১৯৯৬ সালে একবার এমনই একটা আশার সঞ্চার হয়েছিলো। আমরা যারা মাঠে ছিলাম - সরল বিশ্বাসে আমরা ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম। বিজয়ের বিষয়ে আমরা ছিলাম আত্নবিশ্বাসী। আমাদের বিজয়টাকে সরল বিশ্বাসে তুলে দিয়েছিলাম একটা দলের হাতে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু এতে করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা শেষ হয়ে যায়নি।
নতুন ভাবে নতুন উদ্যোমে শুরু হয়েছে দাবী। জন্ম নিয়েছে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি, প্রজন্ম ৭১ আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের মতো সংগঠন আর অবেশেষ আস্থার প্রতীক হিসাবে এসেছে "সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম"।
এবার সবাই আগের চেয়ে অনেক বেশী সংঘঠিত। অনেকবেশী দৃঢ়। কিন্তু এতেও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যুদ্ধাপরাধীর বিচারটা এখনই শুরু হতে হবে। তা ছাড়া দ্রুত বিচারের নামে কিছু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে কিছু দিনের জন্যে কারাগারের ভরে রেখে হয়তো একটা প্রহসন হতে পারে - বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আন্দোলনটা একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখন দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাদীদের বিচারের জন্যে অনেক সংগঠন সক্রিয়। এরা গত বছরও একটা বিরাট জনসচেতনতা অভিযান চালিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায় - ধারনা করা হয় যে এখন অনেক যুদ্ধাপরাধী লুকিয়ে আছে আর্জেনটিনায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। শুধু ঢাকা শহরেই এই অপরাধ হয়নি - দেশের প্রতিটি গ্রামে - আনাচে কানাচে যুদ্ধাপরাধী ছড়িয়ে আছে। সুতরাং যতদিন একটাও অপরাধী বিচারের বাইরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালাতে হবে।
(২)
যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনের কর্মীদের কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকা দরকার। বিষয়গুলো হলো -
১) কেন আমরা এই বিচার চাইছি?
২) কোন ধরনের বিচার চাইছি?
৩) কার কাছে বিচার চাইছি?
সবগুলো বিষয় সংক্ষেপে বলা যায় এই ভাবে - একটা আধুনিক সমৃদ্ধ প্রগতিশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। তাই এখানে এমন কোন মতাদর্শের মানুষ চাইনা যারা বারবার আমাদের পিছনে টেনে নেবে। পরাজিতরা যদি পরাজয় মেনে নেয় - তখন বিষয়টা সহজ হয়। কিন্তু ৭১ এর পরাজিতরা পরাজয় মেনে নেয়নি। এরা ৭৫ এর পর সংগঠিত হয়েছে। আঘাত করছে আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদের অর্জনকে। বিজয়ীদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। এরা চাইছে একটা বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরী হউক। এরা চাইছে আমাদের নতুন প্রজন্ম ভুলে যাক আমাদের পূর্ব পুরুষের আত্নত্যাগের মহিমা আর আত্নত্যাগের অর্জনকে।
একটা প্রগতিশীল আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্টার প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের শত্রু এই যুদ্ধাপরাধীরা মুরত রোডব্লক হিসাবে কাজ করে। এটা বারবার প্রমান করতে চাইবে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনদান ছিলো ভুল। তাতে একদল তরুন বিভ্রান্ত হবে - দাদের সংগঠিত করে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এই অপরাধীরা। তাই সামনে আগানোর জন্যে পথের বাঁধা এই জঞ্জাল পরিষ্কার করা জরুরী।
শুধু মাত্র গুটি কয়েক যুদ্ধাপরাধীর সাজার মধ্য দিয়ে এই বিচারের দাবী যেন হারিয়ে না যায়। আমরা মুলত চাইছি - যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মতাদর্শের বিচার। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হবে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মতাদর্শের পুরোপুরি নির্মলের দাবী করা।
সব সময় মনে রাখতে হবে আমরা বিচার চাইছি রাষ্ট্রের কাছে। কারন হলো এরা রাষ্ট্রের শত্রু। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগকে এই উদ্যেগ নিতে হবে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান পদে রাজনৈতিক দলের নেতারে বসে থাকবেন - সুতরাং দায়টা তাদেরই। কিন্তু কোনভাবেই আমরা কোন রাজনৈতিক দলের কাছে বিচার চাইছি না।
সুতরাং প্রাথমিক ও জরুরী কাজটা হলো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজ থেকে নির্মূল করা।
কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে নিজেদের আত্নতৃপ্তির মধ্যে ঠেলে দেওয়াটা হবে ভুল। যুদ্ধাপরারীরা শুধু ব্যক্তি বিশেষ না - এরা কয়েকটা সংগঠনের অংশও বটে। সাংগঠনিক ভাবে এরা সক্রিয় থেকে একদল মানুষকে ইতোমধ্যে বিভ্রান্ত করার সুযোগও পেয়েছে। এরা রাজনীতির চোরাগলি দিয়ে প্রধান সড়কে এসে পৌছেছে। এবার জনগন এদের প্রত্যাখ্যান করলেও এদের সংগঠন সক্রিয়। শুধু কয়েকটা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারে করে এদের সংগঠন চালাতে দেওয়া অর্থ হলো এদের সামস্ঠিক সংঘবদ্ধ অপরাধকে মেনে নেওয়া। ৭১ এ এরা কিন্তু একক ভাবে অপরাধ করেনি - কোন না কোন সংগঠনের অধীনে থেকে কাজগুলো করেছে। সুতরাং সংগঠনগুলোও যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না।
সুতরাং দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজটা হলো - যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত সকল সংগঠন যেমন মুসলীমলীগ. জামায়াত, শিবির, নেজামে ইসলাম ইত্যাদির কার্যক্রম নামে বা বেনামে চালানো বাংলাদেশের সীমানায় নিষিদ্ধ করা জরুরী।
তারপর যে বিষয়টা আসে তা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে একটা নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করার উপর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
একটা জাতীর আশা আকাংখার জন্ম হয় তাদের মহান অর্জনগুলোর ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষন ও অবিকৃত প্রচার জরুরী। এখানে বিষয়টা এসে যায় - একদল চিহ্নিত অপরাধীর বিচারের মাধ্যমে হয়তো সাময়িক বিজয় অর্জন হবে - কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিজয়কে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়টি উপেক্ষা করা হবে - ভাঙ্গা বেড়া মেরামত না করেই শিয়ালের বিরুদ্ধে অভিযানের মতো।
তাই তৃতীয় জরুরী বিষয়টা হলো - মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষন ও বিকৃত বন্ধের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়কে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া এবং "মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংরক্ষন" আইন করা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধাদের সমন্বয়ে একটা কমিশন করে এই কাজটা করা যেতে পারে। যাতে ৩০ লক্ষ শহীদ আর স্বাধীনতার ঘোষনা ধরনের বিষয় নিয়ে ইচ্ছাকৃত বিতর্ক সৃস্টিকারীদের জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তথ্য বিকৃতির বিরুদ্ধে এই ধরনের আইন আছে যার আলোকে এই আইন করা যেতে পারে।
আশা করি উপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের মতাদর্শ নির্মূলের আন্দোলন হবে দীর্ঘ মেয়াদী। এই আন্দোলনের সাময়িক বিজয় বা সাময়িক পরাজয় নিয়ে আনন্দিত বা হতাশ হবার কোন সুযোগ নেই। লক্ষ্য থাকবে দীর্ঘ মেয়াদী ও সুস্পস্ঠ।
অবশ্যই বিজয় আমাদেরই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১০:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



