাই হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলার ১৮ জন আসামির অন্যতম ছিলেন কামার"জ্জামান। মামলাটির নম্বর-২ (৫) ৭২। জিআর নং-২৫০ (২) ৭২।
শেরপুর জেলার শহীদ গোলাম মো¯Íফার চাচাতো ভাই শাজাহান তালুকদার জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট আলবদররা গোলাম মো¯Íফাকে শেরপুর শহরের একটি সড়ক থেকে ধরে জোরপূর্বক তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শেরপুর শহরের সুরেন্দ্রমোহন সাহার বাড়িটি দখল করে আলবদররা তাদের ক্যাম্প বানিয়েছিল। সে ক্যাম্পে গোলাম মো¯Íফাকে ধরে নিয়ে আলবদররা তার গায়ের মাংস ও রগ কেটে, হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় শেরী ব্রিজের নিচে। সেখানে তারা গুলি করে হত্যা করে গোলাম মো¯Íফাকে। কামার"জ্জামানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল। শহীদ গোলাম মো¯Íফার হত্যাকাণ্ড যে কামার"জ্জামানের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল এই তথ্য শেরপুরের আরো অনেকেই দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শেরপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি শহীদ পিতার সন্তান তাপস সাহা জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কামার"জ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আলবদর ক্যাম্পে নারী-পুর"ষ-যুবক ধরে নিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার চালাতো। আলবদররা তাদের চাবুক দিয়ে পেটাতো। কামার"জ্জামানের বাহিনী শেরপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার মজিদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল টর্চার ক্যাম্পে। সকালে ধরে নিয়ে পুরো দিন তাকে টর্চার ক্যাম্পের ‘অন্ধকার ক‚প’-এ আটকে রাখে।
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খোলা গায়ে, মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে-মুখে চুনকালি মাখিয়ে, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে কামার"জ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর শহর প্রদক্ষিণ করে।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জিয়াউল হক জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট বিকেল ৫টায় কামাড়িচরে তার নিজের বাড়ি থেকে গাজীর খামার যাওয়ার সময় ৩ জন সশস্ত্র আলবদর তাকে ধরে শেরপুর শহরে আলবদর টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তিনি সেই ক্যাম্পে কামার"জ্জামানসহ তার সহযোগীদের দেখেন। তারা জিয়াউল হককে দুদিন টর্চার ক্যাম্পের ‘অন্ধকার ক‚পে’ আটকে রাখে। এরপর শেরপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্তে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যথায় তারা তাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়।
শেরপুরের জাতীয় পার্টির নেতা মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক হীরা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই কামার"জ্জামানের সহায়তার পাকি¯Íানিরা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে তারা ৫টা বাঙ্কার করেছিল। তার বাড়ির লিচু গাছের নিচে মানুষ ধরে এনে হত্যা করেছে।
অপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী, শেরপুরের নকলার হাজি জালাল মামুদ কলেজের শিক্ষক মুসফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনআনি বাজারের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লুট করা হয়েছিল কামার"জ্জামানের নির্দেশে ও উপস্থিতিতে।
শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকি¯Íানি সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আলবদর কর্তৃক নিরীহ লোকজনদের ধরে আনা এবং তাদের লাশ বহন করার জন্য ব্যবহৃত ট্রাকগুলোর একজন ড্রাইভার জানিয়েছেন, কামার"জ্জামান নকলার মুক্তিযোদ্ধা হন্তারবাড়ি পোড়ানোর জন্য পাকি¯Íানি বাহিনীকে রা¯Íা দেখিয়ে নিয়ে যান। তখন হন্তারবাড়ি থেকে কামার"জ্জামান প্রায় ১০০ মন চালও লুট করেন। এছাড়াও কামার"জ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা সাধারণ মানুষের গর", ছাগল ধরে নিয়ে আসতো এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তিসহ অন্যান্য জমি-সম্পত্তি জোর করে দখল করে নিতো বলে জানিয়েছেন এই ট্রাক ড্রাইভার। কামার"জ্জামানের নেতৃত্বে সেই সময় ডাকাতির অভিযোগও পাওয়া গেছে
রাজাকার কামরুজ্জামান সম্পর্ক জানুন দৈনিক ভোরের কাগজ থেকে।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:
وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।