ধর্মকে কেন্দ্র করে ৬ আগস্ট টরন্টোর সাপ্তাহিক আজকালের লেখক ওয়াহিদুর রহমানের লেখা ‘কোরবানির শুদ্ধতা দাবি করে হাইকোর্টের রিট’ শীর্ষক বিতর্কমূলক প্রবìধ পড়ে বিস্মিত হই। কারণ বাংলাদেশের দৈনিক নয়া দিগন্তে (আগস্ট ২, ২০১০) দেব নারায়ণ মহেশ্বর সম্বìেধ ওই লেখক লিখেছেন, ‘খবরে প্রকাশ বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পরিচয় দিয়ে দেব নারায়ণ মহেশ্বর নামে কেউ একজন মুসলমানদের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোরবানির শুদ্ধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের একটি আদালতে রিট আবেদন করেছেন। তিনি শুধু এখানে থেমে থাকেননি, ফতোয়া দিয়ে তিনি মুসলমানদের দস্তুর মতো কাফির, জালিম ও ফাসিক বানিয়ে দিয়েছেন।’
দেব নারায়ণ মহেশ্বর বাবু ‘শ্রীমদ্ভাগবদগীতায় ১৮ অধ্যায়ের ৪১ নম্বর শ্লোকে মানবাধিকারবিরোধী জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে এবং সম্রাট আকবরের আমলে রচিত ‘আল্লাহ উপনিষদ’ মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন কি? মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করে কোরবানির শুদ্ধতা দাবি করতে আদালতে প্রবেশ করা তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। হিন্দু সমাজে মানবাধিকার না থাকার কারণেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চণ্ডালিকা’ গীতিনাট্যসহ অনেক কবিতা রচনা করেছেন। কথায় বলে, ‘আপনি আচরি ধর্ম, অপরে শেখাও’। বৌদ্ধদের বোধিসত্ত্ব তারা দেবীকে ব্রাহ্মণ দুর্গা বানিয়ে দুর্গা পূজার উৎসবে চণ্ডালের সাথে গলাগলি করে না। ব্রাহ্মণ মনুসংহিতা রচনা করে হিন্দু সমাজকে তাদের কেনা গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। এদিকে রবিঠাকুর রচনা করলেন, ‘এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন, ধরো হাত সবাকার’। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী ড. বি আর আম্বেদকর মনুসংহিতা পুড়িয়ে ফেলার পর ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান রচনা করেন এবং জাতিভেদ প্রথা খেকে মুক্তি পেতে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৫০ হাজার অনুগামী নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
যত দোষ নন্দঘোষ। কেষ্টা বেটাই চোর। আসলে যথা ধর্ম, তথা জয়। মানুষ জাতির বিচারে কোনো সীমান্ত নেই। হিন্দু মুসলমান যা-ই হোক, ভেতরে সবার রক্তের রঙ লাল। মানুষ হিসেবে হিন্দু মুসলমানের ভাই এবং মুসলমান হিন্দুর ভাই। অহিংসা পরম ধর্ম। হিংসাই মানুষকে পশু বানাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে এটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কলকাতার দেশ -এ (জুন ২২, ১৯৯১) ১৭ পৃষ্ঠায় ‘মগজ ধোলাই’ শীর্ষক প্রবìেধ লেখক দীপঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘গীতায় একজন বুদ্ধিমান আরেকজন অপেক্ষাকৃত অল্প বুদ্ধিমানকে হত্যায় প্ররোচিত করছেন। এই প্ররোচনার ফলে মানুষ নিহত হয়েছিলেন অগণ্য। এরপর হাজার বছর ধরে সেই প্ররোচনামূলক গ্রন্থটিকে একটি জাতির মহান ধর্মগ্রন্থ বলে জাহির করে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে।’
লেখক মুকুল সাহা দেশ-এ (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২), ১৪ পৃষ্ঠায় ‘লিপির অতীত সìধান’ সম্বìেধ (চিঠিপত্র বিভাগ) লিখেছেন, ‘সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লিপির কোনো স্খান নেই। সরস্বতী বাগদেবী। লিপির দেবী নন। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি লেখাকে নরকের দ্বারস্বরূপ ফতোয়া জারি করে জনগণকে শোষণের একটি মোক্ষম ব্যবস্খায় নিজেদের স্বার্থ অটুট রাখতে প্রয়াসী হয়েছে (বা ‘জাতিভেদ প্রথা’ সৃষ্টি করা হলো)। ভারতবর্ষের এই ট্র্র্যাডিশনাল বিকৃতির হাত খেকে দেশবাসীকে অব্যাহতি দিতে অবশ্যই বুদ্ধ সর্বপ্রথম চেষ্টা করেন এবং সফলও হন।’
ইউরোপে নাৎসিদের হাতে ইহুদি নির্যাতনের মতো ভারতে (দক্ষিণ এশিয়া) ব্রাহ্মণ শাসক পুষ্যমিত্র (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০), রাজা শশাঙ্ক (সপ্তম শতাব্দী), ও শঙ্করাচার্য (অষ্টম শতাব্দী)সহ হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বৌদ্ধ জনগণ ও দলিত জনতা নির্যাতনসহ বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস লেখা হলে পাঠকরা দেখবেন, তা হিটলারের হলোকাস্টের চেয়ে কম বীভৎস নয়। হিন্দুত্ববাদীরা মুখে বলে, তারা ধর্মীয় দল। আসলে তারা একটি ফ্যাসিস্ট দল হয়ে বৌদ্ধদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ায় ‘মহাবোধি মন্দির’ হাজার হাজার বছর যাবৎ দখল করে আছে। রাজা শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীতে বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দির দখল করে বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করার ইতিহাস চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সম্রাট অশোকের প্রচারিত, গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাস চুরির চাতুর্য এবং রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক জোয়ারে কোথায় হারিয়ে গেল? হাজার বছর ধরে ভারতে দু:খের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছে ২৫ কোটি দলিত জনতা। লাখো দলিত প্রতি বছর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ উচ্চারণ করছেন হিন্দুত্বের জাতপাতের থাবা থেকে রক্ষা পেতে। অনেকের মতে বাংলা ভাষা পালি ভাষার বিবর্তিত রূপ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, বাংলা ভাষার আদিরূপরেখার অস্তিত্ব বগুড়ার মহাস্খানগড়ে সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে আজ থেকে দুই হাজার ৩০০ বছর আগেই বিদ্যমান ছিল।
প্রথমে বুদ্ধাব্দ সন (গৌতম বুদ্ধের নামে) ভারতীয় পঞ্জিকা থেকে সরাতে সম্রাট আকবরের রাজসভায় হিন্দু পণ্ডিতরা ‘আল্লাহ উপনিষদ’ রচনা করে সম্রাটের শুভদৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৌদ্ধ ইতিহাস চুরি, ইতিহাসের অপব্যাখ্যা, মনগড়া ইতিহাস তৈরির ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদীদের জঘন্য চাতুরির ইতিহাস লিখতে গেলে একটি ‘মহাভারত’ লিখতে হয়। কথায় বলে, ‘চুুরি, তো চুরি তার ওপর সিনাজুড়ি’। বৌদ্ধধর্ম চর্যাপদ, সিদ্ধাচার্য এবং বাংলা ভাষার ইতিহাসের আলোকে বাংলা বর্ণমালার বয়স প্রায় ২৫৫৪ বঙ্গাব্দ। কারণ দুই হাজার ৫৫৪ বছর আগে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধ) বাল্যকালে যে বাংলা লিপি অধ্যয়ন করেছিলেন, সে তথ্য বাংলা বিশ্বকোষের ১৩শ ভাগ, ৬৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে। বুদ্ধ পূর্ণিমার নাম ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা এবং থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ বৌদ্ধবিশ্বে ‘বৈশাখ’ বা থাই ভাষায় ‘বিশাখা পূজা’ নামে আজও তা বিরাজমান। বুদ্ধজয়ন্তীর বৈশাখ মাস দিয়ে বাংলা মাস শুরু হয় এবং প্রাচীন বাংলাসহ বৌদ্ধবিশ্বের পঞ্জিকায় আজ ২৫৫৫ বুদ্ধাব্দ। রাতারাতি ইতিহাস তৈরি হয় না। দেব নারায়ণ মহেশ্বর বাবু দেশ পত্রিকায় গীতা সম্বìেধ পড়ে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হয়।
ইতিহাস চুরির চাতুর্যে ভারতে বৌদ্ধধর্ম দখল : গৌতম বুদ্ধের (রাজপুত্র সিদ্ধার্থ) বুদ্ধত্বলাভের পূত পবিত্র ধ্যানভূমি বুদ্ধগয়ায় ‘মহাবোধি মন্দির’ হিন্দুত্ববাদীরা শত শত বছর ধরে দখল করে আছে। হিন্দু শাসক ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ইতিহাস চুরির চাতুর্যে বিষäুপুরাণে বুদ্ধকে বলা হয়েছে ‘মহামোহ’। ‘মনুসংহিতা’ এবং বিভিন্ন পুরাণ সাহিত্য রচনা করে বুদ্ধগয়া দখল করে রাখা হয়েছে এবং গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুর নবম অবতার বানিয়ে জাপান, থাইল্যান্ড, চীনসহ বৌদ্ধবিশ্ব থেকে মনের সুখে ‘টাকা আনা পাই’ কামানো হচ্ছে। কৌটিল্য বিধান দিয়েছেন, ভোজনে যদি বৌদ্ধ, শূদ্র প্রভৃতির ব্যবস্খা হয়, তাহলে জরিমানা দিতে হবে ১০০ পণ।
বঙ্গলিপির বয়স কত জানার অধিকার বাঙালি পাঠকদের অবশ্যই আছে। বাংলা ভাষা থেরবাদী পালি ভাষার অনেকটা বিবর্তিত রূপ বলা চলে। বৌদ্ধধর্ম, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের (গৌতমবুদ্ধ) বঙ্গলিপি অধ্যয়ন এবং ১৯০৭ সালে নেপালের রাজকীয় লাইব্রেরি থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে। গৌতম বুদ্ধের আগে ‘দেব ভাষা’ বা সংস্কৃত ভাষার কোনো লিপি ছিল না। পরে অশোকের শিলালিপির ভাষা ব্রাহ্মলিপি (প্রায় ৪০টা ভাষায় বর্ণমালার জনক) অনুসরণ করে দেবনাগরী লিপি বা বর্ণমালা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লিপির কোনো স্খান নেই। কারণ সরস্বতী বাগদেবী; তিনি লিপির দেবী নন। তাই কলকাতার বিখ্যাত কেন্দ্রীয় (ইম্পেরিয়াল) লাইব্রেরিতে গৌতম বুদ্ধের ছবি বিরাজমান। অধিকন্তু প্রাচীনকালের ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লেখাকে নরকের দ্বার হিসেবে অভিহিত করে সাধারণ মানুষের মৌলিক জনশিক্ষার অধিকার হরণ করেছিল। এই অìধকার যুগে একমাত্র গৌতম বুদ্ধই লোভী ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণ্যবাদী দলিত ঐতিহ্য ও সভ্যতা বিকৃতির হাত থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বিশ্বকোষ (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) থেকে একটি ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হলো, ‘কিয়ৎকাল পরে সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে প্রেরিত হইলেন। সেখানে তিনি বিশ্বামিত্র নামক উপাধ্যায়ের নিকট নানা দেশীয় লিপি শিক্ষা করেন। গুরুগৃহে গমনের পূর্বেই তিনি ব্রাহ্মী, ... বঙ্গলিপি ...সহ ৬৪ প্রকার লিপি অবগত ছিলেন।’ ব্রিটিশ পণ্ডিত জেমস প্রিন্সেপ ভারতে এসে সম্রাট অশোকের শিলালিপি পড়তে পারলেন; অথচ ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী পণ্ডিতরা সিìধু সভ্যতার বৌদ্ধধর্ম ও অতীত বুদ্ধগণের অস্তিত্ব স্বীকার না করে ১৮৩৭ সালে সম্রাট অশোকের শিলালিপি পড়তে না পেরে ইতিহাস চুরির চাতুর্যের হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন।