স্বাভাবিক ভাবেই সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সহযোগী বাহিনী আল বদরের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। কারন উনি যা করেছেন তা অন্যায় মনে করে করেননি এবং আজও তা অন্যায় মনে করেন না। ঘটনার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও উনারা এই বিষয়টি নিয়ে কোন দু:খ প্রকাশ করেননি – ক্ষমা তো দুরের কথা। সুতরাং মুজাহিদের অপরাধ স্বীকার বা বা অস্বীকার তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তবে এই সুযোগে ট্যাইব্যুনালে দেওয়া বক্তব্য যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ন মনে হচ্ছে – কারন জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে সে একটা নীতি ও আদর্শগত অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে – সাথে সাথে কৌশলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তার বক্তৃতায় মুলত ইতিহাসকে ভিন্ন ভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে – যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী এবং জামায়াত-শিবির কর্মীদের কাছে গ্রহনযোগ্য করা হয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ন হলো – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে দারুন ভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো শব্দগত কৌশল করে শেখ মুজিবকে বিশাল অবস্থান দিয়ে মুলত উনার ভুমিকাকে যে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে তা অনেকগুলো নিউজ মিডিয়া ধরতে পারেনি বলে তারা খন্ডিতভাবে মুজাহিদের ব্যক্তব্য প্রচার করেছে – যাতে বলা হয়েছে ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক সালাম’। মুলত শেখ মুজিবুর রহমানকে এই ভাবে বলার উদ্দেশ্য হলো মাথায় উঠানে – যাতে আছাড় দিতে সুবিধা হয় – যা পরের বাক্য থেকেই পরিষ্কার বুঝা যাবে –
“ব্যক্তিত্বই বাংলাদেশকে ভারতীয় বাহিনী মুক্ত করেছিল। ওই পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব না হলে যা সম্ভব ছিল না। কারণ আমরা পিণ্ডির হাত থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লির হাতে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।“
সুতরাং দেখা যাচ্ছে জামায়াতের কাছে পিন্ডির থেকে মুক্তি কোন বিষয় না – ভারতের থেকে মুক্তিই মূখ্য এবং বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত পাঠিয়ে দেশকে মুক্ত করেছেন – তাই উনি একজন মহান নেতা।
মুজাহিদের আরেকটা বাক্য লক্ষ্য করা যাক –
দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য পাঠকালে মুজাহিদ বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের নেতা ও আর্কিটেক্ট (স্থপতি) শেখ মুজিব দেশে ফেরেন। প্রকৃতপক্ষে এ দিনই স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা যাত্রা।
এখানে লক্ষ্যনীয় বঙ্গবন্ধুকে শুধু ভারত বিরোধী নেতা বানিয়েই শেষ করেনি এই আলবদর – সে বলছে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী বাংলাদেশের সূচনা যাত্রা হয়েছে। মানে কি ২৬ শে মার্চ যে দেশে স্বাধীন হিসাবে যাত্রা করলো তা জামায়াত মানে না। এরা মনে করে তখনও ওরা স্বাধীন ছিলো – কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এর পরাজিত হয় ভারতীয় বাহিনীর কাছে। যেহেতু তখন ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের মাটিতে ছিলো – তাই ওরা ভারতের কাছে পরাধীন ছিলো পরে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বাহিনী ফেরত পাঠিয়ে দেশ স্বাধীন করে।
এরপর দেখা যাক কিভাবে জামায়াতের এই নেতা ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতক গোলাম আযমের সমান বানিয়েছে – শুধু তাই নয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে গোলাম আযম আর শেখ মুজিবুর রহমান যে একই ধরনের অবস্থানে ছিলেন – তাও বলেছে মুজাহিদ –
“তিনি দাবি করেন, তদানীন্তন জামায়াত নেতারা পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। মরহুম শেখ
সাহেব নিজেও। তারা সকলেই পাকিস্তান এক রেখেই সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য শেখ সাহেব আলোচনা চালিয়েছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম নির্বাচনে বিজয়ী শেখ সাহেবের নেতৃত্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যাহত দাবি জানিয়ে আসছিলেন।“
সবচেয়ে ভয়াবহ কথাটা বলেছে এই বাক্যে – যেখানে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমকে সামান্য সন্মান না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শিক ধারাবাহিক একটা ভূখন্ড হিসাবেই বিবেচনা করছে জামায়াত।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তবে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছে ইমান ও আদর্শের ভিত্তিতে’Ñ এ দাবিও করেছেন তিনি। তার দাবি, পাকিস্তান থেকেই পূর্ব পাকিস্তান। সেই পূর্ব পাকিস্তান থেকেই আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। সেটাই মানচিত্র। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছে ইমান ও আদর্শের ভিত্তিতে।
কি ভয়াবহ এই সংগঠন – একটা স্বাধীন দেশে বসে থেকে শুধুমাত্র ভৌগলিক সীমারেখা ছাড়া দেশটির দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে উঠা একটা আদর্শিক চেতনার সামান্য মূল্যও নেই এই সংগঠনের কাছে। এরা শুধুমাত্র পাকিস্তান থেকে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতাকে বাস্তবতার কারনে মেনে নিলেও মুলত বাংলাদেশকে আরেকটা পাকিস্তান হিসাবেই বিবেচনা করে।
উপসংহার –
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর জামায়াতের নেতারা তাদের কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই গাইছে এবং পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে জামায়াতের আদর্শভিত্তিক বক্তব্য দিচ্ছে – যা সুষ্পষ্টভাবে বাংলাদেশের জন্ম – তার বিকাশ এবং ইতিহাসকে পুরোপুরি অস্বীকার করছে। এখনই ভাবার সময় আসেনি – জামায়াত শিবির নামক বাংলাদেশ বিরোধী সংগঠনটির কার্যক্রম চালাতে দেওয়া কতটা যৌক্তিক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



