শুরু করি কিছু নিজের ঘটনা দিয়ে। দেশের বাইরে আসার পর যখন প্রথম স্বশরীরের কিছু পাকিস্তানী ক্লাসমেট পেলাম - সেই সময়ের অনুভুতি ছিলো মারাত্বক। পাকিস্তানীদের দেখলেই মাথায় রক্ত চড়ে যেতো। কিন্তু ওরা যেহেতু বুঝতো না - বুঝতে দিতাম না - তাই সব সময় ওরা ব্রাদার ব্রাদার করে ঘেষাঘেষি করতো। একসময় আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম - ৭১ নিয়ে ওরা কিভাবে? কিভাবে ৭১ মূল্যায়ন করে।
খুবই দুঃখজনক হলো - ওরা যা জানে তা খুবই ভয়াবহ ইতিহাসের বিকৃতি। ওদের স্কুল কলেজে পড়ানো হয় - ১৯৭১ সালে ভারতের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান তাদের পূর্ব অংশ হারায়। ওদের ইতিহাস শিক্ষা মুলত ভারত বিদ্ধেষ নির্ভর। সব বিষয়ে ভারতের দোষ - এই মনোভাব নিয়ে এরা বড় হয়।
যখনকার কথা বলছি - তখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তেমন দলিলপত্র ছিলো না - একদিন অনেক খোজাখুজি করে কিছু ছবি প্রিন্ট করে ওদের দিয়েছিলাম - তারপর থেকে ওদের বেশীর ভাগ আমাকে এড়িয়ে চলতো।
(২)
পরবর্তীতে যখন কানাডা চলে আসি - তখন একই নেইবারহুডে পাকিস্তানীদের সাথে বসবাস থেকে শুরু করে সহকর্মী হিসাবে পাকিস্তানীদের পেয়ে যাই। যেহেতু ইতোমধ্যে পাকিদের ইতিহাস জ্ঞান সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারনা পেয়ে গেছি - তাই ওরা যখনই ব্রাদার ব্রাদার করে ঘেষাঘেষির চেশ্টা করতো - তখনই কয়েকটা প্রশ্ন ওদের করতাম -
প্রশ্নগুলো ছিলো -
১) তুমি বাংলা জানো না কেন, ৭১ সাথে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ (৫৬%) বাংলাভাষী ছিলো, তুমি কেন বাংলা শিখোনি?
২) ভাইতো ভাগ হলো ভারতে ষড়যন্ত্রে - কিন্তু ভাই এর যে সম্পদ তোমরা রেখে দিলে - তা কি সঠিক হলো?
৩) যে সকল সৈন্য তোমাদের বাংলাদেশী বোনদের ধর্ষন করেছিলো - তাদের বিচার করা হলো না কেন?
এই তিনটা প্রশ্ন করার পর ব্রাদাররা আর ঘেষতো না। তার উপরে আছে পাকিস্তানীদের উর্দু বাতচিত - দেখামাত্রই "হাল ক্যায় হ্যায়?" - মহা বিরক্তিকর। এরা রীতিমতো তর্ক জুড়ে দেয় - কেন আমি উদ্দু জানি না। কি সমস্যার কথা । সেই সমস্যা সমাধানে একটা পথ বের করেছি - পাকিস্তানী দেখলেই বাংলায় জিজ্ঞাসা করি - "শইলডা বালা?" পাকিস্তানী দোকানে গেলে বাংলায় জিজ্ঞাসা করি -ওই দোকানদার - ২% মিল্ক আছে? ( ছেলে সাথে থাকলে হেসে মরে যায়) যারা দেশের বাইরে থাকেন আপনারও চেষ্টা করে দেখতে পারেন এই কৌশল - ওদের চেহারা যা হয় - দেখার মতো বটে!
(৩)
এতোক্ষন যা বললাম - তাতে আশা করি অনেকে ধারনা করতে পারছেন যে - ৭১ এর গনহত্যা আর ধর্ষনসহ যে যুদ্ধাপরাধ করেছে পাকিস্তানী বাহিনী তার জন্যে ক্ষমা চাওয়ার মতো সামাজিক শিক্ষা বা বোধ এখনও পাকিস্তানে জন্ম নেয়নি। ১৯৭৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে সিমলায় যে চুক্তি হয় তাতে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধত্তোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে সকল বিষয় একমত হয়েছিলো - তারমধ্যে ছিলো -বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীর প্রত্যবর্তন। সেই সুবাদের ভারত বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে একটা সমযোতা স্বাক্ষর করে - সেখানে বাংলাদেশের শর্ত ছিলো - পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে ৭১ এর অপরাধের জন্যে বাংলাদেশের জনগনের কাছে ক্ষমা চাইবে এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীদের ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকি-যুদ্ধাপরাধীন বিচারের কোন ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান কখনই সেই কাঙ্খিত ক্ষমা চায়নি।
(৪)
পাকিস্তান কখনই ক্ষমা চাইবে না। কারন সেইটা তাদের জাতীয় চরিত্রের মধ্যে পড়ে না। ওরা ৭১ থেকে আজও যাদের দ্বারা শাসিত - সেই সেনাবাহিনীর অফিসারদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার মতো রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিক বোধের চরম অভাব আছে সেই দেশটিতে। এখনও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বেলুচিস্থানে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গনহত্যা, ধর্ষন চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যারা আশা করেছিলো বা করছেন পাকিস্তান কখনও বাংলাদেশের গনহত্যার জন্যে ক্ষমা চাইবে - তারা চরম ভুলের মধ্যে বসবাস করছেন।তাই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলে - অতীত ভুলে যাও - তখন অবাক হই না - কারন হয় সে মূর্খ অথবা অতীত নিয়ে বিব্রত। কে চায় তাদের লজ্জাষ্কর অতীত মনে রাখতে! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেই অতীত যেমনটা কষ্টের - তেমনি গৌরবের - তাকে ভুলে যাওয়ার মতো কথা বলতে পারে শুধু মাত্র পাকিস্তানীরাই।
(৫)
আমরাও একটা সময় চরম বিপথগামী হওয়ার পথে ছিলাম। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা আর জেল হত্যার পর মুলত পাকিপন্থীরা ক্ষমতা এসে বিকৃত ভাবে ( অনেকটা পাকিস্তানী স্টাইলে) শর্টকাট একটা ইতিহাসের ভার্ষান আমাদের প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা শুরু করেছিলো। সেখান মুক্তিযুদ্ধের মুল শ্লোগান "জয় বাংলা" প্রতিস্থাপন করা হয়েছিলো "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" (পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে) আর মুক্তিযুদ্ধে মহানায়ক ( বিশেষ করে প্রবাসী সরকারের বিষয়টি পুরোপুরি আড়াল করে) দের বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের গনকবরগুলো তখনও মাটিতে পুরোপুরি মিশে যায়নি - তখনও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং লঞ্ছিত অপমানিত মা-বোনারে তখনও ঘরে ঘরে লজ্জিত জীবন যাপন করছিলো - তাই নতুন প্রজন্ম এই বিকৃত ইতিহাসকে বর্জন করলো। যদিও তাদের মধ্যে একটা অংশ বিপথগামী হয়েই রইল। সেই কারনে আজও দেখি গোলাম আজমের মতো একটা কুখ্যাত গনহত্যার হোতাকে রক্ষার জন্যে একদল তরুন রাস্তায় পুলিশ পেটায়। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো - এদের সংখ্যা খুবই নগন্য - প্রকৃত ইতিহাস জানা প্রজন্মের পাল্লা ভারী হওয়াই চল্লিশ বছর পর কুখ্যাত গনহত্যাকারীদের আমরা আদালতের কাঠগড়ায় দেখছি।
(৬)
শেষ কথা হলো - পাকিস্তান নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। নিজেদের পাপেই নিজেরা ভারাক্রান্ত্র। ইসলামের কথা বলে - মুসলিমদের আবাসস্থল হিসাবে জন্ম নেওয়া দেশে প্রতি শুক্রবারে বোমা বাজি হয়। সেনাবাহিনীর প্রবল প্রভাবে দেশের মানুষ একরম নপুংষক হয়ে বেঁচে আছে। জংগীবাদ, উগ্রপন্থীদের পাশাপাশি ড্রাগ স্মাগলিংএর স্বর্গরাজ্য একন পাকিস্তান। পাকিস্তানের মানুষের অহংকর ছিলো ক্রিকেট - তা আজ তাদের জন্যে লজ্জার কারন হয়ে দাড়িয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও দেখেছি প্রবাসী পাকিস্তানীরা মাথা উঁচু করে অহংকারী ভংগীতে কথা বলতো বাঙালীদের সাথে - এখন ওরা আমাদের দেখলে মাথা নীচু করে রাখে - পারতপক্ষে তর্ক করে না। সাধারন ভাবে পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন এবং একটা স্থিতিশীল দেশের সস্ভাবনায় খুবই হতাশ। এক সময় পাকিস্তানীদের একদল স্বপ্ন দেখতো - একদিন বাংলাদেশের মানুষ "ভুল বুঝতে" পারবে এবং ভাই ভাই এক হয়ে যাবে। এখন যদি জিজ্ঞাসা করা হয় - ওরা লজ্জিত ভংগীতে হেসে বলে - কি জন্যে তোমরা আমাদের সাথে আসবে!"।
পাকিস্তানীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বরে - কিন্তু নৈতিক ভাবে পরাজিত হওয়ার আর একটু বাকী আছে - আশা করা যায় - সেই পরাজয় তারা মেনে নেবে অচিরেই। কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরে যে পাকি-মনোভাবের একটা প্রজন্ম আছে - যারা এখনও বাংলাদেশের জন্মের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ন - মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্যে কি এনেদিয়েছে - তা বুঝতে অপরাগ - সেই পাকি-মানসিকতার লোকজনকে নিয়ে বাংলাদেশকে আরেকটু ভুগতে হবে। অবশ্যই এরাও পরাজিত হবে - যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে এদের পতন শুরু হবে - শেষ হবে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া দেশের স্বকীয়তা আর স্বাধীনতার গুরুত্ব উপলদ্ধির মাধ্যমে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



