somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ কুফরী বিদায়াতী এচলাম-বিরুদী হ্যাপী বাংলা নববর্ষ

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১)

ইলিশ মাছ রাধতে পারি না বলে ইলিশ কেনার ঝামেলায় যাই না কখনোই। কিন্তু দেখতে দেখতে তিনটা বসন্ত চলে গেলো পেটে ইলিশ পড়েনি। তাই কাজ শেষ করে ঘুরতে ঘুরতে বাংলা দোকানে চলে গেলাম। দোকনে ঢুকেই ফ্রীজে উকিঝুকি মারতে লাগলাম ইলিশ মাছ আছে কিনা। এমন সময় কানে এলো বাংলা দোকানের হুজুর মালিকের সাথে জনৈক বয়স্ক কাস্টমারের কথোপকথন:
: ভাই, নামাজ কালাম পড়েননা কেন? দুই দিনেরী দুনিয়াদারী।
: ধুরু, মানুষজনের পেট খারাপ।
: কি কন এইডা! মানুষের পেটের লগে নামাজের কি সম্পর্ক?
: আরে দেশে গেছিলাম কয়েক সপ্তাহ আগে। ভাবলাম নামাজটা ধরি। তো সকালে বেলা উইঠা রেডি হইয়া গেলাম জোহরের নামাজ জামাতে পড়তে মসজিদে। জামাতে দেখি মেলা লোক। তো পয়লা রাকাতের পয়লা সেজদা দিতে গিয়া দেখি হঠাৎ সামনের ব্যাটা ধুমায়া চার-পাচটা চানাচুর খাওয়া পাঁদ দিলো। মনে হইলো সেজদার মধ্যেই বমি করি। আর এমতাবস্থায় হুজুরেরও কি হইছে, জুম্মার দুই রাকাত শেষ করে ৬ মিনিটে, তার চাইর রাকাতের একেকটা সেজদা মনে হইছে ৮ মিনিটের। এরপর যখনই নামাজে দাড়াই তখনই ঐ চানাচুর খাওয়া ব্যাটার কথা মনে পড়ে।

তাদের কথাবার্তা শুনে আমার কেমুন জানি মনে হলো। আমি সামনে এগিয়ে বললাম,"ভাই, আপনে ট্রমায় আছেন। ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান!"

কাস্টমার ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালো তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে, তারপর ফট করে বলে বসলো,"হ, ডাক্তাররে কইবো পাদের গন্ধে নামাজ পড়তে পারি না! যেইখানেই যাই খালি পাদের গন্ধ!"

এই বইলা আমি হাসবো কি কাদবো বুঝতে পারতেছি না তবে দোকানদার আর কাস্টমার শ্যেনদৃষ্টিতে তাকানো তখনও চলতে থাকলো।আমি অবস্থা বেগতিক দেখে আমি প্রশ্ন করা করলাম
: ভাই ইলিশ মাছ নাই?
: না, শেষ।
: দুই দিন আগেও তো দেখলাম অনেক গুলা।
: খায়া ফেলাইছি।

বুঝলাম ইলিশ এই বসন্তেও কপালে নাই!

২)

কুটিকাল আর কৈশোর কাল পুরোটাই মফস্বলে কাটছে। তখন বিকাল বেলা তাল তলার মাঠে কাউকে না পেলে সোজা বাসায় গিয়ে খোঁজ করতাম আড্ডার বন্ধু সংগ্রহের জন্য। তো মাঠের মাঝখানে ছিলো মফিজদের বাসা। ওদের বাসার সামনে যেতেই দেখি আহমদ আলী ডাংগুলি খেলতেছে একা একা। আমারে দেখেই বলে,"কিরে, কানা! করস কি? নাকি আন্ধা হইয়া পথ ভুইলা গেছোস?"
: মাঠে তো কেউ নাই। একলা একলা ডাংগুলি কেমনে খেলস? মফিজরে দেখোস নাই?
: বাইত্তেই আছে। যাবি নাকি? ওর দাদায় তো লজেন্স খাওয়াইবো। বলেই ওর দু চোখ জ্বল জ্বল করতে লাগলো।

লজেন্সের লোভে গেলাম দুই বন্ধু মিলে মফিজের বাসায়। বাসার আঙ্গিনায় গিয়ে দেখি দাদা গাছের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে একটা গামলায় মুড়ি মাখা খাইতেছে আর মফিজ উদাম গায়ে দুই ঠ্যাং দুই দিকে দিয়ে ঘুমাইতেছে। আমাদের দুইজনকে দেখেই দাদা জান মফিজের ডান পা একটান দেয়। আমাদের গোলগাল মফিজ এক টানে সোজা হয়ে বসে, আর ঢুলুঢুলু চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।

আমরাও দাদা জানের সাথে পাটিতে বসে মুড়িমাখায় ভাগ বসালাম। দাদাজান তার গল্পের ছাপি খুলে,"তোমাগো বন্ধু মফিজরে ওর মা বড় আদর কইরা কোলেপিঠে মানুষ করছে। যখন ওর জন্ম হয় তখন ওর স্বাস্থ্য আরও ভালো ছিলো, গায়ের রং ছিলো আলতার মতো লাল। ওর মা সেই ছোটবেলা থিকাই খুব আদর করছে। যখন ঘুমাইতো তখন বাম সাইডে কিছুক্ষন কাইত কইরা রাখতো। বাম সাইডে বেশী কাইত কইরা রাখলে যদি মাথাটা ডিমের মতো ব্যাকাচ্যাকা হইয়া যায়, সেই ভয়ে আবারও আস্তে কইরা ডান দিকে উল্টাইয়া দিতো। ডিম পোচ করনের সময় এক দিকে যাতে বেশী না হয় সেজন্য যত্ন কইরা যেমনে উল্টায় দিতে হয়, তেমনি ওরে ঘুমের মধ্যে ডাইনের থিকা বামে, বামের থিকা ডাইনে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া ঘুম পাড়াইতো। আর তাই দেখো ওর মাথাটা কি সুন্দর ডিম পোচের মতো গোল গাল হইছে!"

দাদা জান যখন এই গল্প করছিলো আমি মুড়ি মুখে দিয়া হাসতে হাসতে মুখের মুড়ি উঠানে ফালায় দিতেছিলাম আর আহমেদ আলি হাসতে হাসতে চিতকাইত!

তো সেইদিন সন্ধ্যার আগে আগে আমরা ওদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে যে যার মতো চলে আসি। তার পরের দিন মাঠে গিয়ে দেখি পুলাপান ক্রিকেট খেলতেছে। আমিও গেলাম। আমারে দিলো ব্যাটিং। উইকেট কিপিং এ ছিলো আহমদ আলি। আমি ব্যাটিং এ দাড়াতেই আহমদ আলি মফিজরে বল দিয়া জোরসে বলে,"ঐ পোঁচ মফিজ! কানুরে একটা বাউন্সার দিয়া কানা কইরা ফেলা!"

আমি "পোঁচ মফিজ" নামটা শুনে ভিত্রে ভিত্রে হেসে কুটিপাটি ওর দাদা জানের গল্পটা মনে করে আর এমন সময় হুট করে কোথা থেকে একটা বল আমার মুখ বরাবর জোরসে আঘাত করলো, আর আমার দুনিয়া আন্ধার!

৩)

এইবারের পয়লা বৈশাখ নিয়ে নানা ক্যাচাল। একদল হুজুর বলতেছে পয়লা বৈশাখ মালাউনদের সংস্কৃতি তাই এটা পালন করা হারাম। সরকারী দল বলতেছে পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নৈতিকতা বিরোধী, কারন মা ইলিশ খাইলে তাদের বংশবৃদ্ধি হবে না। আবার আরেক দল বলতেছে পহেলা বৈশাখ যেহেতু মোঘল সম্রাটের আমলে প্রচলন করা হইছে এই অন্ঞ্চলের ফসলের উৎপাদন উপলক্ষে সেহেতু এইটা পালন করতেই হবে, নাইলে বাঙ্গালী জাতী থেকে খারিজ হয়ে যেতে হবে।

কিন্তু কেউ বলতেছে না যে ইলিশ যেই নদীতে হবে সেই নদীতে তো পানি নাই। পানি না থাকলে ইলিশ খাইলে কি না খাইলেই কি! কয়দিন পর নদীর ওপর গাড়ী চললে মাছ কই থিকা আসবে সেইটারও তো খবর নাই। আবার এই পয়লা বৈশাখেই মাদ্রাসার লোকজন বোমা মেরে নিরস্ত্র মানুষদের আহত নিহত করছে ছায়ানটে, সেটা নিয়েও কথা নাই। কথা নাই এই এক বছর আগে কিছু নারীকে প্রকাশ্যে হাজার হাজার লোকের মধ্যে ধর্ষন করলো কিছু পার্ভার্ট, তাদের ছবি থাকা সত্বেও পুলিশ এই পর্যন্ত কেবল একজনকে ধরতে পেরেছে কিন্তু আদালতে তার বিরুদ্ধে এখনো চার্জশীটও দিতে পারে নাই।

যাই হোক, অত ভেবে কাজ নাই। যত বেশী ভাববো মাথার চুল ততবেশী পাকবে। তার চেয়ে ভালো আমরা রাজনীতি ধর্মীয় বিবেধ ভুলে এই উৎসব আপন করে নেই।

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ফরিদপুরে আব্বা কাকারা হালখাতা করতো। নিউমার্কেটে গেলে প্রথম দোকান থেকে আমাদের খাওয়া শুরু হতো। পুরো বছর যেসব দোকান থেকে আমরা শুধু জিনিসপত্র কিনি এই দিন কোনো কেটাকাটা হতো না। কেউ কিনুক না কিনুক, দোকানের সামনে দিয়ে গেলে কর্মচারীরা ডেকে আনবে,একটা পীরিচে করে একটা নিমকি, একটা সাদা মিস্টি আরেকটা কালোজাম। মার্কেটে ভেতরে ঢোকার আগেই পেট ভরে যেতো। তারপর কাকার দোকানে গেলে দেখতাম দেশের প্রত্যন্ত অন্ঞ্চল থেকে লোকজন এসে তাগাদার টাকা দিয়ে যাচ্ছে। তারা জিজ্ঞেস করছে, কই পড়ো, কেমন আছো, কত রকমের হ্রদ্যতা। মনে হতো বছর ঘুরে আরেকটা ঈদ। বাবার দোকানে গেলে দেখতাম সবাইকে নিয়ে বিশাল আড্ডা বসিয়েছে। তাজল কাকু(মরহুম), দাদা জান (মরহুম), শামীম কাকা, মনীন্দ্র কাকা আরও কত পরিচিত কাকারা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। কে কোন ধর্মের, আস্তিক না নাস্তিক, সেটা মাথায় থাকতো না। এমনকি মার্কেটের ভেতর যেসব সম্পদশালী হিন্দু মারোয়ারীরা ব্যাবসা করতো তারাও ডেকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতো। পেট ভরা তবুও জোর করে লুচির সাথে সেরকম তরকারী।

লুচির সাথে ঐ তরকারীর স্বাদ কারো হাতে ছিলো না, এমনকি আমার মায়ের হাতেও না। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিশাল একটা পিতলের বাসনে পোলাও, লুচি, বেগুনী, মুগ ডালের চচ্চরী আর গোস্ত। হিন্দু মুসলিম সবাই এক সাথে বসে খেতাম। আমার বন্ধুদের মধ্যে বেশীরভাগই হিন্দু ছিলো। একেকজন প্রচন্ড মেধাবী, কারো কারো ফটোগ্রাফিক মেমোরী, কারো কারো অংকে বিশাল পারদর্শিতা। ৯০ এ বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর টানা দু বছরের রায়টে এসব বন্ধুদের সংখ্যা কমতে থাকে, এসব মারোয়ারীরা দেশ ছাড়তে শুরু করে। ২০০৯ এ যখন শেষবার ফরিদপুর যাই, তখন ফরিদপুর প্রায় মারোয়ারী শূন্য। হিন্দু বন্ধুগুলো ৯০% চলে গেছে কেউ স্বপরিবারে ভারতে, কেউ আসামে, কেউ অস্ট্রেলিয়া....যে যেখানে পেরেছে।

পরিবেশ বিপর্যয় এখন যেমন বুঝতে পারি এটা আসলেই ঘটছে, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মধুখালী গেলে বুঝতে পারি সংখ্যালঘু নির্যাতন আসলেই সত্য ব্যাপার।

কিছু বলার নাই, শুধু সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা!

আর আমার শৈশবের বন্ধু, আংকেলদের একটা কথাই বলতে চাই,"দুঃখিত! আপনারা আমাদের আপন করলেও আমরা আপনাদের আপন করতে পারিনি। আপনাদের ওপর যা হইছে, তার ক্ষমারও যোগ্য না। শুধু দোয়া করি, যেখানেই থাকেন, ভালো থাকেন। সুখে থাকেন! আর ক্ষমা করবেন যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে দেশ স্বাধীন হইছিলো সেই স্বপ্নের নির্মম মৃত্যুর জন্য!"
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৬ রাত ৮:০৬
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×