আসাদ বিন হাফিজ জানান, বছর দুয়েক আগে তাঁরা কয়েকজন মিলে এই মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছেন। তবে কারা কারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকদের কাজে লাগাই। কিন্তু সেটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা আপনাকে বলা যাবে না। যখন যার কাছে যাওয়া দরকার, তখন তাঁর কাছেই যাই।’
প্রকল্পের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত দুটি বই প্রকাশ করা হয়েছে-মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহী ও দৃশ্যপট একাত্তর এবং একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ। প্রথম বইটি প্রকাশ করা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারিতে আর দ্বিতীয়টি গত নভেম্বরে। দুটি বইয়েরই লেখক হিসেবে নাম আছে প্রকল্পের প্রধান আসাদ বিন হাফিজের।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে জামায়াতের সংলাপে দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ দাবি করেন, দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, দেশে স্বাধীনতাবিরোধীও কখনোই ছিল না। এরপর জামায়াত ও দলের সমর্থক পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে আরও অনেক বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়।
এ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এই দাবিতে সারা দেশেই আন্দোলন গড়ে তোলে। এই প্রেক্ষাপটেই মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহী বইটি রচনা করা হয়।
বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আজকের বাংলাদেশে কারা স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি সেটাও নির্ণয় করতে হবে বর্তমান সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে।’
এই বইতে দাবি করা হয়ঃ-
১) মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি, হয়েছে মাত্র ১০ হাজার। ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ‘শোনা যায়, শেখ মুজিব যাদের তথ্য সংগ্রহে লাগিয়েছিলেন, তারা গ্রামভিত্তিক শহীদদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। কিন্তু তাতে শহীদের সংখ্যা সাকল্যে মাত্র হাজার দশেক হওয়ায় সে তালিকা আর প্রকাশ করা হয়নি।
২) স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়ার সরকার এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারও শহীদদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারাও শহীদদের সংখ্যা ১০ হাজারের অধিক খুঁজে পায়নি।’
এই বইয়ে একাত্তর সালে জামায়াতের স্বাধীনতার বিরোধিতার যুক্তি হিসেবে বলা হয়,
‘যেহেতু ১৬ ডিসেম্বরের আগে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, অতএব ১৬ ডিসেম্বরের আগে এর অস্তিত্ব স্বীকার বা অস্বীকার করায় কিছু যায়-আসে না। যে শিশুর জন্মই হয়নি, শতবার স্বীকার করলেও তা অস্তিত্বহীন (পৃ-৪০)।’
একই বইয়ে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগই জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে দেয়নি। ৪৬ পৃষ্ঠায় দাবি করা হয়, ‘নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের অহমিকার কারণে জামায়াতসহ অন্য ইসলামি দলগুলোকে তারা কাছে ভিড়তে দেয়নি। শুধু জামায়াত বা ইসলামি দল নয়, অনেক বাম দল, বিশেষ করে চীনপন্থী দলগুলোকেও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাযুদ্ধে শরিক হতে দেয়নি।’[/sb
অন্যদিকে গত নভেম্বরে প্রকাশিত দৃশ্যপট একাত্তরঃ একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ বইয়ের প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ মানুষের হত্যার দায় চাপানো হয়েছে আওয়ামী লীগের ওপর।
লেখকের যুক্তি, ‘যদি তাই বলি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই অঢেল সৈন্য আর অস্ত্র আনার পথ যারা বন্ধ করেনি, লাখ লাখ বাঙালির প্রকৃত হত্যাকারী তারা, তাহলে কি ভুল বলা হবে?’
একই বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিব বাহিনী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইতিহাস ঘেঁটে এটুকুই জানতে পেরেছে, স্বাধীনতাযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম একটি অবদান ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা।’
একই বইয়ে পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিন সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ফারুক, রশিদ ও মেজর ডালিমের ছবি ছাপিয়ে এদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘আগস্ট বিপ্লবের তিন নায়ক’ হিসেবে।
এই বইয়ে মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ছিল কি না, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে (পৃ-৪১)। বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের নিয়েও নানা আপত্তিজনক মন্তব্য করা হয়েছে।
বইয়ে দাবি করা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাঁর সহযোগীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধে যত মানুষ নিহত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তার চেয়ে তিনগুণ মানুষ নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঢালাওভাবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করেছে (পৃ·-৭০)।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেরও সমালোচনা করা হয়েছে ৭৮ পৃষ্ঠায়।
১০৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ কখনোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক ছিল না। বরং ইতিহাস প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হন্তারক। একবার নয়, একাধিকবার এবং বিভিন্নভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হত্যা করেছে। তারাই এ দেশে এখনো বিভেদের বীজ বপন করে চলেছে।’
( মন্তব্য - মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার দীর্ঘ প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় রাজাকার জামাতচক্র এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজেদের মতো করে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। আমাদের সবাইকে এই রাজাকারী ইতিহাস থেকে সতর্ক থাকতে হবে)
কৃতজ্ঞতা: দৈনিক প্রথম আলো, ওয়াসেক বিল্লাহ)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



