somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মরন করি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আর বিচারের দাবী করছি ঘাতক আলবদর গোষ্ঠীর।

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতি বছরই পঞ্জিকার শেষ পাতায় এসে থমকে যায় বাঙ্গালী জাতি। জাতি যখন ১৯৭১ এর একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে - তখন নিশ্চিত পরাজয় জেনে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আর তাদের দোসর আলবদররা বাঙ্গালী জাতিকে বুদ্ধিহীন জাতিতে পরিনত করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবি নিধন শুরু করে। যুদ্ধাপরাধের সকল শ্রেনীর মধ্যে সবচেয়ে নির্মম এই কাজটিতে যারা সহায়তা করেছে - তারা রাজনৈতিক পাশা খেলায় নিজেদের সুরক্ষা করেইনি শুধু - নিজেদেরকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছিলো। এই কুলাঙ্গারদের রক্ষায় সেনাশাসকগন মুল ভুমিকা রাখলেও সহযোগী হিসাবে বিচারপতিগনও ছিলেন। তারই একটা উদাহরন হিসাবে একজন বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছায় এই লেখা।

(২)

বুদ্ধিজীবি হত্যার বিচারের দাবী উঠেছিলো ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর। শত্রু মুক্ত বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই বুদ্ধিজীবি হত্যার বিচারের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। বুদ্ধিজীবি হত্যার বিষয়টি তদন্ত করার জন্যে শহীদ জহির রায়হানকে প্রধান করে একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি কাজ শুরু করতেই জহির রায়হানকে নিঁখোজ হন। জহির রায়হানের নিখোঁজের বিষয়টি তদন্ত করে তিনদিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দিলেও দুঃখজনক ভাবে সেই রিপোর্ট কখনও প্রকাশিত হয়নি।

সেই সময় ডঃ আজাদকে হত্যার অভিযোগে দুইজনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেওয়া হয়। কিন্তু সেই মামলার পরিনতি সম্পর্কে পরে কিছু জানা যায়নি।

ড. আলীম চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগে আল-বদর আব্দুল মান্নান ( মাওলানা ও ইনকিলাবের মালিক) কে গ্রেফতার করা হলেও রহস্যজনক কারনে সে ছাড়া পেয়ে যায়।

শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী হিসাবে পরিচিত খালেক মজুমদারকে ট্রাইবুন্যাল জজ সাত বছরের কারাদন্ড দিলেও হাইকোর্ট সেই রায় বাতিল করে। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ও সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী তাঁদের রায়ে বলেন -

"In the circumstances, therefore, the opinion is that doubt has crept into the prosecution case and this doubt goes in favour of the accused and we accordingly give benifit of doubt.."

লক্ষ্যনীয় - বেনিফিট অব ডাউট গেল যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে। (সাম্প্রতিক জেল হত্যার মামলার রায়ে বিচারক হত্যাকারীরা জেলের ভিজিটর বুকে সই করেনি সেই অজুহাতে তাদের শাস্তি মওকুফ করেছেন)

বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী একটা আর্গুমেন্ট ছিলো - "Circumstances showing that Abdul Khaleque was a member of Jamat-e-Islami dominated the mind and Judgement of the prosecution withnesses because impresssion was created that Jamat-e-islami was against the movement of the Liberation. Be that as it may, this impression was resposible for influencing the inductive reasonings of withness."

লক্ষ্য করুন - বিচারক বলছেন - "impresssion was created that Jamat-e-islami was against the movement of the Liberation." - পুরো যুদ্ধে জামাত ঘোষনা দিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডে সক্রিয় ছিলো আর বিচারক বাদীকে দায়ী করছেন জামাতের বিরুদ্ধের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরী জন্যে। কথা শুনলে মনে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বিচারক মঙ্গলগ্রহে ছুটি কাটাচ্ছিলেন।

এই বিচারকই অবসর নেবার পর প্রেসিডেন্ট হবার জন্যে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের কাছে সমর্থনের জন্যে গিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে দেখা যাবে এই একই ধরনের আর্গুমেন্টে গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।

(৩)

১৯৭৫ এর পর যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টির সাথে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের বিচারের বিষয়টও চাপা পড়ে যায়। পরবর্তীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলন থেকে এই দাবী আবার জোড়ালো হয়। বঙ্গবন্ধৃ হত্যার মামলা চলাকালীন সময়ে এই দাবীটি আবারো সামনে আসে। তখন কেউ কেউ এই বিষয়ে আদালতে মামলা করতে উদ্যত হলেও বিশেষ কারনে তা করা হয়নি।

উপরের উদারহনটি থেকে সুম্পস্ট হবে যে - সাধারন আদালতে এই মামলার পরিনতি কি হতে পারে। যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একটা প্রবল শক্তির আশ্রয়ে থেকে যারা হত্যাকান্ড ঘঠিয়েছে - তাদের বিচার একটা সাধারন আদালতে হওয়া সম্ভব নয়। আজকের বাস্তবতা আরো কঠিন। এখন হাইকোর্টের জাজদের মধ্যে জামাত সমর্থকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। তা ছাড়াও জামাত পরিকল্পিত ভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের আইনের উপর উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত করছে - যাতে সাধারন আদালতে মামলাগুলো অর্থহীন হয়ে যায়। তার উপরে পেট্রোডলারের শক্তিতে বলীয়ান এই ঘাতকদের পক্ষে সহজেই এই মামলাগুলোকে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে। অন্যদিকে নিহত বুদ্ধিজীবিদের স্বজনেরা এমনিতেই তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে আর্থিকভাবে নিঃস অবস্থায় থেকে উঠে এসেছে। তাদের পক্ষে বছরের পর বছর মামলা চালানো সম্ভব হবে না।

লক্ষ্যনীয় যে, সরকারের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহন ছাড়া এই ধরনের মামলার কি পরিনতি হয় তা দেখার জন্যে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও পরিবার আর ৩রা নভেম্বরের জেল হত্যার মামলার গতি প্রকৃতি দেখলেই সহজেই অনুমান করা যাবে।

এই ধরনের অপরাধের বিচারের জন্যে আন্তর্জাতিক ভাবে বিশেষ ট্রাইবুনালের বিষয়টি স্বীকৃত ও অনুসৃত।
এই বিচারের একমাত্র পথ হলো বিশেষ আদালত করে "আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ অধ্যাদেশ ১৯৭৪" এর অধীনে সরকারের উদ্যোগেই বিচার করা।

প্রসংগক্রমে যুদ্ধাপরাধী বিচারে জন্যে গঠিত বিশেষ ট্রাইবুন্যাল নিয়ে কিছু তথ্য দেওয়া যাক।

১) ১৯৭২ সালে ২৪ শে জানুয়ারী "বাংলাদেশ দালাল ( বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২" জারী করা হয়।

২) ১৯৭২ সালের ২৮শে মার্চ সারাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্যে ৭৩টি ট্যাইবুন্যাল গঠিত হয়।

৩) ১৯৭৩ সালের ৩১ এ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো ৩৭,৪৭১ জনকে। মামলা নিশ্পত্তি হয়েছিলো ২,৮৪৮ জনের। দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলো ৭৫২ জন।

৪) ১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেন। যা এই বিচাররের প্রক্রিয়াকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়।

৫) সাধারন ক্ষমায় যুদ্ধাপরাধ, নারী ধর্ষন, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের অপরাধগুলোকে বিচারযোগ্য করে বাকীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

৬) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতাকে হত্যার পর ক্ষমতাশীন মুশতাক সরকার একটা অধ্যাদেশ বলে ট্রাইবুন্যালের কার্যক্রম স্থগিত করে।

৭) সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তার নিজের তৈরী দল বিএনপিকে দিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী যুক্ত করে যার মধ্যে দালালদের বিচার ট্রাইবুন্যাল স্থগিত, বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের হত্যাসহ ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর হত্যাকান্ডের বিচার রহিতকরার ইম্ডেমনিটি ও ৩রা নভেম্বর চার নেতাকে জেলে হত্যার বিচার রহিত করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

(৪)

স্বাধীনতার প্রায় চারদশক পরও দেশের শ্রেষ্ট সন্তানদের হত্যার বিচার পায়নি তাদের স্বজনেরা। আমরা সভ্যতার কথা বলি - কিন্তু নিহতদের স্বজনের দ্বীর্ঘশ্বাসের ভারাক্রান্ত বাতাস নিয়ে - ঘাতক আলবদরকে মন্ত্রী বানিয়ে - রাজাকারদের রাজনীতির সঙ্গী করে কি আসলে আমরা একটা সভ্য সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারি?

আজ এই শোকবাহ দিনে আবারো দাবী জানাই - একই দাবী জানিয়েছে গত চারদশক ধরে - জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারী রাজাকার আলবদরদের বিচার চাই। বাংলাদেশ নামক রাস্ট্রের কাছে দাবী করছি - আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অনুসরন করে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হউক। অবিলম্বে ঘাতকদের বিচারের সন্মুখিন করা হউক। এই কাজটাকে আরো সহজ করার জন্যে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন গনতদন্ত কমিশন করা যেতে পারে - যেখানে শহীদের স্বজন আর স্বাক্ষীরা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। তদন্ত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মামলা করা যেতে পারে বিশেষ ট্রাইবুন্যালে - যাতে পুরো বিষয়টিতে স্বচ্ছতা থাকে।

পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে একটা সুন্দর আর সভ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার লক্ষ্যেই এই প্রজন্মকে দ্রুত যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টি সম্পন্ন করতে হবে।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ৭:৫০
২১টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×