আবারো ক্যালেন্ডারের পাতায় ৩ সংখ্যাটি জ্বলে উঠে,
তীব্র ভাবে ব্যাঙ্গ করে,
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই দিনটি কলঙ্কিত আর লজ্জার।
১৯৭৫ সালের দিনটি কিন্তু আরো দশটা দিনের মতো স্বাভাবিক ছিলো। সকালে পূর্ব দিতে সূর্য্য উঠেছে। পাখিরা গান ধরেছে। হকার পত্রিকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়েছে। বাচ্চারা মাকে জ্বালাতন করেছে।
কিন্তু কেন এই দিনটা বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত হলো। কেন একপোজ কালো রং বসে গেল এই দিনটাতে।
যদিও বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই দিনটি স্বাভাবিক ভাবে শুরু করেছিলো - কিন্তু কিছু কুলাংগার সেই দিন স্বাভাবিক দিনটাকে স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। পারেনি বঙ্গভবনে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বাংলাদেশের আধুনা মিরজাফর আর সহযোগীরা একটা স্বাভাবিক দিন শুরু করতে। এরা দেওয়ালের লিখন পড়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো - শেষ করে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চার নায়ককে - যারা তাদের অসীম সাহস আর প্রজ্ঞা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সংগ্রামকে একটা চুড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে এনে বাঙালী জাতিকে দিয়েছে একটা ভৌগলিক স্বাধীনতার আর পরিচয়।
রাষ্ট্রের কঠোর নিরাপত্তা আর হেফাযতে থাকা এই চারনেতাকে হত্যার জন্যে বঙ্গভবন থেকে আসে একটা ফোন কল - জেলারকে বাধ্য করা হয় জেলের দরজা খুলে চারনেতাকে একটা সেলে এনে জড়ো করতে।
তারপরই ঘাতকরা এসে বুলেট বর্ষন আর বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে চার মহা নায়ককে। নেমে আসে ইতিহাসের একটা কালো পর্দা - ঢেকে ফেলে একটা দিন - ৩রা নভেম্বর।
যারা তাদের মৃত্যুহীন প্রানকে নস্বর দেহ থেকে আলাদা করে চলে গেলেন - সেই মহানায়করা হলেন -
১) বাংলাদেশের প্রথম অস্হায়ী রাস্ট্রপ্রতি সৈ্য়দ নজরুল ইসলাম ,
২) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ,
৩) মন্ত্রী সভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং
৩) মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জমান ।
(২)
জেলের ভিতরের এই নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পরপরই রাষ্ট্রের ভুমিকা ছিলো সত্যই লজ্জাষ্কর। একটা রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই হ্ত্যাকান্ডের বিচার করা তো দুরে থাকুক - সেই বিচার যেন না হয় সেই ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ" জারী করে আর খুনিদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন পদে বসিয়ে পুরষ্কৃত করে। এই ইনডেমনিটি যদিও মুসতাক চক্র জারি করেছে - কিন্তু মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের সময়কালের সকল কর্মকান্ড জায়েজ করার জন্যে সংবিধানে ৫ম সংশোধনী সংযোজন করে - তার মধ্যে এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তারপর বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের সামরিক/বেসামরিক শাসন আর তারই পদাক্ষ অনুসরন করে হোমো এরশাদের সামরিক শাসন - তারপর জিয়ার দলের ক্ষমতায় আসা। পুরো সময়টা ধরেই বিচারের বানী নিভৃতে কেঁদেছে।
পরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে বিচারের পথ উন্মুক্ত করলেও - বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে যথারীতি সেই বিচারকে পথভ্রষ্ট করেছে।
ফলে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ৩রা নভেম্বরের কলঙ্ক বহন করেই যেতে হচ্ছে আমাদেরকে।
এই কলংকের বোঝা জাতির উপর চাপানোর পিছনে যেসকল খলনায়করা কাজ করেছে তারা হলো -
১) খন্দকার মুসতাক আহমদে - যিনি আওয়ামীলীগের মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও শেথ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বক্কের উপর দিয়ে হেটে ক্ষমতায় এসে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা কালীন প্রধান কাজ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জনকে বিসর্জন দেওয়া। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারবর্গসহ ৩রা নভেম্বরের বিচার বন্ধ করে ইনডেমনিটি আধ্যাদেশ জারী করে ইতিহাসের খললায়ক হিসাবে স্থান নিয়েছে।
২) বিচারপতি আ ফ ম আহসান উদ্দিন চৌধুরী - জেলহত্যার পর আপীল বিভাগের বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। মুলত আপীল বিভাগের বিচারপতিদের সামরিক শাসকদের দালাল হিসাবে কাজ করার পথিকৃত হিসাবে জেল হত্যার তদন্ত কমিশনের নামে একটা রিমোট কন্ট্রোলড কমিশন হিসাবে কাজ করেছেন - পুরষ্কার পেয়েছেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসাবে এরশাদকে সহায়তা করে।
৩) মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান - ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলহত্যায় জড়িত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কোর্ট মার্শালের সন্মুখিন হওয়া ছিলো স্বাভাবিক বিষয় - কিন্তু সেইদিন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সেইসকল খুনী সেনাসদস্যের বিচারের পরিবর্তে তাদের দেশ বের হয়ে যেতে সহায়তা করে। পরে সেইসব পলাতক খুনী সেনাসদস্যকে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশী দুতাবাসে কুটনৈতিক পদে চাকুরী দিয়ে পুরষ্কৃত করে। শুধু তাই নয় - খুনের বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের অংশ হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করতে ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে লাগানো হয়। একজন মুক্তিযুদ্ধ হয়েও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কদের হত্যার বিচারে বিষয়ে কুটচাল তাকেও ইতিহাসের খল নায়কের আসনে পাঠিয়েছে।
৪) মওদুদ আহমেদ - রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে জেল হত্যার মামলাকে একটা সাধারন মামলায় পরিনত করে এই কুচক্রী লোকটি। আওয়ামীলীগের শাসনামলে শুরু হওয়া জেল হত্যার মামলাকে আইনমন্ত্রী হিসাবে যতটুকু সম্ভব প্রভাবিত করে মুল ষড়যন্ত্রকারী ওবায়েদুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে মামলা থেকে অব্যবহতির ব্যবস্থা করে। পরবর্তীতে তৈরী করা একটি রায়ে খুনীরাও পার পেয়ে যায়।
এই ছাড়াও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়াসহ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যণ্ত ক্ষমতায় থাকা সবাই কমবেশী এই পাপের বোঝা বহন করতে আমাদের বাধ্য করেছে। এরা সবাই ইচ্ছায় - অনিচ্ছায় একটা জঘন্যতম হত্যাকান্ডের বিচার থেকে জাতিকে বঞ্চিত করে ইতিহাসের খলনায়কে পরিনত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৮:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



